বাংলাদেশের বিয়ের সংস্কৃতি

বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বহু সংস্কৃতিতেই বিবাহ দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কিছু সংস্কৃতিতে বহুগামী বিবাহ ও কিছু সংস্কৃতিতে সমকামী বিবাহও স্বীকৃত। বিবাহের মাধ্যমে পরিবারের সূত্রপাত হয়। এছাড়া বিবাহের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বিবাহের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী (পতি)এবং নারীকে স্ত্রী (পত্নী) হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। স্বামী ও স্ত্রীর যুক্ত জীবনকে “দাম্পত্য জীবন” হিসাবে অভিহিত করা হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনী প্রথাও বটে। বিবাহবহির্ভুত যৌনসঙ্গম অবৈধ বলে স্বীকৃত এবং ব্যাভিচার হিসাবে অভিহিত একটি পাপ ও অপরাধ।
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশের বিয়ে বলতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বিয়ে ও এর আনুষঙ্গিক আচারকে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্র বিয়েকে “বিয়ে” কিংবা “বিবাহ” নামে সম্বোধন করা হলেও অঞ্চলভেদে আঞ্চলিকভাবে আরো বিভিন্ন উচ্চারণভঙ্গিতে ডাকা হয়, যেমন: বিয়্যা বা বিয়া (বিআ) কিংবা বিহা, হিন্দী ভাষার প্রভাব বা অনুকরণে শাদী। সিলেট অঞ্চলে কখনও বিয়েকে কটাক্ষ করে ডাকা হয় হেঙ্গা। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিয়ে একদিকে যেমন ধর্মীয় মিথস্ক্রীয়ায় পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষঙ্গ ধারণ করেছে, তেমনি এই নৃতাত্ত্বিক সার্বভৌম এলাকার লোকাচারও ধারণ করেছে। তবে সর্বক্ষেত্রেই বিয়ে মোটামুটি তিনটি মূল অংশ: গায়ে হলুদ, বিয়ে এবং বৌভাত বা ওয়ালিমা-তে বিভক্ত। তবে ধর্মভেদে এই অংশ বিভাজনে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

মুসলমানদের বিয়েতে বাড়িতে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয়। দুপক্ষের উপস্থিতিতে কাজি, বর-কনের সম্মতি জানতে চান এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে পুরোহিত মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ান, তারপর অগ্নিকে বায়ে রেখে তাকে ঘিরে সাতবার চক্কর দেয়ার মাধ্যমে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এছাড়া হিন্দুশাস্ত্রমতে “দৈব বিবাহ”ও হয়ে থাকে, যাতে কন্যার বাবা মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে মেয়েকে তার জামাতার হাতে তুলে দেন। বৌদ্ধ ধর্মেও মন্ত্র আউড়ে বিয়ে পড়ান বৌদ্ধ ভিক্ষু। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিয়ে হয় গির্জায়, ফাদারের উপস্থিতিতে। ফাদার, বাইবেল থেকে পাঠ করে দম্পতির সম্মতি জানেন, এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

বিশ্বের অনেক দেশেই বিয়ের অনুষ্ঠান একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের বিয়ে এক দিনেতো নয়ই, বরং কখনও এক মাসেও শেষ হয় না। বিয়ের মুখ্য আয়োজনই থাকে কমপক্ষে তিন কি চার দিনব্যাপী।

বাংলাদেশের বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানঃ

গায়ে হলুদঃ
গায়ে হলুদ হলো বিয়ের মূল অনুষ্ঠান বহির্ভুত একটি অনুষ্ঠান, যা সাধারণত বিয়ের আগে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির সূচনালগ্নে যদিও বর বা কনের গায়ে হলুদ দেয়ার অনুষ্ঠানই ছিল, কিন্তু সময়ের আবর্তনে অনুষ্ঠানটি এখন অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। একইসাথে এই অনুষ্ঠান, দেশের বাইরের অনেক সংস্কৃতিও ধারণ করতে শুরু করেছে।

বিয়েঃ
বিয়ের অনুষ্ঠানটিই বাংলাদেশের বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ এখানে অতিথির মতো উপস্থিত হোন। অনুষ্ঠানে বরপক্ষ পরিবার-পরিজন, নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে গঠিত বরযাত্রী নিয়ে উপস্থিত হন। সাধারণত অনুষ্ঠানে বর ও কনের জন্য আলাদা আলাদা স্থান থাকে। বর গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত আসনে আসীন হোন। মুসলমানদের বিয়েতে এসময় একজন কাজীর দ্বারা আক্বদ পড়ানো হয়। আক্বদ হলো বর ও কনের পারস্পরিক সম্মতি জানার সামাজিক প্রক্রিয়া। প্রথমে বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বিয়েতে কনের সম্মতি জানা হয় এবং পরে একই কাজীর দ্বারা বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বরের সম্মতি জানা হয়। এভাবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় ভোজনপর্ব। বিয়ের ভোজন শুরু করা হয় বরের ভোজন দিয়ে।

বরের জন্য এজন্য বিশেষভাবে আলাদা একটি বড় থালাতে খাবার সাজানো হয়, যাকে কোনো কোনো অঞ্চলে ছদরি (উচ্চারণ: সদ্‌রি) বলা হয়। এই থালাতে পরিবেশিত খাবার অধিকাংশ সময়েই অপচয় হয় এবং শ্রেফ সৌন্দর্যের জন্য পালন করা হয় এই রীতি। এছাড়া উপস্থিত বর ও কনেপক্ষের অতিথিদের জন্য আলাদাভাবে খাদ্য পরিবেশিত হয়। খাদ্য তালিকায় সাধারণত উচ্চক্যালরিযুক্ত খাবার থাকে, যেমন: পোলাও, মুরগির রোস্ট, কোরমা, কাবাব, রেজালা; মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে থাকে: দই, পায়েশ, জর্দা; হজম সহায়ক খাদ্যের মধ্যে থাকে বোরহানী ইত্যাদি। এছাড়া কোনো কোনো বিয়েতে সাদা ভাত, এবং কোমল পানীয়েরও ব্যবস্থা থাকে। বিয়ের ভোজন পর্ব শেষ হলে বরকে নিয়ে যাওয়া হয় কনের কাছে এবং দুজনকে একত্র করে বসানো হয়। সেখানে আরো কিছু আচার পালন শেষে আসে বিদায় পর্ব। কনেকে বরের হাতে তুলে দেন কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ, কনেকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন অনুষ্ঠানস্থল থেকে স্বীয় বাড়ি অভিমুখে। এসময় কনেপক্ষের মধ্যে অশ্রুসজল মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।

হিন্দুরীতির বিয়েতে অন্যান্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি মূল কার্যক্রম হয় সাতচক্কর বা সাতপাক। এজন্য মন্ডপের মধ্যিখানে একটি অগ্নিকুন্ড তৈরি করে বর ও কনে উভয়ের পরিধেয় কাপড়ের একটা অংশ একত্রে গিঁট দিয়ে নেন এবং আগুনকে ডানে রেখে সাতবার চক্কর দেন বা ঘুরে আসেন। এভাবেই বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

বৌভাত বা ওয়ালিমাঃ
বিয়ের অনুষ্ঠানের এক বা দুদিন পর বরপক্ষের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বৌভাত বা ওয়ালিমার অনুষ্ঠান। বৌভাতে, কনেপক্ষ তাদের নিকটাত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-পরিজনদের নিয়ে গঠিত দল নিয়ে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। কনেপক্ষের দল হলেও এই দলকেও বরযাত্রী বলা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বৌভাতেও বরপক্ষের অতিথিদের দাওয়াত দেয়া হয়।

বাংলাদেশের বিয়ের বিভিন্ন প্রথাঃ

যৌতুক বা পণ

বাংলাদেশের বিয়েতে যৌতুক বা পণ প্রথা বহু প্রাচীণ। শার্লি লিন্ডেনবম পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক ছিল আর তাই বিবাহযোগ্য পাত্রের আয়ের উৎস সচ্ছল ছিল না, অপরদিকে বিবাহযোগ্যা ফর্সা গুণবতী পাত্রী পাওযা যেত হাতেগোণা। তাই সেসময় পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষকে যৌতুক দিত। এই যৌতুক নগদ অর্থ কিংবা অলংকার কিংবা আসববাবপত্র যেকোনো রকম হতো। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কৃষিভিত্তিক মানুষ শহরমুখী হওয়া শুরু করে এবং পাত্ররা শহুরে হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে সচ্ছলতা অর্জন করতে শুরু করে। অপরদিকে পাত্রীরা আগের অবস্থানে থাকে, গ্রামেই থাকে। তাই পাত্রের কদর বেড়ে যাওয়ায় সেসময় থেকে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষকে পণ বা যৌতুক দেয়া শুরু হয়। কিন্তু একসময় শহরমুখী বিপুল জনগণের সবাই চাকরি পেলো না এবং মুষ্টিমেয় চাকরিপ্রাপ্ত পাত্রের দাম আরো বেড়ে গেলে যৌতুক প্রথা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হযে পড়লো।

প্রথমদিকে যখন কনেপক্ষকে যৌতুক দেয়া হতো, তখন শীতল পাটির বয়ন জানা পাইটা কুমারীরা যে যত প্রকারের বুনন শৈলী জানত, সে তত কুড়ি টাকা পণ পেত তার বিয়ের সময়। মণিপুরি সম্প্রদায়ে বিয়ের যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তাঁত, ববিন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বয়নসামগ্রী যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে, কেননা বংশানুক্রমে কোমরতাঁতের তাতী হচ্ছেন মেয়েরা।

পরবর্তিতে অবশ্য বাংলাদেশে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুক দেওয়া-নেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুক প্রায় সর্বত্র যৌতুক বা পণ নামে পরিচিত হলেও রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে যৌতুককে নাচারি বলা হয়।

 বিয়ের নাচঃ

বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে বর-কনেকে গোসল করানোর সময় একপ্রকার বিশেষ নাচের প্রচলন দেখা যায়। বর-কনেকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী নারীরা এ নাচের আয়োজন করে থাকেন। তারা ধান, দূর্বা, পান, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে বিয়ের নাচে অংশগ্রহণ করেন। এধরণের নাচে বিশেষ গানও প্রচলিত রয়েছে:

একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার‌যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনী
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনী।।

বাংলাদেশের বিয়ের আভরণঃ

পোষাক-পরিচ্ছদ

গায়ে হলুদের পোষাকে বরের ঐতিহ্যবাহী পোষাক হলো পাঞ্জাবী। সুতি পাঞ্জাবির প্রচলন অতীতকাল থেকে চলে এলেও অধুনা (২০১১) সুতির পাশাপাশি খাদি বা অ্যান্ডির প্রচলনও দেখা যায়। অধুনা পুরুষেরা পাঞ্জাবীর সঙ্গে ওড়না বা উত্তরীয় পরার চলও দেখা যায়। অতীতে পাঞ্জাবীর সঙ্গে সাধারণ ঢোলা পাজামা পরার রীতি দেখা গেলেও অধুনা চুড়িদার পাজামা এমনকি জিন্স পরার রীতিও লক্ষণীয়। পায়ে থাকে চটি জুতা।

কনের গায়ে হলুদের ভূষণে হলুদ শাড়ি-লাল পাড়ের প্রচলন যুগ-যুগান্তরের। অধুনা (২০১১) গায়ে হলুদে হলুদ, লাল, সবুজ, নীল, সাদা, বেগুনি ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় রঙের জামদানি শাড়ির প্রচলন লক্ষণীয়। কেউবা বৈচিত্র্য আনতে কাতান, গরদ কিংবা গ্রাফিক্যাল প্রিন্টের শাড়িও পরে থাকেন। চওড়া পাড়ের সুতি শাড়ি বহুযুগ থেকে আধুনিক যুগ অবধি বিরাজমান। কেউ কেউ সিল্ক এমনকি মসলিনও পরে থাকেন। অতীতে কুচি দেয়া ব্লাউজের প্রচলন থাকলেও অধুনা (২০১১) কামিজ কাটের ব্লাউজ, কন্ট্রাস্ট ব্লাউজের প্রচলন দেখা যায়। এছাড়াও শীতকালে অনুষ্ঠিত বিয়েতে ব্লাউজের সাথে কেউ কেউ লং জ্যাকেট পরে থাকেন। ব্লাউজের রং বিভিন্ন রকমের হতে পারে। অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে রয়েছে খোঁপার কাঁটা, বিছা, নুপুর; হাতে বটুয়া ইত্যাদি।

বিয়ের দিন বরের পোশাক সাধারণত হয় পাঞ্জাবি-পাজামা আর শেরওয়ানী। মাথায় একটা টুপি পরে তার উপর পাগড়ি পরে থাকেন বর। পায়ে থাকে মোজা আর নাগরা জুতা। পকেটে বা হাতে থাকে রুমাল। পাগড়ি কখনও পাঞ্জাবী ঢঙে বড় রঙীন কাপড় দিয়ে বানিয়ে নেয়া হয়, কখনও বাজার থেকে রেডিমেড পাগড়ি কিনে আনা হয়। পাগড়ি কখনও শ্রেফ সাদা কাপড়ের হয়, তবে অধিকাংশ সময়ই পাগড়ি হয় রঙীন, একাধিক রঙের সম্মিলন, আর থাকে চুমকি-জরির কারুকাজ। ইদানিং কোনো কোনো বিয়েতে বর, কাঁধে শাল কিংবা ওড়না রাখার রীতিও দেখা যায়। কনের বিয়ের পোষাক হলো রঙীন শাড়ি। বিয়ের দিন সাধারণত লাল শাড়ি পরিধান করা হয়, তবে ইদানিং লাল ছাড়াও বেগুনী, সবুজ, গোলাপী ইত্যাদি রঙের শাড়ি পরতেও দেখা যায়। শাড়ি হয় যথেষ্ট কারুকাজমন্ডিত: তার, কারচুপি, চুমকি, পুতি ইত্যাদির মিশ্রণে বেশ জমকালো হয়ে থাকে বিয়ের শাড়ি। শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট এবং জুতা পরিধান করে থাকেন কনে। বিয়ের সময় সাধারণত হাই হিল, সেমি হিল, কিংবা ফ্ল্যাট জুতা পরিধান করেন, তবে জুতাও শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরা হয়। অনেক সময়ই শাড়ির সাথে মিলিয়ে হাত-ব্যাগ হাতে রাখার প্রচলন দেখা যায়।

অলংকার

বিয়ের অলংকার মানেই স্বর্ণালংকার। কখনও স্বর্ণের দাম বেড়ে গেলে কুলিয়ে উঠতে না পারলে রূপা দিয়েও অলংকারের স্থান পূরণ করা হয়। অতিরিক্ত সামর্থের ভিত্তিতে কেউ ক্রিস্টাল বা হীরার অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও সামর্থের অভাবে কেউ কেউ ইমিটেশনের অলংকার কিংবা স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। গহনার মধ্যে টিকলি, টায়রা, বালা, কানের দুল, নাকের দুল, নোলক, গলার চেইন, গলার বড় গহনা, নেকলেস, আংটি, পায়েল, নুপুর ইত্যাদির বহুল প্রচলন লক্ষণীয়। পুরুষের জন্য সাধারণত হাতের আংটি এবং গলার চেইনের ব্যবহার দেখা যায়।

এছাড়াও বিয়ের উৎসবে ব্যবহৃত হয় ফুলের অলংকার, বিশেষ করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নারীর ভূষণ হয় ফুলেল অলংকার। অতীতে ফুলের অলংকারে সাধারণত গাঁদা এবং রজনীগন্ধা ব্যবহৃত হতো, কিন্তু অধুনা (২০১১) সবুজ, বেগুনি, গোলাপি আর সাদা ফুল দিয়ে সাজার রীতি লক্ষ করা যায়। এ ধরণের অলংকার তৈরিতে কাঁচা ফুল যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় শুকনো ফুলও। অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ক্রিসেনথিমাস আর বিভিন্ন রঙের অর্কিড। এছাড়া কোথাও ফুলের অলংকার তৈরিতে যোগ করা হচ্ছে মুক্তা, ক্রিস্টাল বা হীরা, পাথর আর বিভিন্ন ধরণের পুঁতি। ফুলের অলংকারের মধ্যে রয়েছে কানের দুল, মাথার টায়রা, টিকলি, রতনচুড়, আংটি, চেইন দিয়ে সংযুক্ত পায়ের পায়েল, গলার বিভিন্ন প্রকারের মালা, সীতাহার ইত্যাদি। এছাড়া তৈরি হয় কন্ঠ চিকও। ঢাকায় এধরণের ফরমায়েশি অংলকার তৈরি করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন বিপণী বিতান।

ভূষণঃ

বিয়ে উপলক্ষে বর-কনে উভয়েরই বিভিন্ন প্রকারের সাজসজ্জার সংস্কৃতি বিদ্যমান। তবে স্বভাবতই কনের সাজ এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। তাই এজাতীয় চাহিদা পূরণে শহরের পাশাপাশি মফস্বলেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পার্লার, যেখানে অর্থের বিনিময়ে কনেকে সাজানো হয়ে থাকে। পার্লারগুলোও গায়ে হলুদ-বিয়েভেদে ফেয়ার পলিশ, ওয়্যাক্সিং, থ্রেডিং, অ্যারোমা থেরাপিসহ বিভিন্ন প্রকার ত্বকচর্চা ও রূপচর্চার বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এমনকি নামী-দামি পার্লারে সাজানোর জন্য অনেক সময় কনেকে আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা লাগে। বিয়ের সাজ বিষয়ে পত্র-পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে থাকে, যেখানে কনের সাজের বিভিন্ন ধরণ, সাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ এমনকি দরদামেরও উল্লেখ থাকে। অতীতে বিয়ের সাজ বলতেই বোঝানো হতো লাল রঙের মেকআপ। কিন্তু অধুনা মেকআপ আর্টিস্টরা বিয়ের সাজে অতীতের লাল, হলুদ আর সোনালির সংস্রব কমিয়ে বিভিন্ন রঙের শ্যাডো ব্যবহার করে সাজানোর পক্ষপাতি। তবে সব যুগেই কনের চুলের সাজে খোঁপাই বেশি প্রাধান্য পায়; যদিও কেউ কেউ চুল বেণী করে তাতে ফুল এঁটে নেয়ার পরামর্শও দিয়ে থাকেন।

অতীতে গায়ে হলুদের আগে কিংবা পরে মেহেদি পরার রীতি ছিল বর-কনে উভয়ের জন্যই। অধুনা (২০১১) ছেলেরা মেহেদি কম পরলেও কনেরা আগের মতই হাত ভরে মেহেদির অলংকরণ করে থাকে। অতীতে মেহেদির নকশায় তেমন বৈচিত্র্য থাকতো না, সাধারণত হাতের তুলতে গোল সূর্য, আর আঙ্গুলগুলোর অগ্রভাগ প্যাঁচিয়ে বেশ কিছু মেহেদি পরার রীতি ছিল, এবং মেহেদি দিয়ে শ্রেফ হাতের পাতাই রাঙানো হতো। কিন্তু অধুনা মেহেদি দিয়ে হাতে বিভিন্ন নকশা করা ছাড়াও হাতের পাতার বাইরে কব্জি পর্যন্ত মেহেদি পরার রীতিও দেখা যায়। এমনকি অনেকে পাও মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে থাকেন। অতীতে কনের পা আলতা দিয়ে রাঙানোর রীতি থাকলেও মাঝখানে তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে, তবে অধুনা (২০১১) আবারও এই রীতি কনে মহলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

সাজসজ্জাঃ

বিয়ে বাড়ি সাজানোর জন্য অতীতে নানা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হতো। সেসময় কলাগাছ দিয়ে বাড়ির প্রধান ফটকে বড় তোরণ নির্মাণ করা হতো। কখনও সৌখিনতার মাপকাঠি অনুযায়ী বাড়ির যুবক বয়সীরা বাঁশ কেটে তা দিয়ে সুন্দর করে বেড়া তৈরি করে নকশাদার ফটক তৈরি করতেন। এছাড়া বাড়ি সাজানোর উপকরণ হিসেবে কাগজের ফালি বানিয়ে তা দিয়ে রিং তৈরি করে একপ্রকার কাগুজে-শিকল তৈরি করে তা দিয়ে বাড়ি সাজানো হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই আয়োজন বাড়ির গন্ডি ছাড়িয়ে ‘ডেকোরেটর’ নামক বাণিজ্যিক সংগঠনের হাতে ন্যাস্ত হয়েছে। সাধারণত ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের লোকজন বাড়ির প্রধান ফটকে বাঁশ ও রঙিন কাপড় দিয়ে একটি গেট বা তোরণ নির্মাণ করেন।

অলংকরণ শৈলীঃ

বিয়ে বাড়ির বিভিন্ন উপাদানে অলংকরণের রেওয়াজ বাঙালি সমাজে বহু প্রাচীণকাল থেকে লালিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে ঢাকনি সরা অলংকরণ করার রীতি প্রচলিত ছিল, আর সেসব ঢাকনি সরার মূল উপজীব্য হতো পদ্ম ও বিয়ের দেবতা[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্রজাপতি। বিয়ে উপলক্ষে অলঙ্কৃত “এয়োসরা”র উপরের অলংকরণে থাকে পেখম ধরা নৃত্যরত ময়ূর আর চারদিকে থাকে বৃত্তাকারে নৃত্যরত চৌদ্দজন বা ষোলজন কুমারী নারী। এছাড়া বিয়ে বাড়িতে আলপনা আঁকার রীতি আজ অবধি প্রচলিত। বিয়ের আলপনার মধ্যে বেশিরভাগই হয় বৃত্তাকার আর কেন্দ্রে থাকে পদ্ম, আর এই বৃহদাকৃতির পদ্ম-কেন্দ্রীক বৃত্তাকার আলপনায় ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চল ছাড়া সারা বিশ্বে স্বতন্ত্র। অবশ্য ইদানিং আলপনায় যুক্ত হয়েছে নানা রকমের মোটিফ। এছাড়া অতীতে বিয়ের সময় যে পিঁড়ি ব্যবহৃত হতো, তাতে নারী প্রত্যঙ্গ তথা উর্বরতার প্রতীকস্বরূপ আঁকা হতো ‘শতদল পদ্ম’। বিয়ের সামগ্রী বহন করার কুলার অলংকরণে থাকে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা কিংবা ফুল ও প্রতীকের নকশা। বিয়ের কাঁথার অলংকরণে কখনও রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে গোপীরা প্রায়শই বিবস্ত্র কিংবা অর্ধ্বউলঙ্গ অবস্থায় চিত্রীত হতেন।

বাংলাদেশের বিয়ের পক্ষসমূহঃ

বরপক্ষ

বাংলাদেশের বিয়ের ক্ষেত্রে বরের পক্ষ থেকেই সাধারণত বিয়ের প্রস্তাব, কনেপক্ষের নিকট পেশ করা হয়, তাই বরপক্ষ, বাংলাদেশের বিয়েতে একটি সক্রীয় অংশ। বরপক্ষ, বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে বৌভাত বা ওয়ালিমার আয়োজন করে থাকে। সাধারণত বিয়ের পর বরপক্ষের বাড়িতেই কনেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কনে ঐ বাড়িতেই আজীবনের জন্য বসত গড়েন।

কনেপক্ষ

কনেপক্ষ বা কন্যাপক্ষ, বাংলাদেশের বিয়েতে একটি নিষ্ক্রীয় অংশ। সাধারণত কনেপক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় না। তবে দেয়ার প্রয়োজন হলে সাধারণত ‘ঘটক’ নামক তৃতীয়পক্ষের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। গ্রামেগঞ্জে, এমনকি শহরাঞ্চলেও কনেপক্ষ অনেকটা কন্যাদায়গ্রস্থ বলে মনে হয়। কারণ অনেকক্ষেত্রেই যৌতুক নামক আপাতবিলুপ্ত একটি সংস্কৃতির নতুন সংস্করণ হিসেবে কনেপক্ষকে, বিয়ের সময় বিপুল পরিমাণ আসবাব-সম্পদ কনের সাথে দিয়ে দিতে হয় বরের বাড়িতে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে কনেপক্ষ যথেষ্ট স্পর্শকাতর। কারণ কোনো কারণে নির্ধারিত বিয়ে ভেঙ্গে গেলে ঐ কনের জন্য, এমনকি ঐ পরিবারের অন্য মেয়ের জন্যও বর পাওয়া বা নতুন বিয়ে ঠিক করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় নিজেদের স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় অনেক কনেপক্ষ। শহরাঞ্চলে এই প্রকোপ কম হলেও একেবারে অপ্রতুল নয়।

ঘটক

ঘটক মূলত একজন ব্যক্তি, যিনি বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন এবং বিয়েকে শেষাবধি সুসম্পন্ন করার জন্য পরিশ্রম করেন। ঘটকের এই কাজকে ঘটকালি বলা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সময় ঘটককে রায়বার বা আয়ভারও বলা হয়ে থাকে। ঘটকালি সবসময়ই একটা ব্যবসা নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে একটি সামাজিক বা পারিবারিক দায়িত্বও হয়ে ওঠে। যদিও অনেকে একে ব্যবসা হিসেবে নিজের পেশা করে নিয়েছেন। ঘটকালির কাজটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে ঘুরে করতে হলেও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অনেকেই ঘটকালির কাজটিকে ইন্টারনেটভিত্তিক করে নিচ্ছেন। যার ফলশ্রোতিতে এখন ঘরে বসেই নিদৃষ্ট ওয়েব সাইটে প্রোফাইল সাবমিট করে অন্যদের প্রোফাইল দেখে নিজেরাই সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বিয়ের প্রাথমিক যোগাযোগ স্থাপন করছেন।

One thought on “বাংলাদেশের বিয়ের সংস্কৃতি”

মন্তব্য করুন