মানবিক সম্পর্ক

মানুষ সর্বদা দলবদ্ধ ও সামাজিক জীব। তাই আসঙ্গ লিপ্সা মানুষের আজন্মের অভিলাষ। একাকিত্বে মানুষের যন্ত্রনা অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং মানুষ ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ে। এজন্য মানুষ একের পর এক সম্পর্ক গড়তে থাকে। তবে সম্পর্কগুলি মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী নয়, মানুষ সম্পর্ক ভাঙ্গে আবার নতুন করে গড়ে তোলে। এভাবে ভাঙ্গা গড়ার স্রোতধারাই জীবনের বহমানতা এবং চির সত্য।

আসলে সম্পর্কগুলি বহতা নদীর মত, সে কখনও সুমধুর তালে বয়ে যেতে থাকে আবার মাঝে মাঝে বাঁক নেয়। তাই জীবনের ঘাঁটে ঘাঁটে এর পরিবর্তন সাধিত হয়। আবার কখনও নতুনত্বের বিচিত্র রূপ নিয়ে সে আপন গতিতে বয়ে চলে। এই বয়ে চলার মধ্যে কোন কোন ঘাঁটে থাকে সংস্কারের জোয়ার আবার কোন কোন ক্ষেত্রে জীবনের জোয়ার। আবার সম্পর্ক প্রবাহের বুকে কখনও সোনার তরী ভেসে বেড়ায় যেখানে তরিখানা অসংখ্য ধনে ভরে থাকে আবার কখনও সেখানে হতাশার ছবিচিত্র জেগে থাকে। এটা মানুষে মানুষে সম্পর্কের স্বাভাবিক রূপ। জন্ম থেকেই মানুষের জীবনের আকাশে সম্পর্কগুলি মেঘের মত এসে এসে জমা হতে থাকে, তার মধ্যে কোন সম্পর্কে কার আগ্রহ বেশি তা দিয়ে তৈরি হয় তাঁর জীবনের গল্প।

প্রথমে ঘর থেকেই সম্পর্কগুলির পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। তারপর বিশাল পৃথিবী জুড়ে মানুষের সম্পর্ক কখনও ভেঙ্গে যায় আবার কখনও জেগে থাকে। কারণ মানুষ সবার আগে পারিবারিক তারপর সামাজিক । তবে যে সম্পর্ক জেগে থাকে নতুন করে তার পরিবর্তন সাধিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি তার পরিবর্তন না ঘটে তাহলে সে মৃত হয়ে যায়, যে মৃত সম্পর্ক নিয়ে মানুষ চিরদিন ধরে বেঁচে থাকতে পারেনা। কারণ ক্রমাগত বদলের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান থেকে ভবিষ্যতে যায়। এই বদলের মধ্যেই থাকে সম্পর্ক ভাঙ্গা গড়ার মন্ত্র, আবার কখনও কখনও প্রয়োজন। জীবনের একটা সময় প্রায় সকল মানুষই পার করে যখন সম্পর্ককে সে স্বার্থের কারনে টিকিয়ে রাখে, আবার কখনও অভ্যাসের কারনে, কখনও কখনও মনুষ্যত্বের কাঁধে ভর করে রক্তের বন্ধনে সম্পর্ক টিকে থাকে।

কখনও কখনও মানব চরিত্রে মনুষ্যত্ব ও ভালবাসা দ্বৈত রূপে প্রকাশিত হয়। দেখা যায় মানুষের ভালোবাসার আকুতি দু-একটা সম্পর্কে থাকলেও অধিকাংশ সম্পর্কেই ভালোবাসা ক্ষণিকের জন্য জন্মে আবার তা আকস্মিক ভাবেই শেষ হয়েও যায়। তাই ভালবাসাহীন সম্পর্কের মাঝে থাকে লেফট রাইট করার প্রবণতা যা মানুষকে অনেকটা একঘেয়ে করে রাখে এবং সুযোগ পেলেই যে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। আবার কখনও তা জেগে থাকে  শুধুমাত্র মনুষ্যত্বের কারণে এই টিকে থাকা সম্পর্কের কোন কোন ক্ষেত্রে দায় থাকে কিন্তু দায়িত্ববোধ সেখানে অনুপস্থিত। এ থেকে প্রমাণিত হয় মানুষের ভালবাসার সম্পর্কটি গড়ে ওঠে ক্ষণিকের জন্য। যখন কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদী ভালোবাসায় আপ্লূত করে রাখে তখনই মানুষ হয়ে ওঠে অতিমানব।

মানুষের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করাই মানবিকতার লক্ষণ। তাই সম্পর্ক সবসময়ই মানবিক হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবই ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কের সোপান, সব সম্পর্কই ভাঙতে পারে আবার সব সম্পর্কই নতুন করে মানুষ গড়তে পারে। তবে সম্পর্কের একটি মেয়াদ থাকে। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন ও পরিবর্তিত রূপে মানুষ মানুষের কাছে আসতে সক্ষম, নাহলে মানবিক সম্পর্ক মরে যায়। মরে যাওয়া সম্পর্ককে কেউ নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে পারে না, কেবল পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই আবার মরে যাওয়া সম্পর্কটি নতুন প্রভাতের মত এসে মানুষের চোখে আলো দেয়, আশা দেয়। আসলে আমরা পরিবর্তনশীলতায় বিশ্বাসী। জীবন ও আশা পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল, যেখানে পরিবর্তন নেই সে জায়গাটি মানুষ বাদ দিয়ে সামনে চলে যায় অন্যকোনদিকে, যেখানে মানুষ পরিবর্তনের জোয়ার অনুভব করে। অপরিবর্তনীয় জায়গাটি অচলায়তনের মত একা পড়ে থাকে যাকে মানুষ কখনই কামনা করে না।

মানুষ আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। আশা সমাজ জীবনকে পূর্ণ করে তুলতে পারে। বেঁচে থাকার আশা জীবনকে করে গতিশীল, মোহময়। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার আকুতিই মানুষে মানুষে সম্পর্ক সৃষ্টির মহান উদ্দেশ্য। সম্পর্কগুলো আবর্তিত ও পরিবর্তিত হতে থাকে মানব সমাজের সাংস্কৃতিক নিয়মে। সম্পর্ক নানা কারণে পরিবর্তিত হতে পারে । যেমন বাংলাদেশে যে মেয়ের বিয়ে হয়না সে বাবার বাড়ির মমত্ব হারিয়ে ফেলে, কারণ বিয়ে হওয়া মানে তার প্রতিষ্ঠা পাওয়া। আর মেয়েটি প্রতিষ্ঠা পায়নি বলেই এই কঠিন সত্য তার সম্মুখে এসে হাজির হয়। যদিও ধীর গতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার নিয়মের পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু সব সমাজে সব দেশে এখনও এই নিয়ম বলবত আছে, মানে পরিবর্তন ঘটেনি। যে পরিবারটিতে তার জন্ম হয়েছিল সময়ের স্রোতে তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। সময় এবং সম্পর্ক একই সুত্রে ঘূর্ণয়মান, একে অতিক্রম করা যায়না। আর সম্পর্কের বাঁক এভাবেই ঘুরে মরে।

সম্পর্ক কখনও মধুর হয়, কখনও দ্বন্দ্বময় হয়, কখনও আধিপত্যময়, কখনও শত্রুতা মূলক হয়, আবার কখনও বন্ধুত্বের হাতছানিতে অসম্ভব সুন্দর হয়ে যায়। আধিপত্য মানব জীবনের এবং সম্পর্কের আর একটি বিষয়। মানুষ বেঁচে থাকার মধ্যে চায় একটি সুন্দর সম্পর্কের ভীত। পরিবার যদি আধিপত্য প্রধান হয় তবে বেঁচে থাকার মধ্যে সুখের বদলে তিক্ততা দর্শনীয় হয়ে ওঠে বেশি। আধিপত্যের রূপ বিভিন্ন ধারায় মানুষের মধ্যে বাসা বাঁধে। যেমন স্বামী আধিপত্য বিস্তার করে স্ত্রীর উপর। পিতা মাতা উভয়ের আধিপত্য সন্তানের উপর। সন্তানের আধিপত্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকটির উপর। অর্থাৎ সবল মানুষটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকটির উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। তবে এই আধিপত্য বিস্তারের মধ্যেও কখনও ভালবাসা থাকে যেমন সন্তানের প্রতি মানুষের ভালবাসা অমোঘ।

এভাবে যতদিন মানুষ একের উপর অন্যে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে ততদিনই সম্পর্ক একটি করে নাম নিয়ে টিকে থাকে। যখন সময়ের পরিবর্তনে একের প্রতি অন্যের আধিপত্য ম্লান হয়ে আসে তখন সম্পর্কটাও ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আধিপত্যও ফিকে হয় সময় ও জীবনের পরিবর্তনের সাথে, তারপর মানুষ দূরে সরে যেতে  থাকে। একে বলা যেতে পারে আধিপত্যময় সম্পর্ক।

গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এই আধিপত্যময় সম্পর্কের মধ্যে একটি স্বার্থের স্পষ্ট রেখা ফুটে থাকে। যে মানুষ কাউকে সম্পর্কের দ্বারা নির্ভরশীল করে রাখে সে আধিপত্যের মালিক, আর যে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য, সমাজের জন্য কারো উপর নির্ভর করে থাকে, তখনকার সময়ের জন্য সে অপেক্ষাকৃত দুর্বল। দুজনেরই সম্পর্কটা সেই সময়ের জন্য মূলত স্বার্থের কারনে টিকে থাকে।

স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক হয়না। যেমন মা বাবার সাথে মানুষের সম্পর্ক থাকে উভয়ের স্বার্থের সম্পর্ক। কথাটা শুনে অনেকেই চমকে যাবে। বলবে মা বাবার চেয়ে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক হয়না, এর মধ্যে কোন স্বার্থের ব্যাপার নেই, কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা দেখেছি বাবা মায়ের সন্তানদের মধ্যে যে বেশি প্রতিভাবান তাঁর প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। এটা স্বার্থের বহিঃপ্রকাশ, কারণ ঐ সন্তানটি তাঁদেরকে সমাজের প্রশংসা ও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। এক কথায় মা বাবা সন্তানকে লালান পালন করার কারণ হল নিজের ছায়া তারা সন্তানের মধ্যে দেখতে পায় এবং একটি শিশুকে মানুষ করে তোলার মধ্যে একটি নির্মল আনন্দ অনুভুব করে। এটা মানব সত্তার একটি বৈশিষ্ট্য এবং এক ধরণের স্বার্থ। আর সন্তান অসহায় অবস্থায় মা বাবার কাছে যে আশ্রয় পায় তেমন নির্ভরশীলতার আশ্রয় পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে একসময় নিজের জীবনের চাপে মা বাবা থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকে। তারপর এক সময় বাবা মার আবেদন ফুরিয়ে যেতে থাকে তখন কেবল ভালবাসা দিয়ে আর মানবতা দিয়ে অনেকেই সেই সম্পর্ককে সৌন্দর্য মণ্ডিত করে রাখতে পারেনা। এটা একধরনের স্বার্থপরতা।

সময় অনুসারে সম্পর্কের রূপের ভিন্নতা প্রকাশ পায়। এমনতর ভিন্নতাই বলে দেয় কোনটি মানুষের স্বার্থ আর কোনটি নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। নিঃস্বার্থ সম্পর্ককে খুঁজে মরা যায় কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না। হয়তো যেখানে পূর্ণ মানুষের বাস সেখানে পাওয়া যেতে পারে। যেমন মানুষ জানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শ্রেষ্ঠ, একে অন্যকে ছাড়া জীবনের পথে চলতে পারে না। এ সম্পর্কটি মূলত ভালবাসার সম্পর্ক। অথচ স্বার্থান্ধ মানুষেরা এটাকে প্রথার মধ্যে বেঁধে ফেলেছে। তাই স্বামীর আধিপত্য স্ত্রীর উপর এমন ভাবে বর্তে থাকে যা অনেক সময় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে না। স্ত্রীর বেঁচে থাকার স্বার্থ সেই সম্পর্কের মধ্যে নিহিত থাকে বলে স্ত্রী পায় স্বামীর কাছে সংসারে ভালভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। এই নিশ্চয়তা যদি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারে তাহলে বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় মানুষের সংস্কারগুলি পাল্টে যেতে থাকে আর ঘন ঘন বিবাহ বিচ্ছেদ দেখা দিতে থাকে। কারন তখন স্ত্রীকে আর স্বামী নামক প্রভুর দায় মেনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যা মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়, যেখানে স্বামীস্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্কের কোন দায় থাকেনা, আর সেখানেই পাওয়া যায় প্রকৃত সম্পর্কের বিষয়টি। আবার যে সম্পর্কগুলো নির্দ্বিধায় মৃত্যু পর্যন্ত টিকে থাকে সেখানে ভালবাসাও থাকে এবং স্বার্থও থাকে। ভালবাসা মানে একের প্রতি অন্যের প্রকৃত প্রেম ও নির্ভরতা বেশি থাকে, আর স্বার্থ মানে দুজন দুজনার কাছে এত অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তারা মনে করতে থাকে এত সহমর্মিতা হয়ত পৃথিবীর আর কোথাও নেই। যখন মানুষ একের প্রতি অপরে গভীর মমতা ও স্বচ্ছন্দ নির্ভরতার আবেদন অনুভব করে এবং একে অন্যের উপস্থিতি জীবনের জন্য অনিবার্য বলে মনে করতে থাকে তখন সম্পর্কটি হয়ে যায় সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অভিপ্রায়। তবে বিয়ের ভুমিবিস্তারে স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের সাথে পরবর্তী প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাই মূলত মানুষের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়, তাই ভালোবাসার সম্পর্কের চেয়ে দৈহিক সম্পর্কটাই হয়ে যায় মুখ্য। দেহকে ঘিরেই তখন ভালবাসা জন্ম নেয়। আসলে দৈহিক সম্পর্কই হল মানব সমাজ টিকিয়ে রাখার একটি ব্যবস্থা। মানব ধারা টিকে থাকার জন্যই মানুষের জৈবিক সম্পর্ক যা সকল যুক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিতে পৃথিবীতে টিকে থাকে এবং সমাজকে টিকিয়ে রাখে। তাই সম্পর্কটি জটিল হলেও এই সম্পর্কটি মানব সমাজের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আকাঙ্ক্ষিত।  বন্ধুত্ব একটা মধুর সম্পর্কের দিক নির্দেশক। যে সম্পর্কটি শুরু হয় সমমনা দুটি মানুষের একই রকম ভাবনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের ধারায় দুটি মানুষ আর সমমনা থাকেনা, বিভিন্ন কারণে বন্ধু দুজন এক সময় দুরকম ভাবতে শুরু করে। তখন বন্ধুত্বের সম্পর্কটি পানসে হয়ে যায় এবং তা ভেঙ্গে যেতে বাধ্য হয়। কারণ বন্ধুত্বের কংকাল বহন করা মানুষের কাছে ভীষণ ভাবে ওজন দায়ক ও অসহনীয় মনে হতে থাকে। মানুষ বিশ্বাস করে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্বার্থহীন সম্পর্ক। কখনও কখনও তা হলেও  সকল ক্ষেত্রে তা নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বার্থই হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের মুখ্য বিষয়। সে ক্ষেত্রে যতক্ষণ স্বার্থ থাকে ততক্ষণই সম্পর্ক থাকে তারপর অন্য কোথাও মানুষ বন্ধুত্বের হাতটি বাড়ায়। যার কারণে বন্ধুত্বের সম্পর্ক একসময় ভেঙ্গে যায় আবার নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এভাবে সম্পর্ক গুলি আপন গতিতে ও অস্তিত্বে একজন থেকে আর একজনে ক্রমাগত ভাবে প্রবাহিত হয়। এই সম্পর্ক প্রবাহকে মানব প্রবাহের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সম্পর্ক প্রবাহিত হয় বলেই পৃথিবীতে মানব ধারা টিকে আছে। পৃথিবীর মানব ধারার মধ্যে সম্পর্ক যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি স্বার্থও গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বার্থান্ধতা কোনক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটা দুর্বল মানুষের প্রতি সবল মানুষের অন্যায় করার অভিসন্ধি। যদি এক শ্রেণী ক্রমাগত লাঞ্ছিত হতে থাকে তাহলে সেখানে ধীরে ধীরে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে । মানুষে মানুষে শত্রুতার সম্পর্ক কখনও কাম্য নয়।

পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই মানবিক সম্পর্ক রক্ষা করতে হয়।  আর সম্পর্কের জন্যই মানুষের চরিত্রে মানবিকতা বেশি বেশি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে দুইপক্ষকেই মানবিক হতে হয় এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হতে হয়। একপক্ষ সম্পর্কের ব্যাপারে নির্বিকার থাকলে আর একপক্ষ সেই সম্পর্ককে ধরে রাখে না । মানুষের মধ্যে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে সম্পর্কটি নতুনত্ব পায়, কিন্তু যদি পরস্পরের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ না থাকে তখন মানবিক সম্পর্কটিও ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে। সম্পর্কগুলির সর্বদাই পরিচর্যা প্রয়োজন। পরিচর্যা ছাড়া কোন সম্পর্কই টিকে থাকতে পারেনা। পরিচর্যার মাধ্যমেই মানবিক সম্পর্ক টিকে থাকে। মানবিক সম্পর্কই  মানুষের একমাত্র সাধনা। নির্লিপ্ততা কোন সম্পর্কের ধারক নয়। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে মানুষের জীবন ধারার পরিবর্তন হয় এবং তার সাথে সাথে মানুষের সম্পর্কগুলোরও পরিবর্তন ঘটিয়ে সে বেঁচে থাকে। পরিবর্তন মানুষকে নেশার মত আকৃষ্ট করে। তাইতো আধুনিক জীবনের সম্পর্কগুলো পরিবর্তিত হয়ে সুন্দর ও মানবিক রূপ গ্রহণ করুক এটাই মানুষের কাম্য।

লিখেছেনঃ রোজানা নাসরীন, টরন্টো

প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা কি ও কত প্রকার

আপনি একজন কে ভালোবাসেন কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা কি তা আপনি নিজেই জানেন না। অথচ সে মানুষটি হতে পারে আপনার বান্ধবী, সহকর্মী, দুরের কেউ অথবা আপনার স্বামী বা স্ত্রী।  আপনি এই ফিচারটি পড়ে  আপনি আপনাদের মধ্যে সম্পর্কটির কোন পর্যায়ে রয়েছে সেটা খুব সহজেই বুঝতে সক্ষম হবেন এবং সম্পর্কটির মাঝে কিসের খাটতি রয়েছে তাও নিরুপম করতে পারবেন খুব সহজেই।   একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন প্রকৃত ভালোবাসা ও পরিপূর্ণ প্রেম আসুন সেটাই একটু আলোচনা করি যা আমাদের সারাজীবন কাজে লাগবে –

সাইকোলোজিষ্ট ষ্টার্নবার্গ  এর “ট্রায়াংগুলার থিওরী অফ লাভ”  এর মতে –

মানুষের ভালোবাসাকে একটি ট্রায়াংগেল বা  ত্রিভুজ আকারে ভাগ করেছেন যেখানে ৩ টি উপাদান থাকে যা হলো –

১) আবেগ আসক্তি বা আকর্ষন Passion
২) অন্তরঙ্গতা Intimacy
৩) প্রতিশ্রুতি Commitment

আর “ট্রায়াংগুলার থিওরী অফ লাভ”  অনুযায়ী ভালোবাসা ৮ প্রকারের হয়ে থাকে আসুন দেখি সেগুলো কি কি –

১) None Love – ভুমিকাহীন ভালোবাসা
– যে সম্পর্কে কোন আবেগ নেই, অন্তরঙ্গতা ও প্রতিশ্রুতি নেই সেই সম্পর্কে ভালোবাসার কোন ভূমিকাই নেই তাই হলো Non Love । যেমন – একজন অপর জনকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালবাসার প্রস্তাব দিলো অপরজন তা প্রত্যাখান করে ফিরিয়ে দিলো । যার ফলশ্রুতিতে যে যার মত নিজেদের গন্তব্যে ফিরে গেলো এটাই হলো ভুমিকাহীন ভালোবাসা বা None Love

২) Liking Love –  পছন্দের ভালবাসাঃ

এ ধরনের ভালোবাসার সম্পর্কে মধ্যে অন্তরঙ্গতা বা Intimacy আছে। এখানে অন্তরঙ্গতা বা Intimacy বলতে বুঝানো হচ্ছে দুজনেই পাশাপাশি সহবস্থান করে কিন্তু আবেগ বা কোন প্রতিশ্রুতি নেই এমন সম্পর্ক গুলো Liking Love হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যেমন – সহপাঠি বা সহকর্মীদের মাঝে অনেক সময় একে অন্যকে পছন্দ করে এক সাথে পড়ছে বা কাজ করছে প্রায়সই ভালো মন্দ অনেক কিছুই শেয়ার করছে কিন্তু তাদের মাঝে কোন প্রকার প্রতিশ্রুতি নেই।  আবার একটি সম্পর্ক গঠনের জন্য যে আবেগটুকু দরকার তাও নেই। শুধু অন্তরঙ্গতা Intimacy টুকুই রয়েছে এটাই Liking Love ।

৩) Infatuated love প্রফুল্লতম ভালোবাসা :
এই ধরনের ভালোবাসায় প্রচন্ড আবেগ Passion আসক্তি বা আকর্ষন কাজ করে অথচ অন্তরঙ্গতা এবং কোন প্রতিশ্রুতি নেই। এই ভালোবাসার ধরনটিকে বুঝাতে একটি কেইস ষ্টাডি উল্লেখ করা যাক –

একজন বিবাহিত নারী যার কিনা ৩ বছরের একটি সন্তান আছে, স্বামী চাকুরীতে ব্যস্ত থাকায় যথাযথ ভাবে স্ত্রীকে সময় দিতে পারেন না, হঠাৎ করেই ঐ মহিলার সাথে একজন ভদ্রলোকের ফোনে পরিচয় ঘটে। পুরুষটি অন্য শহরে থাকায় ফোনেই প্রতিদিন কথাবার্তা হয়। এভাবে কথা বলতে বলতে ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌছে গেলো এখন প্রতিদিন ঐ পুরুষটির সাথে ফোনে কথা না বললে তার ভালো লাগে না বরং অস্থিরতা কাজ করে। একসময় বাড়ির সবাই তা জেনে গেলে তার মোবাইলটি নিয়ে নেয়া হয়। তারপরও সে লুকিয়ে আরেকটি ফোন কিনে তার সাথে কথা চালিয়ে যেতে থাকে। এমন সম্পর্ক গুলোকেই বলা হয় Infatuated love বা প্রফুল্ল প্রেম যেখানে অন্তরঙ্গতা ও প্রতিশ্রুতি কোনটায় নেই অথচ আবেগ, আসক্তি বা আকর্ষণের পরিমানটা অনেক তীব্র।

৪) Empty Love শূন্য ভালোবাসাঃ
এই ভালোবাসার ধরনটি Infatuated love বা প্রফুল্ল ভালোবাসার ঠিক উল্টো এখানে অন্তরঙ্গতা আছে, প্রতিশ্রুতিও আছে কিন্তু একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা নেই, আসক্তি বা আকর্ষন নেই।। শূন্য ভালোবাসার একটা উদাহারন দেয়া যাক –

আগেকার দিনের মত এযুগেও এখনো কিছু বিয়ে হয় যারা আগে থেকে কেউ কাউকে চিনতো না, জানতো না – কিন্তু বিয়ে হয়েছে। তারমানে একসঙ্গে থাকতে হবে আমৃত্যু পর্যন্ত। এখানে একজন আরেকজন কে ভালো লাগছেনা, বনিবনা হচ্ছে না, মানসিক ও শারিরিক সম্পর্কেও কেউ কারো উপযুক্ত না অথচ এসম্পর্কে এসব ভাবারও কোন সুযোগ নেই। ব্যাপারটা এমন যে, বিয়ে হয়েছে মানেই সঙ্গী যেমনই হোক তার সাথেই বাকী জীবন কাটাতে হবে। এধরনের সম্পর্ক গুলো Empty Love শূন্য ভালোবাসার আওতাধীন।

৫) Romantic love রোমাঞ্চকর (ভাব বিলাসী) ভালোবাসাঃ   

রোমান্টিক ভালোবাসায় দুজনের মাঝে প্রবল আবেগ আসক্তি বা আকর্ষন থাকে আবার অন্তরঙ্গতা বা Intimacy ও থাকে । একে অন্যের সাথে অনেক কিছুই শেয়ার করে । দুজনের মধ্যে একে অপরের প্রতি যৌন আকর্ষণ ও উদ্দীপনাও থাকে কিন্তু যা থাকেনা যেটা হলো প্রতিশ্রুতি বা Commitment । যেহেতু এধরনের সম্পর্ক কিংবা ভালোবাসায় কেউ কারো সাথে প্রতিশ্রুতিবন্ধ নয় তাই এমন সম্পর্কে নতুন করে কারোজীবনে কেউ এলে – যদি তাকে ভীষন ভালোলাগে, তাহলে তারা যে যার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যায় কেননা এই ধরনের সম্পর্কে কোন প্রতিশ্রুতি বা Commitment একেবারেই থাকেনা।

৬) Companionate love সহচর ভালোবাসাঃ

এ ধরনের ভালোবাসা হলো অনেকটা বন্ধুর মত এখানে একে অন্যের সাথে সবকিছুই শেয়ার করে, একজনের প্রয়োজনে আরেকজনকে সবসময় পাশে পায়। যে কথাটাগুলো স্বামী বা স্ত্রীকে বলা যায়না সেটাও তার সাথেও শেয়ার করে। এ ধরনের সম্পর্কে একেবারেই আবেগ বা আকর্ষন থাকে না আবার অন্তরঙ্গতা বা Sexual Intimacy ও থাকে না । এইধরনের সম্পর্কগুলোই সহচর ভালোবাসা বা Companionate love ।

৭) Fatuous Love নিষ্ঠুর প্রেমঃ
এই ধরনের ভালোবাসায় একজন আরেকজনের সাথে কোন কিছুই শেয়ার করে না, এমন কি কথাও হয় না কিন্তু বড্ড আবেগ ও আকর্ষন বা আসক্তি কাজ করে।  আসক্তির পরিমান এতই বেশী থাকে যা থেকে মনে হতে পারে সারাজীবনের জন্য কেউ একজন বড্ড প্রতিশ্রুতিবন্ধ। প্রচলিত ভাষায় একতরফা ভালোবাসার মত একটা ব্যাপার। এখানে কোনধরনের অন্তরঙ্গতা Intimacy একেবারেই নেই। তাই প্রতিশ্রুতি Commitment এর তো কোন উদাহারনই আসেনা ।

৮) Consummate Love ভালোবাসা বা পরিপূর্ন প্রেমঃ

আমরা সবাই সাধারনত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালোবাসা বা পরিপূর্ন প্রেমটাই চাই।  বিশ্বখ্যাত সাইকোলোজিষ্ট ষ্টার্নবার্গ এর  ট্রায়াংগুলার থিওরী অফ লাভ এর মতে -একটি পরিপূর্ণ প্রেম ও ভালোবাসায় –

১) আবেগ ও আকর্ষন  ২) অন্তরঙ্গতা  ৩) প্রতিশ্রুতি  এই তিনটি উপাদানই সমান ভাবে থাকবে। এবং একজন আরেকজনের সুখে দুখে, সময়ে অসময়ে, সারা জীবন একে অন্যের পাশে থাকার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে এবং দুজনের মধ্যে বুঝাপড়ার ব্যাপারটাও চমৎকার ভাবে সন্নিবেশিত থাকবে।

সম্মানিত পাঠক আপনি এখন উপরে ৮ প্রকার ভালোবাসা ও সম্পর্কের বিভাজন থেকে আপনার সম্পর্কটি কোন ধাপে আছে সেটা সহজেই নিরুপম করতে পারবেন এবং সম্পর্কটির ভবিষ্যত নিয়ে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।  লেখাটি ভালো লাগলে অন্যকে জানাতে শেয়ার করুন ।  বিবাহবিডি ডট কম।