মানবিক সম্পর্ক

মানুষ সর্বদা দলবদ্ধ ও সামাজিক জীব। তাই আসঙ্গ লিপ্সা মানুষের আজন্মের অভিলাষ। একাকিত্বে মানুষের যন্ত্রনা অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং মানুষ ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্য মানুষ একের পর এক সম্পর্ক গড়তে থাকে। তবে সম্পর্কগুলি মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী নয়, মানুষ সম্পর্ক ভাঙ্গে আবার নতুন করে গড়ে তোলে। এভাবে ভাঙ্গা গড়ার স্রোতধারাই জীবনের বহমানতা এবং চির সত্য।

আসলে সম্পর্কগুলি বহতা নদীর মত, সে কখনও সুমধুর তালে বয়ে যেতে থাকে আবার মাঝে মাঝে বাঁক নেয়। তাই জীবনের ঘাঁটে ঘাঁটে এর পরিবর্তন সাধিত হয়। আবার কখনও নতুনত্বের বিচিত্র রূপ নিয়ে সে আপন গতিতে বয়ে চলে। এই বয়ে চলার মধ্যে কোন কোন ঘাঁটে থাকে সংস্কারের জোয়ার আবার কোন কোন ক্ষেত্রে জীবনের জোয়ার। আবার সম্পর্ক প্রবাহের বুকে কখনও সোনার তরী ভেসে বেড়ায় যেখানে তরিখানা অসংখ্য ধনে ভরে থাকে আবার কখনও সেখানে হতাশার ছবিচিত্র জেগে থাকে। এটা মানুষে মানুষে সম্পর্কের স্বাভাবিক রূপ। জন্ম থেকেই মানুষের জীবনের আকাশে সম্পর্কগুলি মেঘের মত এসে এসে জমা হতে থাকে, তার মধ্যে কোন সম্পর্কে কার আগ্রহ বেশি তা দিয়ে তৈরি হয় তাঁর জীবনের গল্প।

প্রথমে ঘর থেকেই সম্পর্কগুলির পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। তারপর বিশাল পৃথিবী জুড়ে মানুষের সম্পর্ক কখনও ভেঙ্গে যায় আবার কখনও জেগে থাকে। কারণ মানুষ সবার আগে পারিবারিক তারপর সামাজিক । তবে যে সম্পর্ক জেগে থাকে নতুন করে তার পরিবর্তন সাধিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি তার পরিবর্তন না ঘটে তাহলে সে মৃত হয়ে যায়, যে মৃত সম্পর্ক নিয়ে মানুষ চিরদিন ধরে বেঁচে থাকতে পারেনা। কারণ ক্রমাগত বদলের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে যায়। এই বদলের মধ্যেই থাকে সম্পর্ক ভাঙ্গা গড়ার মন্ত্র, আবার কখনও কখনও প্রয়োজন। জীবনের একটা সময় প্রায় সকল মানুষই পার করে যখন সম্পর্ককে সে স্বার্থের কারনে টিকিয়ে রাখে, আবার কখনও অভ্যাসের কারনে, কখনও কখনও মনুষ্যত্বের কাঁধে ভর করে রক্তের বন্ধনে সম্পর্ক টিকে থাকে।

কখনও কখনও মানব চরিত্রে মনুষ্যত্ব ও ভালবাসা দ্বৈত রূপে প্রকাশিত হয়। দেখা যায় মানুষের ভালোবাসার আকুতি দু-একটা সম্পর্কে থাকলেও অধিকাংশ সম্পর্কেই ভালোবাসা ক্ষণিকের জন্য জন্মে আবার তা আকস্মিক ভাবেই শেষ হয়েও যায়। তাই ভালবাসাহীন সম্পর্কের মাঝে থাকে লেফট রাইট করার প্রবণতা যা মানুষকে অনেকটা একঘেয়ে করে রাখে এবং সুযোগ পেলেই যে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। আবার কখনও তা জেগে থাকে  শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের কারণে এই টিকে থাকা সম্পর্কের কোন কোন ক্ষেত্রে দায় থাকে কিন্তু দায়িত্ববোধ সেখানে অনুপস্থিত। এ থেকে প্রমাণিত হয় মানুষের ভালবাসার সম্পর্কটি গড়ে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। যখন কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদী ভালোবাসায় আপ্লূত করে রাখে তখনই মানুষ হয়ে ওঠে অতিমানব।

মানুষের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করাই মানবিকতার লক্ষণ। তাই সম্পর্ক সবসময়ই মানবিক হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবই ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কের সোপান, সব সম্পর্কই ভাঙতে পারে আবার সব সম্পর্কই নতুন করে মানুষ গড়তে পারে। তবে সম্পর্কের একটি মেয়াদ থাকে। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন ও পরিবর্তিত রূপে মানুষ মানুষের কাছে আসতে সক্ষম, নাহলে মানবিক সম্পর্ক মরে যায়। মরে যাওয়া সম্পর্ককে কেউ নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না, কেবল পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই আবার মরে যাওয়া সম্পর্কটি নতুন প্রভাতের মত এসে মানুষের চোখে আলো দেয়, আশা দেয়। আসলে আমরা পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী। জীবন ও আশা পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল, যেখানে পরিবর্তন নেই সে জায়গাটি মানুষ বাদ দিয়ে সামনে চলে যায় অন্যকোনদিকে, যেখানে মানুষ পরিবর্তনের জোয়ার অনুভব করে। অপরিবর্তনীয় জায়গাটি অচলায়তনের মত একা পড়ে থাকে যাকে মানুষ কখনই কামনা করে না।

মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। আশা সমাজ জীবনকে পূর্ণ করে তুলতে পারে। বেঁচে থাকার আশা জীবনকে করে গতিশীল, মোহময়। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার আকুতিই মানুষে মানুষে সম্পর্ক সৃষ্টির মহান উদ্দেশ্য। সম্পর্কগুলো আবর্তিত ও পরিবর্তিত হতে থাকে মানব সমাজের সাংস্কৃতিক নিয়মে। সম্পর্ক নানা কারণে পরিবর্তিত হতে পারে । যেমন বাংলাদেশে যে মেয়ের বিয়ে হয়না সে বাবার বাড়ির মমত্ব হারিয়ে ফেলে, কারণ বিয়ে হওয়া মানে তার প্রতিষ্ঠা পাওয়া। আর মেয়েটি প্রতিষ্ঠা পায়নি বলেই এই কঠিন সত্য তার সম্মুখে এসে হাজির হয়। যদিও ধীর গতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার নিয়মের পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু সব সমাজে সব দেশে এখনও এই নিয়ম বলবত আছে, মানে পরিবর্তন ঘটেনি। যে পরিবারটিতে তার জন্ম হয়েছিল সময়ের স্রোতে তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। সময় এবং সম্পর্ক একই সুত্রে ঘূর্ণয়মান, একে অতিক্রম করা যায়না। আর সম্পর্কের বাঁক এভাবেই ঘুরে মরে।

সম্পর্ক কখনও মধুর হয়, কখনও দ্বন্দ্বময় হয়, কখনও আধিপত্যময়, কখনও শত্রুতা মূলক হয়, আবার কখনও বন্ধুত্বের হাতছানিতে অসম্ভব সুন্দর হয়ে যায়। আধিপত্য মানব জীবনের এবং সম্পর্কের আর একটি বিষয়। মানুষ বেঁচে থাকার মধ্যে চায় একটি সুন্দর সম্পর্কের ভীত। পরিবার যদি আধিপত্য প্রধান হয় তবে বেঁচে থাকার মধ্যে সুখের বদলে তিক্ততা দর্শনীয় হয়ে ওঠে বেশি। আধিপত্যের রূপ বিভিন্ন ধারায় মানুষের মধ্যে বাসা বাঁধে। যেমন স্বামী আধিপত্য বিস্তার করে স্ত্রীর উপর। পিতা মাতা উভয়ের আধিপত্য সন্তানের উপর। সন্তানের আধিপত্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকটির উপর। অর্থাৎ সবল মানুষটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকটির উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। তবে এই আধিপত্য বিস্তারের মধ্যেও কখনও ভালবাসা থাকে যেমন সন্তানের প্রতি মানুষের ভালবাসা অমোঘ।

এভাবে যতদিন মানুষ একের উপর অন্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে ততদিনই সম্পর্ক একটি করে নাম নিয়ে টিকে থাকে। যখন সময়ের পরিবর্তনে একের প্রতি অন্যের আধিপত্য ম্লান হয়ে আসে তখন সম্পর্কটাও ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আধিপত্যও ফিকে হয় সময় ও জীবনের পরিবর্তনের সাথে, তারপর মানুষ দূরে সরে যেতে  থাকে। একে বলা যেতে পারে আধিপত্যময় সম্পর্ক।

গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এই আধিপত্যময় সম্পর্কের মধ্যে একটি স্বার্থের স্পষ্ট রেখা ফুটে থাকে। যে মানুষ কাউকে সম্পর্কের দ্বারা নির্ভরশীল করে রাখে সে আধিপত্যের মালিক, আর যে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য, সমাজের জন্য কারো উপর নির্ভর করে থাকে, তখনকার সময়ের জন্য সে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। দুজনেরই সম্পর্কটা সেই সময়ের জন্য মূলত স্বার্থের কারনে টিকে থাকে।

স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক হয়না। যেমন মা বাবার সাথে মানুষের সম্পর্ক থাকে উভয়ের স্বার্থের সম্পর্ক। কথাটা শুনে অনেকেই চমকে যাবে। বলবে মা বাবার চেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক হয়না, এর মধ্যে কোন স্বার্থের ব্যাপার নেই, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা দেখেছি বাবা মায়ের সন্তানদের মধ্যে যে বেশি প্রতিভাবান তাঁর প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। এটা স্বার্থের বহিঃপ্রকাশ, কারণ ঐ সন্তানটি তাঁদেরকে সমাজের প্রশংসা ও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। এক কথায় মা বাবা সন্তানকে লালান পালন করার কারণ হল নিজের ছায়া তারা সন্তানের মধ্যে দেখতে পায় এবং একটি শিশুকে মানুষ করে তোলার মধ্যে একটি নির্মল আনন্দ অনুভুব করে। এটা মানব সত্তার একটি বৈশিষ্ট্য এবং এক ধরণের স্বার্থ। আর সন্তান অসহায় অবস্থায় মা বাবার কাছে যে আশ্রয় পায় তেমন নির্ভরশীলতার আশ্রয় পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে একসময় নিজের জীবনের চাপে মা বাবা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে। তারপর এক সময় বাবা মার আবেদন ফুরিয়ে যেতে থাকে তখন কেবল ভালবাসা দিয়ে আর মানবতা দিয়ে অনেকেই সেই সম্পর্ককে সৌন্দর্য মণ্ডিত করে রাখতে পারেনা। এটা একধরনের স্বার্থপরতা।

সময় অনুসারে সম্পর্কের রূপের ভিন্নতা প্রকাশ পায়। এমনতর ভিন্নতাই বলে দেয় কোনটি মানুষের স্বার্থ আর কোনটি নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। নিঃস্বার্থ সম্পর্ককে খুঁজে মরা যায় কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। হয়তো যেখানে পূর্ণ মানুষের বাস সেখানে পাওয়া যেতে পারে। যেমন মানুষ জানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শ্রেষ্ঠ, একে অন্যকে ছাড়া জীবনের পথে চলতে পারে না। এ সম্পর্কটি মূলত ভালবাসার সম্পর্ক। অথচ স্বার্থান্ধ মানুষেরা এটাকে প্রথার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। তাই স্বামীর আধিপত্য স্ত্রীর উপর এমন ভাবে বর্তে থাকে যা অনেক সময় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে না। স্ত্রীর বেঁচে থাকার স্বার্থ সেই সম্পর্কের মধ্যে নিহিত থাকে বলে স্ত্রী পায় স্বামীর কাছে সংসারে ভালভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তা যদি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে তাহলে বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় মানুষের সংস্কারগুলি পাল্টে যেতে থাকে আর ঘন ঘন বিবাহ বিচ্ছেদ দেখা দিতে থাকে। কারন তখন স্ত্রীকে আর স্বামী নামক প্রভুর দায় মেনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যা মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, যেখানে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্কের কোন দায় থাকেনা, আর সেখানেই পাওয়া যায় প্রকৃত সম্পর্কের বিষয়টি। আবার যে সম্পর্কগুলো নির্দ্বিধায় মৃত্যু পর্যন্ত টিকে থাকে সেখানে ভালবাসাও থাকে এবং স্বার্থও থাকে। ভালবাসা মানে একের প্রতি অন্যের প্রকৃত প্রেম ও নির্ভরতা বেশি থাকে, আর স্বার্থ মানে দুজন দুজনার কাছে এত অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তারা মনে করতে থাকে এত সহমর্মিতা হয়ত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যখন মানুষ একের প্রতি অপরে গভীর মমতা ও স্বচ্ছন্দ নির্ভরতার আবেদন অনুভব করে এবং একে অন্যের উপস্থিতি জীবনের জন্য অনিবার্য বলে মনে করতে থাকে তখন সম্পর্কটি হয়ে যায় সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়। তবে বিয়ের ভুমিবিস্তারে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাই মূলত মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়, তাই ভালোবাসার সম্পর্কের চেয়ে দৈহিক সম্পর্কটাই হয়ে যায় মুখ্য। দেহকে ঘিরেই তখন ভালবাসা জন্ম নেয়। আসলে দৈহিক সম্পর্কই হল মানব সমাজ টিকিয়ে রাখার একটি ব্যবস্থা। মানব ধারা টিকে থাকার জন্যই মানুষের জৈবিক সম্পর্ক যা সকল যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিতে পৃথিবীতে টিকে থাকে এবং সমাজকে টিকিয়ে রাখে। তাই সম্পর্কটি জটিল হলেও এই সম্পর্কটি মানব সমাজের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আকাঙ্ক্ষিত।  বন্ধুত্ব একটা মধুর সম্পর্কের দিক নির্দেশক। যে সম্পর্কটি শুরু হয় সমমনা দুটি মানুষের একই রকম ভাবনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের ধারায় দুটি মানুষ আর সমমনা থাকেনা, বিভিন্ন কারণে বন্ধু দুজন এক সময় দুরকম ভাবতে শুরু করে। তখন বন্ধুত্বের সম্পর্কটি পানসে হয়ে যায় এবং তা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য হয়। কারণ বন্ধুত্বের কংকাল বহন করা মানুষের কাছে ভীষণ ভাবে ওজন দায়ক ও অসহনীয় মনে হতে থাকে। মানুষ বিশ্বাস করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্বার্থহীন সম্পর্ক। কখনও কখনও তা হলেও  সকল ক্ষেত্রে তা নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বার্থই হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের মুখ্য বিষয়। সে ক্ষেত্রে যতক্ষণ স্বার্থ থাকে ততক্ষণই সম্পর্ক থাকে তারপর অন্য কোথাও মানুষ বন্ধুত্বের হাতটি বাড়ায়। যার কারণে বন্ধুত্বের সম্পর্ক একসময় ভেঙ্গে যায় আবার নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এভাবে সম্পর্ক গুলি আপন গতিতে ও অস্তিত্বে একজন থেকে আর একজনে ক্রমাগত ভাবে প্রবাহিত হয়। এই সম্পর্ক প্রবাহকে মানব প্রবাহের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সম্পর্ক প্রবাহিত হয় বলেই পৃথিবীতে মানব ধারা টিকে আছে। পৃথিবীর মানব ধারার মধ্যে সম্পর্ক যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি স্বার্থও গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বার্থান্ধতা কোনক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা দুর্বল মানুষের প্রতি সবল মানুষের অন্যায় করার অভিসন্ধি। যদি এক শ্রেণী ক্রমাগত লাঞ্ছিত হতে থাকে তাহলে সেখানে ধীরে ধীরে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে । মানুষে মানুষে শত্রুতার সম্পর্ক কখনও কাম্য নয়।

পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মানবিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়।  আর সম্পর্কের জন্যই মানুষের চরিত্রে মানবিকতা বেশি বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুইপক্ষকেই মানবিক হতে হয় এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হতে হয়। একপক্ষ সম্পর্কের ব্যাপারে নির্বিকার থাকলে আর একপক্ষ সেই সম্পর্ককে ধরে রাখে না । মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে সম্পর্কটি নতুনত্ব পায়, কিন্তু যদি পরস্পরের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ না থাকে তখন মানবিক সম্পর্কটিও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে। সম্পর্কগুলির সর্বদাই পরিচর্যা প্রয়োজন। পরিচর্যা ছাড়া কোন সম্পর্কই টিকে থাকতে পারেনা। পরিচর্যার মাধ্যমেই মানবিক সম্পর্ক টিকে থাকে। মানবিক সম্পর্কই  মানুষের একমাত্র সাধনা। নির্লিপ্ততা কোন সম্পর্কের ধারক নয়। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন হয় এবং তার সাথে সাথে মানুষের সম্পর্কগুলোরও পরিবর্তন ঘটিয়ে সে বেঁচে থাকে। পরিবর্তন মানুষকে নেশার মত আকৃষ্ট করে। তাইতো আধুনিক জীবনের সম্পর্কগুলো পরিবর্তিত হয়ে সুন্দর ও মানবিক রূপ গ্রহণ করুক এটাই মানুষের কাম্য।

লিখেছেনঃ রোজানা নাসরীন, টরন্টো

আলিঙ্গনের মানে

প্রেমের উষ্ণতা বোঝাতেই হোক বা বন্ধুত্বের গভীরতা…আলিঙ্গন বরাবরই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাই, শুধুমাত্র দু’টি মানুষের শারীরিক ঘনিষ্ঠতার মধ্যেই এর গুরুত্বকে সীমিত রাখলে চলবে না! সম্পর্ক যাই হোক না কেন, পারস্পরিক বিশ্বাস, ভরসা, আত্মীয়তা—সবই ফুটে ওঠে এই বিশেষ কাজটির মাধ্যমে!

বিয়ার হাগ: একে অপরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতার পরিচায়ক এই আলিঙ্গনটি ‘ডেডলক হাগ’ বলেও পরিচিত। সাধারণত কাছের কোনও মানুষকে দূরে সরে না যাওয়ার আকুতি ফুটে ওঠে এর মধ্যে দিয়ে। সঙ্গীকে হারানোর ভয় বা এক ধরনের ইনসিকিউরিটিও থাকে কিছু ক্ষেত্রে। তবে সম্পর্ক মজবুত হলেও যে এরকম ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গন করতে পারবেন না, এমনটা নয়!

পোলাইট হাগ: সাধারণত ঝগড়ার পরে বা কোনও কারণে সঙ্গী যদি আপনার সঙ্গে কমফর্টেবল বোধ না করেন, তাহলে এরকম আলিঙ্গন হতে পারে। এতে দু’জনের শরীরের মধ্যে কিছুটা জায়গা ফাঁকা থাকে, অর্থাৎ দু’জনে শারীরিকভাবে অতটাও ঘনিষ্ঠ হন না। আলিঙ্গনের সময় সঙ্গী যদি এরকম দায়সারা আচরণ করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি খুব একটা আগ্রহী নন।

স্ট্যান্ড-স্টিল হাগ: সাধারণত এক্ষেত্রে, একজন সঙ্গী যতটা প্যাশনের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন, উলটোদিকের মানুষটি ততটাই শীতল, শান্ত। তিনি আলিঙ্গনের জন্য হাতটুকুও তোলেন না! অর্থাৎ, পারস্পরিক আদানপ্রদানের বড্ড অভাব। এর কারণ অবশ্য বাইরে থেকে বোঝা দুর্বোধ্য। তবে আপনার সঙ্গী হয়তো এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না যে পুরোপুরি সম্পর্কের মধ্যে থাকা উচিত কি না!

ইন্টিমেট হাগ: এর আক্ষরিক অর্থ নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলে দিতে হবে না! দু’জনেরই গভীর আবেগ আর আই কনট্যাক্ট এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। শারীরিক ঘনিষ্ঠতার থেকেও এক্ষেত্রে চোখে চোখ রেখে ভালবাসা ব্যক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।

বাডি হাগ: সঙ্গীকে একপাশ থেকে আলিঙ্গন করলে বা কাঁধের এক দিক থেকে হাত রাখলে বোঝা যায় যে শুধুমাত্র রোম্যান্স নয়, বরং পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভরসার জায়াগা আপনাদের মধ্যে রয়েছে। আর আপনারা একে অপরের ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ও বটে!

প্যাম্পারড হাগ: সঙ্গীর কপালে আলতো চুমু বা পিঠে হাত রাখা! মূলত আপনার কেয়ারিং স্বভাবেরই প্রতিফলন বলা চলে একে। সাধারণত বয়স্ক মানুষেরাও কম বয়সিদের স্নেহের বশে এরকমটা করে থাকেন।

ব্যাক হাগ: সঙ্গীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরাই এরকম আলিঙ্গনের বৈশিষ্ট্য। এর মাধ্যমেও কিন্তু নিরাপত্তার আশ্বাস ব্যক্ত করা সম্ভব। দু’পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়াও যে মজবুত, তাও বোঝা যায়।    

সম্পর্কে দূরত্ব …

ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক যদি স্বাচ্ছন্দে চলতে থাকে, সেটা যথেষ্ট শান্তির। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সম্পর্কে শুরু হতে পারে টানাপোড়েন। সেটা সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্ট খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। আপনার নিজের ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যেকোনোভাবেই সম্পর্কে দুরত্ব চলে আসতে পারে। এই অবস্থাকে বাড়তে দিলে হয়তো ভুল বোঝাবুঝি হবে, বিচ্ছেদও হতে পারে। তবে মনে রাখবেন, আপনার হাতেই আছে এই সমস্যার সমাধান। সেটা কীভাবে তা জেনে নিন:

নিজের ভুল স্বীকার করা

ভুল যে কারোই হতে পারে। আর আপনার ভুলেই যদি সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে সেটা স্বীকার করে নিন। ভুল চেপে রেখে বসে থাকবেন না। তাতে সমস্যা সমাধান হবে না। আর নিজের ভুল চেপে অযাচিত ঝগড়া করাটাও মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর ঝগড়া করলে আশেপাশের লোকজন আপনাকে ইন্ধনও দিতে পারে, তাতে সমস্যা আরও ডালপালা মেলবে। তাই ভালোবাসার সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে = নিজেকে একদম নির্দোষ না ভেবে ভুল স্বীকার করে মিটমাট করে ফেলুন।

সরি বলতে শিখুন

ভালোবাসার সম্পর্কে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো ইগো। এই ইগোর জন্য কত সম্পর্কই যে নষ্ট হয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। কোনো একটা সমস্যা হলে আপনি ভাবেন যে আমি আগে থেকে কেন সরি বলবো। প্রত্যাশা করতে থাকেন যে সঙ্গী কখন সরি বলবে। এইরকম ইগো ধরে বসে থাকবেন না। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাইলে ইগো ঝেড়ে ফেলে সরি বলতে শিখুন। এতে করে দেখবেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

সময় দিন

অনেক সময়ে সম্পর্কের দুরত্ব বাড়তে বাড়তে সমস্যার তৈরি হয়। এই দূরে থেকে যখন আর সমস্যার সমাধান করা কোনোভাবেই সম্ভব হয়না তখন কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করুন। একটি দিন বা অন্তত একটি বিকেল পরস্পরকে সময় দিন। সম্ভব হলে কিছু ভালোলাগার কথা বলুন তাকে। চেষ্টা করুন তার মনকে বুঝতে। এতে করে দেখবেন ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়ে ভালোবাসা ফিরে আসবেই।

উপহার দিন প্রিয় কিছু

যেকোনো মানুষই ছোটখাট কোনো উপহার পেলে আনন্দ পেয়ে যায়। আর সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হলে বিশেষ কোনো উপহার হতে পারে দারুণ কোনো উপায়। সেইসঙ্গে এর ফলে ভুল বোঝাবুঝিও চলে যাবে। তাই ভুল বোঝাবুঝিকে দূরে রাখতে প্রিয় মানুষটিকে প্রিয় কোনো উপহার কিনে দিতে পারেন।

অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা

আপনার সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। নিজে থেকে হয়তো ঠিক করতে পারছেন না, খারাপ বোধ হচ্ছে। আপনার কথার হয়ত প্রাধান্য থাকছে না। এক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতে পারেন। যার সঙ্গে আপনাদের উভয়েরই ভালো বোঝাপড়া আছে তাঁকে সমস্যার কথা খুলে বলতে পারে। সে হয়তো কোনো সমাধান দিতে পারে। আপনার না বলতে পাড়া কথাগুলো সঙ্গীকে বলতে পারে। এতে রাগ অভিমাব কমবে, দুরত্ব কমবে।

সম্পর্কে জেলাসি

কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ঈর্ষা আপনাদের সম্পর্কের মাঝে। অনেক সময় অতি মাখোমাখো দাম্পত্যের মধ্যেও প্রায় ঘুণপোকার মতো হানা দেয় ঈর্ষাভাব। যা ক্রমশই সম্পর্কে তিক্ততা আনে। দু’জনের সম্পর্কে ঈর্ষার সমস্যা হলে কী করবেন? 

নতুন সম্পর্ক শুরু করার সময় দু’জনকেই কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। দুটো মানুষ তো দু’রকম হবেনই। এক ছাদেক নীচে মানিয়ে থাকার প্রথম ধাপ অ্যাডজাস্টমেন্ট। কাউকে হয়তো একটু বেশি করতে হয়, কাউকে কম। কিন্তু সবচেয়ে কাছের মানুষটির কাছ থেকে সেই ত্যাগস্বীকারে মূল্য পাওয়া যায় না, উলটে সকলেই তাঁর সাফল্য, তাঁর কেরিয়ার নিয়েই প্রশংসায় মেতে ওঠেন তখন নিজের অজান্তেই সেই মানুষটার প্রতি বিদ্বেষ জন্মাতে পারে। আর থেকই আসে জেলাসি। আসলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের নানা জটিলতার মধ্যে একটি অবশ্যই একে অপরকে হিংসা।

সঙ্গীর সাফল্য বা চরিত্রের কোনও একটি দিক সম্বন্ধে নেতিবাচক চিন্তা জমে জমেই এই হিংসার জন্ম। এতে মিশে থাকে কিছুটা বঞ্চনার দুঃখ এবং হয়ত কিছুটা অভিমানও। এই নেগেটিভ ইমোশন খুব দ্রুত তার কুপ্রভাব ছড়িয়ে দেয় শরীর-মনে এবং দাম্পত্য পরিণত হয় শুধুমাত্র এক মামুলি নিয়মরক্ষার খেলায়।

‘মানছি আমার স্বামী আমার থেকে অনেক বেশি কেরিয়ারিস্টিক, অনেক বেশি সফল। কিন্তু আমিও তো ফ্যামিলির জন্যে, বাচ্চার জন্যে অনেক ত্যাগস্বীকার করেছি। পড়াশোনায় ভাল হওয়া সত্ত্বেও কেরিয়ারে মন দিতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে গেলে, আমার এফর্টের জন্যে আজ ও এত সফল, আমাদের মেয়ে পড়াশোনায় এত ভাল আর সংসার এত সহজে চলে। কিন্তু সবাই কেন ওর প্রোমোশন, ওর কেনা নতুন গাড়ি, ওর লাইফস্টাইল নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। মেয়েও তো বাবা বলতে অজ্ঞান। আমার পরিশ্রম, আমার খাটনি নিয়ে তো কেউ ভুলেও কোনও মন্তব্য করে না। মাঝে মাঝে মন হয়, সব ছেড়েছুড়ে চলে যাই, তাহলেই সব বুঝবে মজা!’ আচ্ছা আপনার কী মাঝে মাঝেই এরকম মনে হয়? আপনার সবচেয়ে কাছের প্রিয় মানুষটিকে অজান্তে হিংসা করেন না তো? আপনার মনের কোণে স্বামীর সাফল্য, জনপ্রিয়তা বা অন্য কোনও কারণবশত  বিদ্বেষ জমা হচ্ছে না তো?

• নিজের মনের মধ্যে একবার উঁকি দিয়ে দেখুন তো, সমস্যাটা সত্যি কোথায়। আপনার স্বামীর কি সত্যিই দোষ আছে না আপনার মনের কোনও জমে থাকা ক্ষোভ সম্পর্কটা জটিল করে তুলছে। অনেকসময় হেরে যাওয়া বা জনপ্রিয়তা হারাবার ভয় থেকেও জেলাসি জন্ম নেয়। নিজের কাছে সত্‌ থেকে  ভাবনাচিন্তা কাটাছেঁড়া করলেই কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সহজেই বুঝতে পারবেন।

• স্বামীর সাফল্য ভাগ করে নিন। ওঁর সাফল্যে যে আপনিও অংশীদার সেটা ভুলে যাবেন না। দুজনে মিলে একসঙ্গে এনজয় করুন।

• সিন ক্রিয়েট করবেন না। ছেলেমেয়ের সামনে তো নয়ই। স্বামী-স্ত্রী মধ্যে মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তাই নিয়ে কটূক্তি বা কাদা ছোড়াছুড়ি কুরুচির পরিচয়। এর আশ্রয় নিলে আপনি স্বামী এবং সন্তানের চোখে অনেকটাই ছোট হয়ে যাবেন।

• আপনার স্বামীর সঙ্গে একটা আউটিং অ্যারেঞ্জ করুন। বাচ্চাদের সঙ্গে না নেওয়াই ভাল। যেখানে আপনাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, যেতে পারেন সেই জায়গায়। সাংসারিক চিন্তাভাবনা ভুলে গিয়ে আগের মতো দুজনে আড্ডা দিন। কথায় কথায় গল্পচ্ছলে নিজের মধ্যে চেপে রাখা কষ্টগুলো ওঁকে জানান। বুঝিয়ে বলুন আপনি ঠিক কীভাবে ওঁকে পেতে চান। ধীরে ধীরে আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে দূরত্বটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন।

• নিজেকে আর একটু ব্যস্ত করে তুলুন। বাড়ির কাজকর্ম, ছেলেমেয়েদের তদারকি করা ছাড়াও যে বাইরে একটা বিশাল জগৎ আপনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে, তার দিকে একটু চোখ ফেরান। পছন্দের কোনও হবি আবার নতুন করে শুরু করতে পারেন বা পার্ট টাইম চাকরিও নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। বাড়িতে বসে ছোটখাট হোম বেসড বিজ়নেস শুরু করতে পারেন। তাহলে মনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।

সম্পর্ক নিয়ে কেন অসুখী হই আমরা!

সাধারনত প্রতিটি মানুষের মাঝেই হতাশা, রাগ, অভিমান, বিষণ্ণতা মোটকথা কোনো না কোনো মানসিক সমস্যা একটু-আধটু থাকেই। যাকে উদ্বেগ বা প্যাথলজিক্যাল অ্যাংজাইটি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু যখন তা আমাদের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যায় তখন সেটি আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করে। বিশেষত Relationship anxiety বা সম্পর্কের উদ্বেগ আমাদের জীবনে এতোটাই বাজেভাবে প্রভাব ফেলে যা আমাদের আশে-পাশে থাকা আপন মানুষগুলোর সাথে সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।

‘সম্পর্কের উদ্বেগ’ যার সাথে কম-বেশি প্রত্যেকটি মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। এটি আপনার সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসা বৃদ্ধির করার পরিবর্তে ভয়, সন্দেহ, ঈর্ষা, একঘেয়েমি ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তোলে যা আপনার সুন্দর সম্পর্কটিকে দীর্ঘস্থায়ী হতে বাঁধা প্রদান করে।

আসুন দেখে নেয়া যাক যেসব কারণে আমরা অসুখী সম্পর্কের সম্মুখীন হই

অতিরিক্ত রাগ রাগ সাধারনত আবেগের একটি অংশ। যা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কম-বেশি বিদ্যমান। তবে এটি মানবজীবনে ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি বিস্তার করে। কারণ, যখন একজন ব্যক্তি রেগে যায় তখন তার আপাদ-মস্তকে তাপের সৃষ্টি হয়। ফলে তার হিতাহিত জ্ঞান বলতে কিছু থাকে না। তখন সে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

‘অতিরিক্ত রাগ’ যা আমাদের আপনজনদের সাথে সুন্দর সম্পর্কগুলোর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। অল্পতেই রেগে যাওয়া এবং সেই রাগগুলোর দীর্ঘ স্থায়ীত্বকাল সম্পর্কগুলোর মধ্যে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। রেগে গিয়ে অনেকেই অনেক অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে যার ফল তাকে সারাটা জীবন ভোগ করতে হয়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। কারণ এই অতিরিক্ত রাগই আমাদের মধুর সম্পর্কগুলোতে অসুখী হবার অন্যতম কারণ।

বিশ্বাসের ঘাটতি: একটি সম্পর্কের মূল স্তম্ভই হলো বিশ্বাস। একটি সম্পর্কের মাঝে বিশ্বাস যত দৃঢ়তর সে সম্পর্কটি তত শক্তিশালী হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি বিশ্বাস বিহীন একটি সম্পর্ক বড্ড নড়বড়ে যা সম্পর্কগুলোর মাঝে বিশাল দূরত্বের সৃষ্টি করে। বিশ্বাস হচ্ছে সম্পর্কের খুঁটি। যার উপর ভর করে সম্পর্কগুলো চলতে থাকে বছরের পর বছর।

সাধারনত কারো সম্পর্কে অবিশ্বাসের বীজ বপন হয় তৃতীয় পক্ষের কোনো ব্যক্তি দ্বারা অথবা নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে। অবিশ্বাসের বীজ বপন হওয়া সম্পর্কগুলোর মাঝে সবসময় একধরনের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে যা ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরিয়ে দেয়। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় সম্পর্কগুলোর মধ্যে পুরোপুরি বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আর এভাবেই সুন্দর সুন্দর সম্পর্কগুলো বিচ্ছেদের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে অসুখী করে তুলি।

আর্থিকভাবে অসচ্ছলতা: আমরা যতই বলে থাকিনা কেন; ‘ভা্লোবাসার কাছে অর্থ মূল্যহীন’ কিন্তু বাস্তবতা ঠিক সেরকম নয়। ক্ষেত্র বিশেষ ভালোবাসা, অর্থ এবং ভালোবাসা ও অর্থ উভয়ই সম্পর্কগুলোর মাঝে পার্থক্য গড়ে তুলতে পারে। মানবজীবনে ভালোবাসা যেমন অপরিহার্য একটি জিনিস ঠিক তেমনি বেঁচে থাকতে হলে অর্থের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

বর্তমান সময়ে অর্থ ব্যতীত যেখানে এক কদম আগানো প্রায় অসম্ভব সেখানে অর্থ ব্যতীত ভালোবাসার মানুষগুলোর সাথে জীবন পাড়ি দেওয়া শুধুই স্বপ্ন। এই অর্থ যেমন প্রায় সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে ঠিক তার বিপরীত এই অর্থের অসচ্ছলতা একটি সম্পর্কের মাঝে শত সমস্যার সৃষ্টি করে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দেয়। বর্তমান সময়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে অর্থ না থাকলে খুব আপন মানুষগুলোও দূরে সরে যায়। এতে সম্পর্কগুলোর মাঝে সুখ নামক জিনিসটা উধাও হয়ে যায়।

সম্পর্কের প্রতি অযত্নবান: যে সম্পর্ক যতবেশি যত্নবান সে সম্পর্ক ততবেশি দৃঢ়। একটি ভালো সম্পর্ক কখনোই একদিনে গড়ে উঠে না। তিলে তিলে যত্নসহকারে সম্পর্কগুলোকে ভালোবাসায় পরিণত করতে হয়। প্রতিটিক্ষেত্রে এই সম্পর্কগুলোকে যথাযথ যত্ন ও ভালোবাসার সহিত আগলে না রাখলে একদিন সে সম্পর্কগুলোর মাঝেও মরিচা ধরা শুরু করে।

প্রিয় মানুষগুলো আপনার কাছ হতে অনেক কিছুই আশা করে। তারা চায় আপনি তাদের প্রতি একটু যত্নবান হোন, তাদের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে গুরুত্ব দিন। মোটকথা, যেকোনো জিনিসের যত্ন না নিলে যেমন তা অকেজো হয়ে যায় ঠিক তেমনই কোনো সম্পর্কের যদি যত্ন না নেওয়া হলে সেই সম্পর্কটিও আস্থাহীন হয়ে পড়ে। জীবন থেকে হারিয়ে যায় সুখ নামক জিনিসটি।

সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাহীন : প্রতিটি সম্পর্কই অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের। শ্রদ্ধা ও সম্মানে পরিপূর্ণ সম্পর্কগুলো অত্যন্ত সুন্দর ও সুখময় হয়ে উঠে। এবং সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কগুলো আরও পরিপক্বতা লাভ করে। এমনকি সম্পর্কগুলো অটুট থাকে জীবনাবসান অবধি।

কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সম্পর্কগুলোকে সম্মান করে না বা করতে জানে না। অহমিকা, অবিশ্বাস ও শ্রদ্ধাহীনতায় সম্পর্কগুলো বরং অশান্তির খোরাকে পরিণত হয়। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাহীন সম্পর্কগুলোও খুব বেশি স্থায়ী হয় না। জীবনযুদ্ধের মাঝপথে এসে থমকে দাঁড়ায়। যেখান থেকে নতুন করে সুখ খুঁজে নেবার আর কোনো পথ থাকে না।

সম্পর্কের প্রতি অবহেলা: অবহেলা অত্যন্ত নিগৃহীত একটি জিনিস। কোনো ব্যক্তিই কারো অবহেলার পাত্র হতে চায় না। যে অবহেলিত হয় সে নিজেও হাজারো চেষ্টা চালিয়ে যায় তার ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে অবহেলার পরিবর্তে একটু ভালোবাসা পেতে। অথচ অধিকাংশক্ষেত্রেই সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসা পাবার চেয়ে অবহেলিত হবার পরিমাণটা আরো বেড়ে যায়।

সবকিছু সহ্য করা যায় কিন্তু ভালোবাসার মানুষগুলোর কাছ থেকে অবহেলা জিনিসটা সহ্য করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। অবহেলিত হতে হতে তা যখন মানুষটির ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলে তখন সে শত কষ্ট হলেও সে পথ হতে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু তারপরও একটু ভালোবাসা পাবার জন্য প্রিয় মানুষটির শত অবহেলা উপেক্ষা করেও পথ চেয়ে থাকে। দিনশেষে একরাশ অবহেলা, হতাশা ও ব্যর্থতা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় মানুষটিকে।

অহংকার: অহংকার বা অহমিকা মানুষের অস্বাভাবিক, বিকৃত ও জঘন্যতম একটি স্বভাব। অহংকার শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পতনের মূল কারণই নয়, এই অহংকার একটি সুন্দর সম্পর্ক পতনেরও অন্যতম কারণ।

একজন অহংকারী ব্যক্তি নিজেকে সবসময়ই বড় মনে করে থাকে। এবং তার পাশে থাকা মানুষটিকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে। এতে করে একটি সম্পর্কের সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর মনে ঐ অহংকারী ব্যক্তির প্রতি একপ্রকার ঘৃনার জন্ম নেয়। যা তাদের মধ্যে বেশ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেয়। বয়ে আনে অশান্তি। পতন হয় হাজারো যত্নে গড়ে তোলা একটি সুখী সম্পর্কের।

আপনজনদের সময় না দেওয়া: ব্যস্ততম জীবনের মাঝেও প্রতিটি মানুষ চায় তার প্রিয়জনদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে। আপনজনদের সাথে কাটানো সময়গুলো সবসময়ই মধুর হয়ে থাকে। তাদের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো সম্পর্কের গভীরতা আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজেদের মধ্যে অপ্রকাশিত ভালোবাসাগুলো ফুটে উঠে খুব সহজেই।

কিন্তু বাস্তবতা কিছু মানুষকে সবসময়ই তার ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে অনেকটা দূরে সরিয়ে রাখে। বাস্তবতার সাথে হেরে যাওয়া মানুষগুলো সবসময় এক ধরনের অপূর্ণতায় ভুগে। যদিও অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তবে যাই হোকনা কেন; ভালোবাসায় আপন মানুষগুলো যখন তাদের প্রিয় মানুষটির কাছ হতে প্রাপ্য সময় না পায় তখন তাদের মাঝেও সবসময় একধরনের বিষণ্ণতা বিরাজ করে।

সকলের মতামতকে প্রাধান্য না দেওয়া : যখন আপনি কারো সাথে একটি সম্পর্ক গড়ে তুলবেন তখন আপনাকে তার মতামতকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। একতরফাভাবে যেরকম একটি সম্পর্ক গড়ে উঠে না ঠিক তেমনই একতরফাভাবে কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহন করা ঠিক না। সেক্ষেত্রে সম্পর্কগুলোর সাথে যুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির মতামত মন দিয়ে শোনা এবং তাদের মতামতকে যথাসাধ্য প্রাধান্য দেওয়া অপরিহার্য।

কিন্তু যখন আপনি সেই সম্পর্কের সাথে সম্পৃক্ত কোনো কাজে তার মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন তখন সে নিজেকে মূল্যহীন মনে করবে। এমনকি এভাবে চলতে চলতে একটা সময় তা সম্পর্কের মাঝে মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

দিন শেষে জীবনযুদ্ধে তারাই বিজয়ী যারা শত ব্যস্ততা, ব্যর্থতা, ও অপূর্ণতা দূরে সরিয়ে রেখে আপনজনদের নিয়ে সুখে জীবনযাপন করছে। সুখ-দুঃখ মিলিয়েই জীবন। সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আপন মানুষগুলোকে ভালোবেসে ভালো রাখাটাই সবচেয়ে বড় সার্থকতা। সবশেষে, ভালো থাকুন এবং ভালো রাখুন আপনার আপনজনদের।

সম্পর্কের সুখ দুখ

জানালার শিক ধরে আকাশ পানে চেয়ে আছে তামান্না। পড়ন্ত বিকেলে মেঘেরা বাহারী রঙ গায়ে মাখিয়ে ছোটাছুটি করছে। অপরূপ সে দৃশ্য। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে থেকেও তা দেখছে না তামান্না। কিংবা বলা চলে দেখতে পারছে না। পারবে কিভাবে, তার মন তো তার নিজের মাঝে নেই। উদাস মন মহাশূন্য ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে তার হারানো ঠিকানা। কিন্তু পাচ্ছে না। এ জন্য তামান্নার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। বুকের মাঝে কষ্ট যেন কামড়ে ধরছে। বার বার ঘুরে ফিরে একটি মুখ ভেসে আসছে হৃদয়পটে। আর সঙ্গে সঙ্গে ফাকা হয়ে যাচ্ছে বুক, ফিরে আসছে কষ্টগুলো। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ভালবাসার মানুষের সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কিন্তু বার বার ফিরে আসছে কাটানো মধুময় সে সময়গুলো আর সেই সঙ্গে ভালবাসা হারানোর কষ্ট। কোন কিছুতেই মন দিতে পারছে না সে। অথচ আর কিছুদিন পরেই তার পরীক্ষা। এখন কি করবে তামান্না? এরকম পরিস্থিতি তামান্নার মতো হাজারো তরুণ-তরুণীর। হৃদয় ভাঙ্গা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিশ্বখ্যাত সংবেশনবিদ (হিপনটিসট) পল ম্যাককেনা এবং মনোচিকিৎসক ড. হগ উইলবর্ন কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেই আলোকেই কিভাবে ভগ্ন হৃদয়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা তুলে ধরা হলো।

কষ্টকে মেনে নিন

যাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক। কষ্ট না লাগলে বরং বলতে হবে আপনার ভালবাসায় খাদ আছে। তাই কষ্ট লাগবেই, এমনটা ভাবা শুরু করুন, দেখবেন কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে। মনে রাখবেন মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ মিলেই। ভালবাসার রঙিন সময়টাতে সুখের ভেলায় চড়ে কল্পজগতে পাড়ি দিয়েছেন মহাসমুদ্র, বুনেছেন কতসহস্র স্বপ্ন তার ইয়ত্তা নেই। তাই বলে যে জীবন সবসময় একরকমভাবেই যাবে, তা তো নয়। এটা জীবনের ধর্মও নয়। রাতের অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে কোন কিছু চিন্তা না করেই আপনি লাইটের সুইচ দেন, ঠিক তেমনি ভালবাসার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে অচেতনভাবেই আপনার মনে অতীতের স্মৃতি চলে আসবে আর তা আপনাকে পোড়াবে, ভেঙ্গেচুড়ে দিতে চেষ্টা করবে, এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিন। দেখবেন ধীরে ধীরে কষ্ট কমে যাবে।

পুরনো অভ্যাসগুলোকে পাত্তা দেবেন না

ভালবাসার সময়টাতে আপনাদের জানতে কিংবা অজানন্তে অনেক অভ্যাসই তৈরি হয়ে গেছে। এই অভ্যাসগুলোই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই না? এক কথায় বলব, ঝেড়ে ফেলুন। যে অভ্যাসগুলো আপনি সে সময়ে করেছেন, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। জানি কষ্ট হবে, কিন্তু কী আর করা। মাথায় কেউ আর আঙুল চালিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে না, আঙুলে আঙুলে কাটাকাটি খেলা আর হচ্ছে না। এরকম হাজারো রোমান্টিক কাজ, কত খুনসুটিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এখন তা পোড়াচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করুন, এগুলো নিতান্তই সে সময়কার অভ্যাস, এগুলো চিরন্তন নয়। সে সময় এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলে এখনও যে তা করতে হবে এমনটা তো নয়, এভাবেই ভাবা শুরু করুন। দেখবেন অভ্যাসগুলোর শূন্যতা আপনাকে আর পীড়া দিচ্ছে না। ও, আর হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই দুঃখবাদী রোমান্টিক গান শুনবেন না। এটা আপনার পোড়ামনের জ্বালা না কমিয়ে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সম্পর্ক ভাঙ্গার পর বেশিরভাগ মানুষই দুঃখের গান শোনে। না, একদমই না। আপনি মোটেও এ ধরনের গান শুনবেন না।

পরিবর্তন আনুন ভাবনায়

প্রেমময় সময়ে কত কিছুই না চিন্তা করেছেন ভাললাগার মানুষটিকে নিয়ে। কত স্বপ্নই না বুনেছেন। এখন ছাড়ুন তো এসব। অনেক হয়েছে, এবার ভাবনা থামান। ভাবনায় ভাললাগার মানুষটি বার বার চলে আসলেও মাথা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেলুন। দেখুন তো অন্য কোন কিছু ভাবা যায় কিনা। যেমন ধরুন, আপনি আপনার চারপাশের পরিবেশ, মানুষ, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারেন। মনে রাখবেন, ভাবনার আগের ফ্রেম থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নতুন ফ্রেম বসাতে হবে, নাহলে আপনার মুক্তি নেই। কী বুঝলেন তো? আরে ভাই, পুরনোকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে তো হবে না, পৃথিবীতে কত কিছুই তো হচ্ছে, এগুলো নিয়ে ভাবা শুরু করুন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা শুরু করুন। দেখবেন, একটা সময় কষ্ট ফিঁকে হয়ে আসবে।


অতীতকে যেভাবে দেখছেন তা পাল্টে দিন

সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে, তাই বলে কী স্মৃতিরা চলে গেছে? মোটেই না। অতীত সম্পর্ক নিয়ে ভাবা, কষ্ট কষ্ট খেলা এক ধরনের বদঅভ্যাস। কী, এই কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল? ভাবছেন, আপনাকে নিয়ে ইয়ার্কি করা হচ্ছে। তা নয়। অনেক নিরাশাবাদী মানুষ আছেন যারা অতীতের দুঃখ নিয়ে পড়ে থাকতেই বেশি ভালবাসেন। এটা তাদের বদঅভ্যাস। এই বদঅভ্যাসের জন্য তাদের দীর্ঘ সাধনা দরকার। সেটার অন্য সমাধান আছে। আর আপনি যদি নিরাশাবাদী না হন, তাহলে অতীতের স্মৃতি মনে চলে আসলে ভাবুন ঐটা আপনার কল্পনা ছিল। আপনি ওগুলো সিনেমায় দেখেছেন, বাস্তবে নয়। হোক না মিথ্যা, সমস্যা থেকে যদি ভাল থাকা যায়। মনকে যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। মন বড় বোকা, হে।

বিবাহবিডি কল সেন্টারঃ +৮৮ ০১৯২২১১৫৫৫৫

মনে মনে প্রিয়ার ছবি আঁকুন

কী পাগল ভাবছেন। এতক্ষণ স্মৃতি ভুলে থাকতে বলে, এখন আবার বলছি প্রিয়ার ছবি আঁকতে, পাগল ছাড়া আর কী। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার বিষয়টা তো জানেন। এ পদ্ধতিটি আসলে সেরকমই। প্রথমে আপনি একটা দৃশ্যকল্প নিজের মনের মধ্য সেট করুন। চোখ বন্ধ করে দেখতে থাকুন আপনার ভালবাসার মানুষটি হাসছে, গাইছে, নাচছে, আপনার সঙ্গে খুনসুটি করছে। দেখতে বেশ ভালই লাগছে, তাই না। কিন্তু এ ভাললাগা তো বেশিক্ষণের নয়। একটু পরেই আসবে যন্ত্রণা। চিন্তা করবেন না। এবার দেখতে থাকুন আপনার ভাললাগার মানুষটি আপনার ওপর অযৌক্তিকভাবে রেগে যাচ্ছে, আপনি মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছেন তবু কমছে না। দেখতে থাকুন তার বদ অভ্যাসগুলো আর সেই সঙ্গে আপনার খাপ খাওয়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। ভাবুন আপনি একজন সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতা। আপনি আর আপনার ভাললাগার মানুষটি তাতে অভিনয় করছেন এবং দেখা দৃশ্যকল্পগুলো আপনার অভিনয় ও পরিচালনার মধ্য দিয়েই হচ্ছে। দেখুন তো আপনার অনুভূতিতে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা। পরের দৃশ্যগুলোর কারণে আগের দৃশ্যকল্পের রঙিন ছবিগুলো সাদা কালো হয়ে যাচ্ছে, তাই তো। হ্যাঁ, এটাই আপনার বাস্তব জীবনে হতো যদি আপনার সম্পর্ক ছেদ না হতো। রঙিন জীবন সাদা কালো হয়ে যেত। এভাবে দৃশ্যকল্প আঁকলে দেখবেন ভালবাসার বেগ কমে গেছে।

সম্পর্কের উল্টো দিকটা তলিয়ে দেখুন

একটা কথা সবসময়ই সত্য, এক হাতে তালি বাজে না। এটা মাথায় আপনাকে রাখতেই হবে। যে সমস্যাগুলোর জন্য আপনার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবুন। সমস্যাগুলো তো নিশ্চয় ছোট ছিল না, তাই না? সম্পর্ক টিকে থাকলে সে সমস্যাগুলো আরও সৃষ্টি হতে পারত। তাই যা হয়েছে, ভাল হয়েছে, এমনটাই ভাবুন। মনে রাখবেন, দুষ্টু গরুর চেয়ে যেমন শূন্য গোয়াল ভাল, তেমনি সমস্যা তথা জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে না থাকাই ভাল। তাহলে আর সারা জীবন পস্তাতে হবে না। সম্পর্কের এই উল্টোদিকটি ভেবে দেখুন। দেখবেন, পুরনো সম্পর্কটি নিয়ে আপনার মধ্যে আর আপসোস জাগবে না। বরং মনে হবে, বেঁচে গেছি। আর যদি পারিবারিক কারণে আপনি নিজেই সম্পর্ক ছেদ করে থাকেন, তাহলেও সেটাকে আত্মত্যাগ হিসেবেই নিন। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়, অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই একে স্বাভাবিক ধরে নিন। নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান। পরিবারের মানুষদের হাসিভরা মুখগুলোর কথা মনে করুন, দেখবেন আপনার কষ্ট অনেকটাই মনে যাচ্ছে।

নিজের দিকে তাকান

অনেক তো হলো, এবার নিজের দিকে তাকান। কান্নাকাটি অনেক করেছেন। আয়নায় নিজের চেহারাটি দেখুন। কী বিমর্ষ। চাঁদবদনের কী হাল করেছেন, দেখেছেন? এ কী সহ্য করা যায়! একটা কথা অপ্রিয় শোনায়, তবু চিরন্তন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আর কিছু বলতে হবে? অনেক স্মৃতি স্মৃতি খেলা খেলেছেন, এবার নিজের দিকে একটু নজর দিন। এই দেশ সমাজ, আপনার পরিবারের প্রতি আপনার অনেক দায়িত্ব, এভাবে ভাবুন না একবার। নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য আপনাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে, ভুলে যেতে হবে পুরনো স্মৃতি, এমন কথামালা আওড়াতে থাকেন। দেখবেন, আপনার ভেতর থেকে পুরনো স্মৃতি ভুলে নতুন করে বাঁচার তাগিদ সৃষ্টি হবে।

বিশ্বাস করুন আপনি আবারও প্রেমে পড়বেন

সময় বহমান, তাই তো? জীবনও বহমান। কারও জন্যই জীবন থেমে থাকে না। সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে যে আবার কোন সম্পর্ক হবে না, তা তো না। এমন কোন নিয়ম তো কোথাও নেই যে, জীবনে আপনাকে একবারেই ভালবাসতে হবে। আর এমনটাও নয় যে, আপনি অতীতের ভালবাসা ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারবেন না। কেউ যদি বলে থাকে, তবে হয় আবেগের বশে বলে নয় ডাহা মিথ্যা কথা বলে। নতুন কারও সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার চিন্তা করুন। বন্ধু খুঁজুন। পারলে বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গেই বন্ধুত্ব করুন। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব আপনার পুরনো স্মৃতিকে ভুলে যেতে সাহায্য করবে। আর প্রেম করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা।

হল্লার মাঝে ডুবে যান

দুঃখের সময় মানুষ যদি নিঃসঙ্গ থাকে, তখনই মানুষ বেশি কষ্ট পায়। স্মৃতিরা তাড়া করে ফেরে। এজন্য একাকী না থেকে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হৈহল্লায় মেতে উঠুন। জানি, মন সায় দেবে না। তবু বলছি, একটু মনে জোর এনেই আড্ডা দিতে যান। প্রয়োজনে বেশি সময় আড্ডা দিন। দেখবেন নির্মল আড্ডার মধ্যে দিয়েই আপনি ভুলে যেতে থাকবেন, পুরনো স্মৃতি। বন্ধুদের নিয়ে দূরে ঘুরে আসতে পারেন, পিকনিক করতে পারেন। কিংবা জড়িয়ে পড়তে পারেন সমাজসেবামূলক কাজে। আর ঘর থেকে বের হওয়ার অসুবিধা থাকলে বই পড়া শুরু করেন কিংবা লেখালেখি। যেভাবেই হোক নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার কষ্ট কমে যাচ্ছে। আপনি আবার ফিরে যাচ্ছেন স্বাভাবিক জীবনে।

দাম্পত্য সম্পর্কে ঈর্ষার প্রভাব!

সভ্যতার শুরু থেকে ঈর্ষার সূচনা।  আদিম নারী লিলিয়াৎ ও ইভের মধ্যে ছিল ঈর্ষার চোরা স্রোত।  ত্রিকোণ সম্পর্কের সেই ঈর্ষার ধারা আজো অব্যাহত আছে।  সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষেও মানুষের যেসব আদিম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, ঈর্ষা তারই একটি। ঈর্ষার কারণে মানুষের হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। যে কারণে মানুষ ঈর্ষার যুক্তিহীন দহনে পুড়ে মরে। আবার ঈর্ষাকে অনেকে বলেন সুমহতী। ঈর্ষাই নাকি উন্নতির ইন্ধন-আরোহণ রসায়ন। তবে যে ঈর্ষা হয়ে উঠতে পারত সৃষ্টির নিয়ামক, কখনো তাই হয়ে ওঠে সর্বনাশী।

ঈর্ষা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল এক অনুভূতি। দুজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে ঈর্ষার উৎপত্তি। পরের উন্নতি দেখে কাতর হওয়াই ঈর্ষা। এটা ব্যক্তিত্বের এক বিশেষ প্রকাশ। আবার পরের শ্রী দেখে ভালোলাগা বা মুগ্ধ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। একইভাবে অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে একাত্মবোধ করা। গাছের ফুল দেখলে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু যার গাছের ফুল এত সুন্দর তার কথা ভেবে ফুলটা খারাপ লাগাই ঈর্ষা।
নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেই ঈর্ষার জন্ম। নিজের যা নেই, অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই হিংসা, নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই ঈর্ষার উৎপত্তি। সম্পর্ক ভাঙনের আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষা।

ঈর্ষা গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ধ্বংসাত্মক ঈর্ষার উৎস অনেক ক্ষেত্রে বাবা, মা ও সন্তানের ত্রিকোণ সম্পর্কে লক্ষ করা যায়। সন্তান যখন বাবা-মাকে পুরোপুরি নিজের করে পায় না তখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। বাবা, মা ও গুরুজনদের থেকে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেকে গঠনমূলক কাজ করে অর্থাৎ ভাবে ওই কাজটা করলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা ব্যাহত হলে, অন্যের ক্ষতি করাটা মনে এলে তখন তাকে ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বলা যায়।

ঈর্ষার উৎস ও প্রকারভেদ: কেউ বলেন ঈর্ষা জিনঘটিত, কিছু অর্জন করার জন্য মানুষের মনে ঈর্ষা আসে। কিন্তু এ নিয়ে বিজ্ঞান এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। ঠিক কেমন করে কাজ করে মানুষের প্রবণতার পরম্পরা, তাও অনাবিষকৃত। ঈর্ষা ও জিনের সম্পর্ক যদি কখনো থাকেও, কোন প্রজন্মে তার প্রকাশ ঘটবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এর প্রকাশ নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। সত্যিকার অর্থে জিনের প্রকাশ এক প্রজন্মে হয় না। শারীরিক উপাদান ও পরিবেশের নানা উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে মানুষের একেকটা গুণ বা দোষের প্রকাশ ঘটে। অনেক সময় ঈর্ষা থেকে তুলনা ও অনুকরণ আসে। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো করতে না পারলে ঈর্ষার জন্ম হয়। মূলত অভাববোধ থেকেই মানুষের মনে ঈর্ষার জন্ম হয়। এ অভাববোধ যে কোনো প্রকারের হতে পারে। এটা ঠিক পার্থিব বস্তুর অভাব নয়, সুখের অভাব। মনে মনে সুখী হওয়াটা বড় কথা। আমাদের প্রত্যেকের আমিত্বের একটা গণ্ডি বা সীমানা আছে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাড়ি-গাড়ি, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমাদের জগৎ। এ আমিত্বের গণ্ডি যে ব্যক্তির যত সীমিত ততই তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব। এ অভাববোধ আমাদের মধ্যে অসম্পূর্ণতা নিয়ে আসে, যা ঈর্ষার জন্ম দেয়।

বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্রে দুটি জিনিস চোখে পড়ার মতো। প্রথমত, সাফল্যের প্রতি মানুষের একমুখী ধাববান গতি এবং দ্বিতীয়ত, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতামূলক বিরোধের সম্পর্ক। ধরেই নেয়া হয়, কোনো কাজে সাফল্যই একমাত্র লক্ষ্য আর সফলতা লাভে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে দরকার প্রতিযোগিতার মানসিকতা। এ অবস্থায় মানুষ তার ব্যবহারে হয়ে পড়ে যান্ত্রিক, দেখা দেয় পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা। ফলে নিরন্তর মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয় এবং মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তাড়াতাড়ি ছন্দ হারায়। আজকের হাইটেক যত উন্নতির পথে এগোবে, মানুষ ততই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার এ প্রবণতাকে সত্যিকার অর্থে ত্বরান্বিত করে ঈর্ষা।

ঈর্ষার উৎস ও প্রকারভেদ:  অর্থ, বিত্ত ও যৌনসংক্রান্ত বিষয় থেকেই যাবতীয় ঈর্ষার উৎপত্তি। এছাড়া ক্ষুধা থেকেও ঈর্ষা আসে। Hunger, Sex, Aggression are all basic instincts যেগুলো থেকেও ঈর্ষা জন্ম নেয়। ইতিহাসে দেখা যায়, নেফারতিতির বিবাহিত জীবন কিংবা গ্রিক দেবদেবীদের নিজেদের মধ্যেও এসবের অস্তিত্ব ছিল। আজকের সমাজে যে এত হানাহানি ও সংঘাত বেড়ে উঠছে তার মূলে রয়েছে সত্যিকার অর্থে ঈর্ষা।

ওথেলো সিনড্রম:  সাধারণত এ ধরনের ঈর্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে না। ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি মিথ্যা বিশ্বাসে ভুগতে থাকেন যে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ঠকাচ্ছে, সে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িত। মাদকাসক্তি অথবা যৌন অক্ষমতার ফলে এ মানসিকতা প্রকাশ পায়। সাইকিয়াট্রিস্টদের মতে, এ ধরনের জেলাসি এক ধরনের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি।  সেক্সুয়াল অবসেশনযুক্ত ওসিডি পুরুষদের বেশি হয় বলে অনেকে মনে করেন।

এ ধরনের জেলাসি বা ঈর্ষায় মনে রাখতে হবেঃ  জীবনে সবকিছু নিজের চাহিদামতো পাওয়া যায় না।পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কমিউনিকেশন ক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে।   মানসিক ও আবেগগত দিক থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে চেষ্টা করতে হবে। নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাব বুঝতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। অন্যের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঈর্ষান্বিত হওয়ায় লজ্জার কিছু নেই। ঈর্ষা না থাকা মহান কোনো ব্যাপার নয়। একা না থেকে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। অন্যের সঙ্গে আপনার ভাবনা ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

সিবলিং জেলাসি: এ শক্তিশালী ঈর্ষার উৎস মায়ের সঙ্গে থাকা দৃঢ় বন্ধন ও ভালোবাসা। দুটি সন্তানের মধ্যে বয়সের তফাৎ কম হলে প্রথম সন্তানের ঈর্ষা বেশি হয়। সাধারণত পাঁচ বছরের শিশু সবকিছুর জন্যই মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের স্কুল, খেলা ইত্যাদি নিয়ে বৃহত্তর জগৎ তৈরি হয়। তখন আর সন্তান বাড়ির ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না এবং তার ঈর্ষা কমে আসে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার উচিত ঈর্ষান্বিত সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা বেশি করে প্রকাশ করা।
সিবলিং জেলাসির ভালো দিক হচ্ছে এর মাধ্যমে সন্তান পরবর্তী জীবনে তার কর্মজগতে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয় তা মোকাবিলা করতে শেখে। মা-বাবা বিদ্বেষপূর্ণ ব্যবহারকে সহযোগিতামূলক আচরণে রূপান্তর ঘটাতে পারেন।

সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ঈর্ষা: সুখ-সমৃদ্ধির উপাদান সবাই অর্জন করতে চায়। যেমন মধ্যবিত্তের তিন ভাগ-উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন। এদের মধ্যে সব সময় লড়াই চলতে থাকে। এই ‘ক্লাস শিফটিং’ কীভাবে হয় তা যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে হিংসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তরণের সপৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা অবাস্তব হলেই ঈর্ষা বেশি মানসিক ক্ষতি করে। ব্যর্থতা ও অসমতা মেনে নিতে না পেরেও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হন। যেসব মানুষ সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না তারাও ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে আসে মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলার আপাতত তুচ্ছ ঘটনাও যার মধ্যে পড়ে। সমাজের মূল স্রোত থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের মধ্যেই এ প্রবণতা প্রবল। কারণ এ ক্ষেত্রে মমত্ববোধ কাজ করে না। বাণ মারা, তুক-তাক করাও ঈর্ষার সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রকাশ। সমাজে ইচ্ছা ও ক্ষমতা একসঙ্গে এসেছে। ঈর্ষা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই উপাদানেই তৈরি। আমরা কতটা স্বাভাবিক ও সুস্থ আছি, অর্থাৎ সুস্থতার মানসিক বোধ State of well bering নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। ঈর্ষানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে এ পারসপরিক সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আসে। আর তখনই হয় ক্ষতির সূচনা।  মাত্রাহীন পরশ্রীকাতরতায় মানুষের বাস্তববোধ কাজ করে না।

ঈর্ষা থেকে মুক্তির উপায়: শেক্সপিয়ারের উপমায় ঈর্ষা হলো গ্রিন আইভ মনস্টার।  এ সবুজ চোখের দানব খুবই শক্তিশালী। এর দানবীয় শক্তি মোকাবেলায় চাই অন্তরের সুপ্ত মানবিক বোধের বিকাশ।  ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা নিজের দায়িত্ব। বল্গাহীন সমাজে যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে।  এরাই ঈর্ষার শিকার।  ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন।  চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি। নিজের বোধ, বিবেচনা, বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এর জন্য নিজেকে পরিশীলিত ও বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। মূল কথা হচ্ছে বোধ ও বিবেচনা দিয়ে যে কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলে মনে ঈর্ষার কোনো জায়গা হতে পারে না।

ঈর্ষাজনিত যে দহন ও উৎকণ্ঠা তাতে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রমাগত ক্ষয় হয়।  ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে আমরা কর্মক্ষেত্রে যে শক্তি নিয়োগ করি তার অনেকটারই অপচয় হয় এ দহনজ্বালায়। এ শক্তিকে বেশি ক্ষয় না করে যদি কাজে নিয়োগ করা যায়, উৎপাদন শক্তিও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কারণ তখন প্রেরণা আসে অন্তরের সম্ভাবনাময় শক্তিপুঞ্জের জাগরণ থেকে, সতীর্থ কিংবা সহকর্মীর সাফল্যজনিত ঈর্ষার অন্তর্দহন থেকে নয়। কর্মের প্রকৃত লক্ষ্য সাফল্য বা উৎকর্ষতাকে যদি লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তখনই সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রতি সমভাব বজায় রাখা যায়। তখন প্রতিযোগী আর বাইরের কোনো সফল সতীর্থ বা সহকর্মী নয়, অতীতের আমিই তখন বর্তমান আমির প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যের প্রতি যদি সাময়িকভাবে ঈর্ষার ভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারি।

ঈর্ষা কখন আসে: মূলত হেরে যাওয়ার ভয় থেকে ঈর্ষার জন্ম।  আর পাঁচটা অনুভূতি বা আবেগের মতো ঈর্ষাও একটি মানসিক অবস্থা। তার বাহ্যিক প্রকাশ একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। যে ব্যক্তি ঈর্ষা করে তার মধ্যে একটা হীনমমন্যতা কাজ করে। যাকে সে ঈর্ষা করছে তার মতো হতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, গুরুত্ব না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের চোখে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিকে কীভাবে ছোট করা যায় তার নিরন্তর প্রচেষ্টাই এ হীনমমন্যতার জন্ম দেয়। ঈর্ষার নিজস্ব ডাইমেনশন রয়েছে। কেউ ভালো নাম্বার পেলে কম নাম্বার পাওয়া মানুষটি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এটা ঈর্ষার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যখন মানুষটি ভাবেন ওই নাম্বার তাকেও পেতে হবে তখন ঈর্ষা ইতিবাচক। ক্ষমতার পায়ে পায়ে ঈর্ষার চলাফেরা। ক্ষমতা মানে Passessione, যে ক্ষমতার জন্য মানুষ প্যারানয়েড (অবিরাম সন্দেহ আর অবিশ্বাস, ভ্রমবাতুলতার মনোরোগ) হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই রাজা-বাদশাদের যুগে প্রচুর গুপ্তহত্যার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঈর্ষার আরেকটি কারণ। তবে মুখ্য হলো ব্যক্তিগত হিংসা। নিজেকে মহান ভাবার বোধ, যাকে বলা হয় অস্বাভাবিক অহংমন্যতা, এর থেকেও আবার তৈরি হয় কূপমণ্ডুতা। এর উৎস নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা। তবে দুটি সমমেধা যদি একে অন্যের পরিপূরক হয় তবে তা গঠনমূলক, সেখানে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা নেই। কিন্তু এর মধ্যে আমিত্ব বড় হয়ে উঠলেই ঈর্ষার উদয় হয়। তবে সব ক্ষেত্রে তা হয় না, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সমানে সমানে। তাছাড়া সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে।   সব মানুষ কি ঈর্ষাপরায়ণ না, যে মানুষ যথাযথ আত্মসমীক্ষা, আত্মবিশ্লেষণ করতে পারেন তাদের ঈর্ষা কম হয়। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা আসে না। মনের প্রসারতা বাড়ালে ঈর্ষা কমে। সন্ন্যাসীর ঈর্ষা থাকে না। বিশেষণে কোনো একটা জায়গায় নিজেকে কম মনে হলে ঈর্ষা জন্মায়। ঈর্ষার পেছনে বুদ্ধি কাজ করে।  মানসিক প্রতিবন্ধীদের তাই কোনো ঈর্ষা থাকে না।

ঈর্ষা কিসের ওপর নির্ভর করে: সাইকোলজিতে ‘ওথেলো সিনড্রম’ বলে একটা কথা আছে। ওথেলো বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় নিজের স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। যার জন্ম হয়েছিল ঈর্ষা থেকে। এক পর্যায়ে ওথেলো স্ত্রীকে খুনও করেন। একে ‘প্যাথলজিক্যাল জেলাসি’ বলা হয়। ষড়রিপুর অন্যতম ‘মদ’ ঈর্ষাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। তবে ঈর্ষান্বিত হয়ে যদি কেউ সঠিক কাজ করে, যেমন পড়াশোনা আরো বাড়িয়ে দেয়া, তখন তো ‘অসুখী মনন’ নয়। সহকর্মীর পদোন্নতি কেউ কেউ ঈর্ষার চোখে দেখেন আবার কেউ কেউ মনে করেন ওটা অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে ঈর্ষার কোনো স্থান নেই।

ঈর্ষার পরিমাপ:  নিচের বাক্যগুলো পড়ুন! দেখুন তো কতটির সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন বা ‘হ্যাঁ’ বলতে পারছেন। তারকাযুক্ত বাক্যের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ হলে ঈর্ষাকাতরতা ‘কম’ বা ‘নেই’।  তারকা ছাড়া প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে ঈর্ষাকাতরতা বেশি।   এবার সব বাক্যের ক্ষেত্রে আপনার মতামত মিলিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আপনি ঈর্ষাকাতর কি না।

  • ছোটবেলায় মনে হতো আমার থেকে বশিরকেই সবাই ভালোবাসত।
  • ছোটবেলায় ভাইয়া যা চাইত তাই পেত; কিন্তু আমি পেতাম না।
  • বন্ধুর স্কুলব্যাগটা অনেক সুন্দর। তা দেখে আমার মন খারাপ হতো।
  • আমি বিশ্বাস করি, খুব বেশি পয়সা থাকলে মানসিক শান্তি থাকে না, তার চেয়ে পয়সা কম থাকাই ভালো।  আমার থেকে সহকর্মীর ওপর অফিশিয়াল ব্যাপারে বেশি নির্ভর করা হয়।  বেশির ভাগ সময় ভাইয়া আর আমি একই রকম রেজাল্ট করা সত্ত্বেও বাবা-মা ভাইয়ার প্রশংসাই করত সবার কাছে। আমার বোনের স্বামী দেখতে খুব সুন্দর, যদিও বোনকে তার পাশে মানায় না।
  • বন্ধুর দামি মোবাইল দেখে আমার খুব রাগ হয়।
  • আমার সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে কারণ যে মেয়েটিকে আমার ভালো লাগত তার সঙ্গে আমার বন্ধুর বিয়ে হয়েছে।
  • আপনার বাবা-মা যদি আপনার কোনো ভাই বা বোনকে আপনার চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাহলে কি কষ্ট পান?

ঈর্ষা এবং কল্পনা: বলা যায় ঈর্ষার সঙ্গে মানুষের কল্পনা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, স্বামীর জন্য বেল্ট কিনে এনেছেন স্ত্রী। স্বামীর সে সময় চাকরি নেই। দামি বেল্ট দেখে স্বামীর প্রশ্ন, কত দিয়ে কিনলে? চাকরি না থাকায় হীনমমন্যতায় ভুগতে থাকা ঈর্ষান্বিত স্বামী ভাবতে থাকেন স্ত্রী নিজের আর্থিক ক্ষমতা দেখাতে চাইছে। কল্পনার জাল বুনতে বুনতে সে সঙ্গে এটাও ভাবেন নিশ্চয়ই অন্য কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে, তাই তাকে বেশি খুশি রাখার জন্য এটা এক রকমের চেষ্টা। অথচ আসল ঘটনা কিন্তু খুবই সহজ। স্বামীর বেল্ট ছিঁড়ে গেছে দেখে স্ত্রী একটা বেল্ট কিনে এনেছেন।

ঈর্ষা এবং হিংসা :  ঈর্ষা সুযোগসাপেক্ষ। ঈর্ষার সঙ্গে এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকে, যার ফলে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি নিজেকেও ছোট মনে করেন। অন্যদিকে হিংসার মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক ভাব থাকে এবং হিংসা বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঈর্ষা মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে না, হিংসার ক্ষেত্রে তা সম্ভব। সম্পর্কের নৈকট্য ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক গঠনের ওপর। প্রতিটি ব্যক্তিসত্তা আলাদা, বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো, আলাদা চাহিদা যা সম্পর্ক-নিরপেক্ষ, সেখানে যখন আঘাত লাগে তখনই ঈর্ষার উদয় হয়। যে ব্যক্তি সব সময় নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় দেখতে চান তার ঈর্ষা বেশি। ঈর্ষা সম্পর্কের ক্ষতি করে। যেমন-স্ত্রীর সাফল্যে স্বামীর প্রাথমিক ভালোলাগা থাকলেও যে কোনো জমায়েত, অফিস পার্টি, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ক্রমাগত স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে শুনতে স্বামীর মধ্যে হীনমমন্যতা তৈরি হয়, স্বামী ঈর্ষান্বিত বোধ করেন, সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঠিক বিপরীত দিকে সফল স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর ঈর্ষা জন্ম নিতে পারে। ইচ্ছা আর হিংসা এ দুইকে এক চোখে দেখতে চান না মনস্তাত্ত্বিকদের একাংশ। আর সেখানেই ঈর্ষা হয়ে ওঠে আরোহণের ময়ূরকণ্ঠী লিপ্সা।

ঈর্ষার তত্ত্ব: ঈর্ষার দুটি মৌলিক তত্ত্ব ইভুলিউশনারি থিয়রি অব সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট থিওরি। বিবর্তনবাদ মতে, জেলাসি পারফর্মস অ্যান অ্যাকশন ইদ দি প্রিজার্ভেশন অব দি সিপশিস। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের সেক্সুয়াল ইনফিডেলটিতে বা অবিশ্বস্ত যৌন সম্পর্কের কারণে বেশি ঈর্ষান্বিত হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। মেয়েরা ছেলেদের ইমোশনাল ইনফিডেলটি বা আবেগজনিত অসততায় ভয় পান এবং ঈর্ষাবোধ করেন। তাদের যুক্তি হলো, যখন ছেলেরা মানসিকভাবে বিশ্বস্ত থাকে তখন তারা অন্য কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও তা হয় সাময়িক। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কের বিশেষণে দেখা যায় ভালোবাসা হারানোর ভয়; মনোযোগ হারানোর ভয় উভয়কেই তাড়া করে ফেরে। স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হলে স্ত্রীর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া সেটাই ঈর্ষা। সম্পর্কের মূল্য হারানোর দুঃখবোধ তাদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। স্বজন হারানোর দুঃখের থেকেও এ ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে ওঠে এক নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা। আমার যা ছিল তা অন্যের হয়ে যাচ্ছে-এ অনুভূতি বা অসহায়তা থেকেই ইমোশনাল বা আবেগজনিত জটিলতা তৈরি হয়। ঈর্ষা দুই রকম-স্বাভাবিক ঈর্ষা, অস্বাভাবিক ঈর্ষা। অস্বাভাবিক ঈর্ষা মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঈর্ষার প্রকৃত কোনো কারণ নেই। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সৌন্দর্য সম্পর্কে সবার প্রশংসায় হীনমমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। সন্দেহ শুরু হয় স্ত্রী যদি অন্যের হয়ে যান, এ হারানোর ভয় থেকে। যার ফলে অসময়ে অফিস থেকে এসে টেবিলে দুটি চায়ের কাপ দেখে ঈর্ষায় জ্বলতে থাকেন। ঈর্ষান্বিত হয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে শুরু করেন। স্ত্রী রাজি না হলে স্বামী মনে করেন, স্ত্রী অবশ্যই পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। তবে ঈর্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেই মানুষ এমন অপ্রকৃতিস্থ আচরণ করতে শুরু করে। সাধারণত আমাদের অন্তর্জগতে দুই রকম বৃত্তি কাজ করে-বুদ্ধিবৃত্তি (ইন্টেলিজেন্স) ও হৃদয়বৃত্তি (ইমোশন)। ঈর্ষার উৎস দ্বিতীয় বৃত্তি থেকে।

ঈর্ষা এবং ভালোবাসা:  সম্পর্ক গড়ার প্রথমদিকে নতুন দম্পতিদের মধ্যে ভালোবাসা থেকে ঈর্ষার মনোভাব দেখা যায়। নিজের আচরণের বিপরীতে সঙ্গীর মধ্যে কোনো রকম ঈর্ষার প্রকাশ না দেখে ধরে নেন তার সঙ্গী তাকে ভালোবাসে না। দখলদারিত্বের বিভিন্ন ধারণা থেকেই এ সমস্যার উৎপত্তি হয়। অনেক সময় এমনো দেখা যায়, পুরুষ সঙ্গীর ভালোবাসা পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে পার্টনার নানাভাবে ফ্ল্যাট (ফলমড়য়) করতে শুরু করেন। আসলে সম্পর্কের নিবিড়তায় যারা তৃপ্ত তাদের মধ্যে এ ধরনের ঈর্ষার জন্ম হয় না।

শিশুর ঈর্ষা :  ভালো পেনসিল বক্স, খেলনা, কানের দুল ইত্যাদি থেকেই সাধারণত শিশুদের ঈর্ষার শুরু হয়। শিশুরা চায় তার ভালোবাসার মানুষের ভাগ আর কেউ পাবে না। দেখা যায় ছোট শিশু মায়ের প্রিয় ফুলগাছগুলো ভেঙে ফেলেছে কারণ মা তাকে সময় না দিয়ে ওই গাছগুলোর যত্ন নেয়। একই মানসিকতা কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। স্বামী রোজ অফিসে বেরোনোর সময় তার পোষা টিয়াকে ছোলা খেতে দেন। যে কারণে দেখা যায় স্ত্রী বলছেন, পাখিটার গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে। সন্তান জন্মানোর পর অনেক সময় মানুষের ডিপ্রেশন হয়। স্বামীর কাছে ইম্পরটান্স হারানোর ভয় থেকেই এ অবসাদের জন্ম। মূলকথা যেসব মানুষ নিজেকে প্রাধান্য দেয় তারা সামান্য আঘাতেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে।

নবজাতকের প্রতি প্রথম সন্তানের ঈর্ষা, মা-বাবার করণীয়: 
প্রথম সন্তানের দৈনন্দিন রুটিনে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন ঘটাবেন না। তাকে যদি স্কুলে দিয়ে দিতে চান, নতুন শিশু আসার মাস দুয়েক আগেই তা করুন।   সব ব্যাপারে আগের অভ্যাস বজায় রাখুন, যেমন ঘুমানোর সময় গল্প বলা বা বই পড়ে শোনানো।   বড় হওয়ার ভালো দিকগুলো বোঝান।   দিনে অন্তত আধঘণ্টা সময় প্রথম সন্তানের জন্য আলাদা করে রাখুন।  নবজাতকের জন্য সে যদি আপনাকে সাহায্য করতে চায় তা করতে দিন।

    • প্রশংসা করুন।  কারণ ছাড়াই উপহার দিন।
    • কখনো ঈর্ষার ব্যাপারটি তার সামনে মুখ ফুটে বলবেন না।

ঈর্ষা সেসব মানুষের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে, যাদের মানসিক গঠন শক্তিশালী এবং ভারসাম্য আছে। এমন মানুষকে ঈর্ষা মোটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করে। ঈর্ষা যখন চরম আকার নেয়, হিংসার রূপ ধরে, তখনই মানসিক সমস্যা শুরু হয়। এ সময়ে মানুষ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়, ডিপ্রেশনে ভোগে, কখনো আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সব ব্যক্তিকে ক্ষতিকারক মনে করে। ক্ষতির জন্য ক্ষতি করা আর ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষতি করা কিন্তু এক নয়।  দুটি ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়। তাই ঈর্ষাকে চেনা জরুরি। জানা দরকার, ঈর্ষা নামের এ বহুরূপীর নানা মুখ ও মুখোশ। সে সঙ্গে জানা দরকার নিজের মনের আঁধার গহীনের সাদা-কালো ছবি। পড়ুন-চিনুন নিজেকে, অচেনা ‘আমি’ কে?

  • ঈর্ষা সম্পর্কিত কয়েকটি ধারণা
  • আমার সঙ্গী যদি প্রকৃত আমাকে ভালোবাসে তাহলে অন্য কাউকে সে চাইবে না।
  • আমার সঙ্গী যদি আমাকে নিয়ে খুশি থাকে, সঙ্গী হিসেবে আমি যদি যথার্থ হই, আমার সঙ্গী শুধু আমাকে নিয়েই তৃপ্ত থাকবে।
  • প্রেম দুর্লভ।
  • একজনের বেশি কাউকে ভালোবাসা অসম্ভব।
  • সম্পর্কে অমীমাংসিত নিরাপত্তার অভাব।
  • বিশ্বাসের সমস্যা।
  • সঙ্গীর স্বীকার করার সৎ সাহসের প্রতি অনাস্থা।
  • সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অনীহা।
  • ঈর্ষা ভালোবাসার উল্টো
  • ছেলেরা সঙ্গী হারানোর আশঙ্কায় ভোগে, মেয়েরা সম্পর্কের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে।
  • ছেলেরা ঈর্ষাবোধকে প্রকাশ করতে চায় না, তারা তাদের হীনমমন্যতাবোধ স্বীকার করতে চায় না। মেয়েরা অনুভূতি প্রকাশ করে নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়।
  • তীব্র আত্মসমমানবোধ আছে এমন মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হন না।
  • আত্মসমমানবোধ যাদের কম, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যারা ভোগেন তারা ঈর্ষান্বিত বেশি হন।
  • আপনার সঙ্গীর ঈর্ষা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক কীভাবে বুঝবেন?
  • আপনার সঙ্গী দিনের অধিকাংশ সময় বিষণ্ন থাকবে এবং যাকে ঈর্ষা করেন তার ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না।
  • সম্পর্ক খারাপ করার মতো কাজ করতে থাকেন।
  • সঙ্গীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন।
  • সঙ্গীকে অনুসরণ করা, ফোনে আড়ি পাতা, মোবাইলের এসএমএসের ওপর নজরদারি করা। বাইরে থেকে ফিরলে ব্যাগ, জামাকাপড় তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখা।