সম্পর্কের সুখ দুখ

জানালার শিক ধরে আকাশ পানে চেয়ে আছে তামান্না। পড়ন্ত বিকেলে মেঘেরা বাহারী রঙ গায়ে মাখিয়ে ছোটাছুটি করছে। অপরূপ সে দৃশ্য। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে থেকেও তা দেখছে না তামান্না। কিংবা বলা চলে দেখতে পারছে না। পারবে কিভাবে, তার মন তো তার নিজের মাঝে নেই। উদাস মন মহাশূন্য ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে তার হারানো ঠিকানা। কিন্তু পাচ্ছে না। এ জন্য তামান্নার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। বুকের মাঝে কষ্ট যেন কামড়ে ধরছে। বার বার ঘুরে ফিরে একটি মুখ ভেসে আসছে হৃদয়পটে। আর সঙ্গে সঙ্গে ফাকা হয়ে যাচ্ছে বুক, ফিরে আসছে কষ্টগুলো। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ভালবাসার মানুষের সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কিন্তু বার বার ফিরে আসছে কাটানো মধুময় সে সময়গুলো আর সেই সঙ্গে ভালবাসা হারানোর কষ্ট। কোন কিছুতেই মন দিতে পারছে না সে। অথচ আর কিছুদিন পরেই তার পরীক্ষা। এখন কি করবে তামান্না? এরকম পরিস্থিতি তামান্নার মতো হাজারো তরুণ-তরুণীর। হৃদয় ভাঙ্গা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিশ্বখ্যাত সংবেশনবিদ (হিপনটিসট) পল ম্যাককেনা এবং মনোচিকিৎসক ড. হগ উইলবর্ন কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেই আলোকেই কিভাবে ভগ্ন হৃদয়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা তুলে ধরা হলো।

কষ্টকে মেনে নিন

যাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছেন, তার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে কষ্ট লাগাই স্বাভাবিক। কষ্ট না লাগলে বরং বলতে হবে আপনার ভালবাসায় খাদ আছে। তাই কষ্ট লাগবেই, এমনটা ভাবা শুরু করুন, দেখবেন কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে। মনে রাখবেন মানুষের জীবন সুখ-দুঃখ মিলেই। ভালবাসার রঙিন সময়টাতে সুখের ভেলায় চড়ে কল্পজগতে পাড়ি দিয়েছেন মহাসমুদ্র, বুনেছেন কতসহস্র স্বপ্ন তার ইয়ত্তা নেই। তাই বলে যে জীবন সবসময় একরকমভাবেই যাবে, তা তো নয়। এটা জীবনের ধর্মও নয়। রাতের অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করে কোন কিছু চিন্তা না করেই আপনি লাইটের সুইচ দেন, ঠিক তেমনি ভালবাসার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে অচেতনভাবেই আপনার মনে অতীতের স্মৃতি চলে আসবে আর তা আপনাকে পোড়াবে, ভেঙ্গেচুড়ে দিতে চেষ্টা করবে, এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিন। দেখবেন ধীরে ধীরে কষ্ট কমে যাবে।

পুরনো অভ্যাসগুলোকে পাত্তা দেবেন না

ভালবাসার সময়টাতে আপনাদের জানতে কিংবা অজানন্তে অনেক অভ্যাসই তৈরি হয়ে গেছে। এই অভ্যাসগুলোই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই না? এক কথায় বলব, ঝেড়ে ফেলুন। যে অভ্যাসগুলো আপনি সে সময়ে করেছেন, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। জানি কষ্ট হবে, কিন্তু কী আর করা। মাথায় কেউ আর আঙুল চালিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে না, আঙুলে আঙুলে কাটাকাটি খেলা আর হচ্ছে না। এরকম হাজারো রোমান্টিক কাজ, কত খুনসুটিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এখন তা পোড়াচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করুন, এগুলো নিতান্তই সে সময়কার অভ্যাস, এগুলো চিরন্তন নয়। সে সময় এগুলোতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলে এখনও যে তা করতে হবে এমনটা তো নয়, এভাবেই ভাবা শুরু করুন। দেখবেন অভ্যাসগুলোর শূন্যতা আপনাকে আর পীড়া দিচ্ছে না। ও, আর হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই দুঃখবাদী রোমান্টিক গান শুনবেন না। এটা আপনার পোড়ামনের জ্বালা না কমিয়ে শতগুণ বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সম্পর্ক ভাঙ্গার পর বেশিরভাগ মানুষই দুঃখের গান শোনে। না, একদমই না। আপনি মোটেও এ ধরনের গান শুনবেন না।

পরিবর্তন আনুন ভাবনায়

প্রেমময় সময়ে কত কিছুই না চিন্তা করেছেন ভাললাগার মানুষটিকে নিয়ে। কত স্বপ্নই না বুনেছেন। এখন ছাড়ুন তো এসব। অনেক হয়েছে, এবার ভাবনা থামান। ভাবনায় ভাললাগার মানুষটি বার বার চলে আসলেও মাথা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে ফেলুন। দেখুন তো অন্য কোন কিছু ভাবা যায় কিনা। যেমন ধরুন, আপনি আপনার চারপাশের পরিবেশ, মানুষ, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারেন। মনে রাখবেন, ভাবনার আগের ফ্রেম থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নতুন ফ্রেম বসাতে হবে, নাহলে আপনার মুক্তি নেই। কী বুঝলেন তো? আরে ভাই, পুরনোকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকলে তো হবে না, পৃথিবীতে কত কিছুই তো হচ্ছে, এগুলো নিয়ে ভাবা শুরু করুন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা শুরু করুন। দেখবেন, একটা সময় কষ্ট ফিঁকে হয়ে আসবে।


অতীতকে যেভাবে দেখছেন তা পাল্টে দিন

সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে, তাই বলে কী স্মৃতিরা চলে গেছে? মোটেই না। অতীত সম্পর্ক নিয়ে ভাবা, কষ্ট কষ্ট খেলা এক ধরনের বদঅভ্যাস। কী, এই কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল? ভাবছেন, আপনাকে নিয়ে ইয়ার্কি করা হচ্ছে। তা নয়। অনেক নিরাশাবাদী মানুষ আছেন যারা অতীতের দুঃখ নিয়ে পড়ে থাকতেই বেশি ভালবাসেন। এটা তাদের বদঅভ্যাস। এই বদঅভ্যাসের জন্য তাদের দীর্ঘ সাধনা দরকার। সেটার অন্য সমাধান আছে। আর আপনি যদি নিরাশাবাদী না হন, তাহলে অতীতের স্মৃতি মনে চলে আসলে ভাবুন ঐটা আপনার কল্পনা ছিল। আপনি ওগুলো সিনেমায় দেখেছেন, বাস্তবে নয়। হোক না মিথ্যা, সমস্যা থেকে যদি ভাল থাকা যায়। মনকে যা বোঝাবেন তাই বুঝবে। মন বড় বোকা, হে।

বিবাহবিডি কল সেন্টারঃ +৮৮ ০১৯২২১১৫৫৫৫

মনে মনে প্রিয়ার ছবি আঁকুন

কী পাগল ভাবছেন। এতক্ষণ স্মৃতি ভুলে থাকতে বলে, এখন আবার বলছি প্রিয়ার ছবি আঁকতে, পাগল ছাড়া আর কী। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার বিষয়টা তো জানেন। এ পদ্ধতিটি আসলে সেরকমই। প্রথমে আপনি একটা দৃশ্যকল্প নিজের মনের মধ্য সেট করুন। চোখ বন্ধ করে দেখতে থাকুন আপনার ভালবাসার মানুষটি হাসছে, গাইছে, নাচছে, আপনার সঙ্গে খুনসুটি করছে। দেখতে বেশ ভালই লাগছে, তাই না। কিন্তু এ ভাললাগা তো বেশিক্ষণের নয়। একটু পরেই আসবে যন্ত্রণা। চিন্তা করবেন না। এবার দেখতে থাকুন আপনার ভাললাগার মানুষটি আপনার ওপর অযৌক্তিকভাবে রেগে যাচ্ছে, আপনি মান ভাঙ্গানোর চেষ্টা করছেন তবু কমছে না। দেখতে থাকুন তার বদ অভ্যাসগুলো আর সেই সঙ্গে আপনার খাপ খাওয়ানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। ভাবুন আপনি একজন সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতা। আপনি আর আপনার ভাললাগার মানুষটি তাতে অভিনয় করছেন এবং দেখা দৃশ্যকল্পগুলো আপনার অভিনয় ও পরিচালনার মধ্য দিয়েই হচ্ছে। দেখুন তো আপনার অনুভূতিতে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা। পরের দৃশ্যগুলোর কারণে আগের দৃশ্যকল্পের রঙিন ছবিগুলো সাদা কালো হয়ে যাচ্ছে, তাই তো। হ্যাঁ, এটাই আপনার বাস্তব জীবনে হতো যদি আপনার সম্পর্ক ছেদ না হতো। রঙিন জীবন সাদা কালো হয়ে যেত। এভাবে দৃশ্যকল্প আঁকলে দেখবেন ভালবাসার বেগ কমে গেছে।

সম্পর্কের উল্টো দিকটা তলিয়ে দেখুন

একটা কথা সবসময়ই সত্য, এক হাতে তালি বাজে না। এটা মাথায় আপনাকে রাখতেই হবে। যে সমস্যাগুলোর জন্য আপনার সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবুন। সমস্যাগুলো তো নিশ্চয় ছোট ছিল না, তাই না? সম্পর্ক টিকে থাকলে সে সমস্যাগুলো আরও সৃষ্টি হতে পারত। তাই যা হয়েছে, ভাল হয়েছে, এমনটাই ভাবুন। মনে রাখবেন, দুষ্টু গরুর চেয়ে যেমন শূন্য গোয়াল ভাল, তেমনি সমস্যা তথা জটিলতাপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে না থাকাই ভাল। তাহলে আর সারা জীবন পস্তাতে হবে না। সম্পর্কের এই উল্টোদিকটি ভেবে দেখুন। দেখবেন, পুরনো সম্পর্কটি নিয়ে আপনার মধ্যে আর আপসোস জাগবে না। বরং মনে হবে, বেঁচে গেছি। আর যদি পারিবারিক কারণে আপনি নিজেই সম্পর্ক ছেদ করে থাকেন, তাহলেও সেটাকে আত্মত্যাগ হিসেবেই নিন। জীবনের প্রয়োজনে মানুষকে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়, অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই একে স্বাভাবিক ধরে নিন। নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান। পরিবারের মানুষদের হাসিভরা মুখগুলোর কথা মনে করুন, দেখবেন আপনার কষ্ট অনেকটাই মনে যাচ্ছে।

নিজের দিকে তাকান

অনেক তো হলো, এবার নিজের দিকে তাকান। কান্নাকাটি অনেক করেছেন। আয়নায় নিজের চেহারাটি দেখুন। কী বিমর্ষ। চাঁদবদনের কী হাল করেছেন, দেখেছেন? এ কী সহ্য করা যায়! একটা কথা অপ্রিয় শোনায়, তবু চিরন্তন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। আর কিছু বলতে হবে? অনেক স্মৃতি স্মৃতি খেলা খেলেছেন, এবার নিজের দিকে একটু নজর দিন। এই দেশ সমাজ, আপনার পরিবারের প্রতি আপনার অনেক দায়িত্ব, এভাবে ভাবুন না একবার। নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য আপনাকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে, ভুলে যেতে হবে পুরনো স্মৃতি, এমন কথামালা আওড়াতে থাকেন। দেখবেন, আপনার ভেতর থেকে পুরনো স্মৃতি ভুলে নতুন করে বাঁচার তাগিদ সৃষ্টি হবে।

বিশ্বাস করুন আপনি আবারও প্রেমে পড়বেন

সময় বহমান, তাই তো? জীবনও বহমান। কারও জন্যই জীবন থেমে থাকে না। সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে বলে যে আবার কোন সম্পর্ক হবে না, তা তো না। এমন কোন নিয়ম তো কোথাও নেই যে, জীবনে আপনাকে একবারেই ভালবাসতে হবে। আর এমনটাও নয় যে, আপনি অতীতের ভালবাসা ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারবেন না। কেউ যদি বলে থাকে, তবে হয় আবেগের বশে বলে নয় ডাহা মিথ্যা কথা বলে। নতুন কারও সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার চিন্তা করুন। বন্ধু খুঁজুন। পারলে বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গেই বন্ধুত্ব করুন। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব আপনার পুরনো স্মৃতিকে ভুলে যেতে সাহায্য করবে। আর প্রেম করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা।

হল্লার মাঝে ডুবে যান

দুঃখের সময় মানুষ যদি নিঃসঙ্গ থাকে, তখনই মানুষ বেশি কষ্ট পায়। স্মৃতিরা তাড়া করে ফেরে। এজন্য একাকী না থেকে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে হৈহল্লায় মেতে উঠুন। জানি, মন সায় দেবে না। তবু বলছি, একটু মনে জোর এনেই আড্ডা দিতে যান। প্রয়োজনে বেশি সময় আড্ডা দিন। দেখবেন নির্মল আড্ডার মধ্যে দিয়েই আপনি ভুলে যেতে থাকবেন, পুরনো স্মৃতি। বন্ধুদের নিয়ে দূরে ঘুরে আসতে পারেন, পিকনিক করতে পারেন। কিংবা জড়িয়ে পড়তে পারেন সমাজসেবামূলক কাজে। আর ঘর থেকে বের হওয়ার অসুবিধা থাকলে বই পড়া শুরু করেন কিংবা লেখালেখি। যেভাবেই হোক নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার কষ্ট কমে যাচ্ছে। আপনি আবার ফিরে যাচ্ছেন স্বাভাবিক জীবনে।

তরুণদের বিয়ে ভীতি

পুরুষের বিয়ে ভীতি। শুনতে নিশ্চয়ই অবাক করার মত কথা। হ্যাঁ, আজকাল তরুণদের একটা বড় অংশের বিয়ে ভীতি রয়েছে। আর এই বিয়ে ভীতির কারণ অর্থ-বিত্তের অভাব, বেকারত্ব, শারীরিক অসুস্থতা, পাত্রী অপছন্দ, নতুন জীবনে পদার্পণ বা দাম্পত্য আতংক এসব কিছুই নয়। বিয়ে ভীতিতে আক্রান্ত তরুণ-যুবকদের বৃহত্তর অংশ মনে করে তাদের জীবন শেষ হয়ে গেছে। তারুণ্য-যৌবনে শরীরের ওপর অত্যাচার-অবিচার, ক্ষেত্রবিশেষে মাদক সেবন এবং নারীর সংস্পর্শে এলে নিজের নিষ্ক্রীয়তার অভিজ্ঞতা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌনজীবন নিয়ে ভুল ধারণা এবং মানসিক সমস্যা এবং কিছু কিছু মেয়েদের অতিরিক্ত জ্ঞান তরুণদের বিয়ে ভীতির প্রধান কারণ। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যা নেই তা বলা যাবে না। তবে ডাক্তারদের চেম্বারে আসা বিয়ে ভীতিতে আক্রান্ত তরুণদের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগেরই কোন শারীরিক সমস্যা নেই। গত ছয়মাসে আমার চেম্বারে আসা বিয়ে ভীতিতে আক্রান্ত শতাধিক তরুণ ও যুবকের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় শতকরা ৮০ ভাগের কোন ধরনের শারীরিক সমস্যা নেই।

শতকরা ৫ ভাগের প্রয়োজনীয় কিছু হরমোনের ঘাটতি রয়েছে যা চিকিৎসাযোগ্য, শতকরা ১০ ভাগের শরীরে প্রয়োজনীয় শুক্রাণুর অভাব রয়েছে (আলগেস পাকিস), শতকরা ২/৩ ভাগের শরীরে কোন শুক্রাণু নেই (অ্যাজোসপারসিযঅ)। এছাড়া শতকরা যে ২০ ভাগের কিছু কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা অন্ততঃ ৫ ভাগের যৌন সমস্যা (ইম্পোর্টেন্স) রয়েছে। এ তথ্য আন্তর্জাতিক গবেষণা তথ্যের সঙ্গে সঙ্গাতিপূর্ণ। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশের তরুণরা অধিক সুঠাম ও সক্ষম। তবুও তরুণদের বিয়ে ভীতি কেন। এসব তরুণদের কাছে চেম্বারে আমি পাঁচটি প্রশ্ন করে থাকি। কেমন করে তারা বুঝতে পেয়েছে তারা ফুরিয়ে গেছে বা শারীরিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের এই ধারণার পিছনে কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে কি? শারীরিক শক্তি ফিরিয়ে কোন ওষুধ সেবন করেছে কি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণ-যুবকদের বিচিত্র সব জবাব, অভিজ্ঞতা, এসব তুলে ধরার কোন ইচ্ছা আমার নেই। এছাড়া রোগীর গোপন তথ্য প্রকাশ মেডিক্যাল এথিকস অবমাননার পর্যায়ে পড়ে। তাই এসব নিয়ে দীর্ঘ বর্ণনার কোন ইচ্ছে নেই। তবে এ কথাটি সত্য, তরুণদের বিয়ে ভীতির কারণের পিছনে যেমন অজ্ঞতা, মানসিক সমস্যা এবং তরুণদের একটি বড় অংশের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেতিবাচক হওয়ায় (যার শতকরা ৯৯ ভাগ বিয়ের পর ঠিক হয়ে যায়) বিভ্রান্তি বাড়ছে। পাশাপাশি একশ্রেণীর তথাকথিত যৌন সমস্যা চিকিৎসক নামধারীদের অজ্ঞতা এবং ভুল চিকিৎসার কারণে তরুণদের যৌন ভীতি বেড়ে যাচ্ছে। বিয়ে করেনি এমনসব তরুণদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেক্স স্টিমুল্যান্ট ট্যাবলেট দেয়া হয়। ফলে এসব তরুণরা মনে করে তাদের নিশ্চয়ই যৌন সমস্যা রয়েছে। এতে তরুণদের সাময়িক শারীরিক ফিটনেস বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এমনকি একাধিক তরুণ অকপটে শিকার করেছেন ডাক্তারের দেয়া যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করে অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। এসব বিয়ে ভীতি বা যৌন ভীতিতে আক্রান্তদের বেশির ভাগের প্রায় একই মন্তব্য যতদিন ট্যাবলেট সেবন করেন ততদিন ভালো থাকেন। ওষুধ সেবন শেষ তো সবশেষ। অথচ এসব তরুণের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগই শারীরিকভাবে সুস্থ এবং কেবলমাত্র যথাযথ কাউন্সিলিং করতে পারলে কোন প্রকার যৌন উত্তেজক ওষুধ ছাড়াই তরুণদের বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব।

এ প্রসঙ্গে আমি আগেও বলেছি শুধু বাংলাদেশের তরুণদেরই বিয়ে ভীতি এবং যৌন ভীতি বেশি। এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দেবো। আমি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চর্ম ও যৌন রোগের ওপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার সময় সিঙ্গাপুর ডিএসসি ক্লিনিকে কিছুদিন অবজারভার হিসেবে প্রশিক্ষণ নেই। প্রচুর বাংলাদেশী তরুণ আসতো এ ক্লিনিকে। সিঙ্গাপুর ডিএসসি ক্লিনিক বাংলাদেশের যেকোন প্রাইভেট হাসপাতালের চেয়ে বড় কেবলমাত্র যৌন রোগীদের চিকিৎসা করা হয় এই ক্লিনিকে। আমি দেখেছি সিঙ্গাপুরে চাকরিরত বাংলাদেশী তরুণরাও নানা ভুল ধারণার কারণে নানা ধরনের যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এসব তরুণের অনেকেরই যৌন জীবন নিয়েও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। কয়েকমাস আগে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। হাসপাতালের অন্যতম চিকিৎসক ডাঃ শক্তির সঙ্গে আমার পূর্ব নির্ধারিত মিটিং ছিল। তিনি একাধিকবার আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যা হোক, ডাঃ শক্তি যৌন সমস্যার রোগীদের চিকিৎসা করেন। বাংলাদেশ থেকে বেশকিছু রোগী যায় ব্যাংকক হাসপাতালে। ডাঃ শক্তি আমাকে প্রায় একই রকম তথ্য দিলেন। বাংলাদেশী রোগীদের শারীরিক বা যৌন সমস্যার চেয়ে মানসিক সমস্যাই বেশি।

থাক এসব কথা। তরুণদের বিয়ে ভীতি আসলে মোটেও শারীরিক সমস্যার কারণে হয় না। যৌবনে অধিকাংশ পুরুষই কিছু অনাকাঙ্খিত অভ্যাসের শিকার হয়। এর জন্য শরীরের যৌন শক্তি শেষ হয়ে যাবে এটা নিতান্তই ভুল ধারণা। শরীরে যৌন শক্তি নামে আলাদা কোন শক্তি নেই। শারীরিক সুস্থতা, সুঠাম দেহ, মানসিক প্রশান্তি থাকলে এবং পরস্পরের সুন্দর সম্পর্কও সমঝোতা থাকলে প্রাত্যহিক জীবনের অন্যসব কাজের মত দাম্পত্য জীবনও সুখের হতে পারে। তাই বিয়ে ভীতির কারণে তরুণদের যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট সেবন করা উচিত নয়। এছাড়া এজন্য অযথা ডাক্তারের চেম্বারে যাবারও কোন দরকার নেই। তবে বিয়ের পর যদি কোন শারীরিক সমস্যা থাকে এবং এ কারণে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি হওয়ার আশংকা তৈরি হয় তখন যেকোন সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন। যদি ছোটখাটো শারীরিক সমস্যা থেকে থাকে তা আবশ্যই চিকিৎসায় ভালো হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা-ওষুধ ছাড়াই কাউন্সিলিং তরুণদের বিয়ে ভীতি দূর এবং বিবাহ পরবর্তী জীবন সুন্দর হতে পারে।

লেখকঃ ডাঃ মোড়ল নজরুল ইসলাম,
চুলপড়া, যৌন সমস্যা ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এবং লেজার এন্ড কসমেটিক্স সার্জন

কোনো ভুল ছিল কি! এমন প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে?

দ্বিধান্বিত মনের কারণে পড়াশোনা ও নিজের জীবনে যেন সময় দিতে পারছেন না দুজনে। হতাশা ভর করে সময় গুনে যাচ্ছেন ।  যেকোনো সম্পর্কের শেষের সময়টুকুতে আমরা ভেঙে পড়ি। দোষ-ত্রুটি আর ব্যর্থতাকে ধারণ করে জীবনকে অবসাদময় করে তুলি, যা আসলে ঠিক নয়। সম্পর্কচ্ছেদে মন খারাপ হতেই পারে, কিন্তু সেই মন খারাপ কখনোই দীর্ঘ সময় ধরে রাখা যাবে না। নিজের  জীবন বিকাশের জন্য সামনে পা বাড়াতে হবে। আপনি যদি নিজের মনকে বুঝতে পারেন, তাহলে যেকোনো দ্বিধা কাটিয়ে সামনে যেতে পারবেন। সম্পর্কচ্ছেদ নিয়ে বেশ কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখা উচিৎ।

দোষ-ত্রুটি নিয়ে ভাববেন নাঃ

সম্পর্কচ্ছেদের পরে আমরা সবচেয়ে বেশি ভাবি কার দোষ কিংবা কে দায়ী। মনের সঙ্গে লড়াই করে আমরা ব্যর্থতার জন্য কারণ খুঁজে বের করি। নানা কারণেই সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু তাই বলে দোষ-ত্রুটি খুঁজে নেতিবাচক আচরণ করবেন না। দোষ-ত্রুটি মনে আসতে পারে, তা কাটিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই কিন্তু জীবন।

এগিয়ে যেতে হবেঃ

যত দিনের সম্পর্ক থাকুক না কেন, কিংবা যত গভীর সম্পর্ক থাকুক না কেন, আপনাকে এগোতেই হবে। আপনি যদি অতীতের কথা ভাবতে থাকেন, তাহলে আরও বেশি হতাশাগ্রস্ত হবেন, কষ্ট পাবেন। রাতের পর রাত জেগে অতীতের সুন্দর সময়ের কথা ভাবলে আপনি আপনার বর্তমানকে নষ্ট করবেন। বর্তমান নষ্ট হলে কি আর দারুণ ভবিষ্য তৈরির সুযোগ থাকে, বলুন।

নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া থাকতে হয়ঃ

সম্পর্কচ্ছেদ মানেই কিন্তু ব্যর্থতা নয়। নিজের মনের সঙ্গে কথা বলুন। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন। এমন অবস্থায় আপনিই কিন্তু আপনার সবচেয়ে বড় সহায়। সম্পর্ক ভেঙে নিজেকে অপরাধী কিংবা দোষী ভেবে নিজেকে ছোট ভাবা ঠিক নয়। জীবনে অন্য সব সাফল্য-ব্যর্থতার মতোই সম্পর্কচ্ছেদকে ভাবুন।

ক্ষমা করতে শিখুনঃ

বিচ্ছেদের পর আমরা নিজেকে ক্ষমা করি না, নিজেই যেন নিজের শত্রু হয়ে যাই। আবার যে মানুষটিকে ভালোবাসতাম, তাকেও অপরাধী হিসেবে কল্পনা করতে থাকি, যা মোটেও ঠিক নয়। ওপাশের মানুষটিকে ক্ষমা করে, নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে নতুন করে সামনে পা বাড়াতে শিখুন।

নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে শিখুনঃ

বিচ্ছেদের পরে নিজেকে একাকী ভাবা শুরু করি আমরা। বন্ধুবান্ধব ও পরিবার থেকেও বেশ দূরে সরে যাই। এ সময়টায় নিজেকে নতুন করে চেনার চেষ্টা করুন। অতীতের গোলকধাঁধায় নিজেকে আটকে রাখবেন না। নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করুন।

নিজেকে শ্রদ্ধা করুনঃ

সম্পর্ক বিচ্ছেদের পরে নিজেকে ছোট আর দুর্বল মনে হয়। এটা কখনো ভাববেন না। জীবনে ব্যর্থতা আসবেই, নিজেকে কখনো অসম্মান করবেন না।

দৃঢ় চিন্তা করতে শিখুনঃ

সম্পর্ক থাকাকালীন ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা ভাবি আমরা, আর বিচ্ছেদ হলেই বিরহ। সম্পর্কের সমীকরণ ভেঙে গেলেও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনবেন না। সব সময় ইতিবাচক ও সৃজনশীল ভাবনায় মনকে ব্যস্ত রাখুন।

দাম্পত্য সম্পর্কে ঈর্ষার প্রভাব!

সভ্যতার শুরু থেকে ঈর্ষার সূচনা।  আদিম নারী লিলিয়াৎ ও ইভের মধ্যে ছিল ঈর্ষার চোরা স্রোত।  ত্রিকোণ সম্পর্কের সেই ঈর্ষার ধারা আজো অব্যাহত আছে।  সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষেও মানুষের যেসব আদিম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে, ঈর্ষা তারই একটি। ঈর্ষার কারণে মানুষের হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। যে কারণে মানুষ ঈর্ষার যুক্তিহীন দহনে পুড়ে মরে। আবার ঈর্ষাকে অনেকে বলেন সুমহতী। ঈর্ষাই নাকি উন্নতির ইন্ধন-আরোহণ রসায়ন। তবে যে ঈর্ষা হয়ে উঠতে পারত সৃষ্টির নিয়ামক, কখনো তাই হয়ে ওঠে সর্বনাশী।

ঈর্ষা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু জটিল এক অনুভূতি। দুজনের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে ঈর্ষার উৎপত্তি। পরের উন্নতি দেখে কাতর হওয়াই ঈর্ষা। এটা ব্যক্তিত্বের এক বিশেষ প্রকাশ। আবার পরের শ্রী দেখে ভালোলাগা বা মুগ্ধ হওয়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ঘটনা। একইভাবে অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও দুঃখে দুঃখী হওয়া হচ্ছে কারো সঙ্গে একাত্মবোধ করা। গাছের ফুল দেখলে ভালো লাগতেই পারে। কিন্তু যার গাছের ফুল এত সুন্দর তার কথা ভেবে ফুলটা খারাপ লাগাই ঈর্ষা।
নিজের যা আছে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকেই ঈর্ষার জন্ম। নিজের যা নেই, অন্যের আছে তা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই হিংসা, নিরাপত্তাবোধের অভাব থেকেই ঈর্ষার উৎপত্তি। সম্পর্ক ভাঙনের আশঙ্কায় অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়াও ঈর্ষা।

ঈর্ষা গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে। ধ্বংসাত্মক ঈর্ষার উৎস অনেক ক্ষেত্রে বাবা, মা ও সন্তানের ত্রিকোণ সম্পর্কে লক্ষ করা যায়। সন্তান যখন বাবা-মাকে পুরোপুরি নিজের করে পায় না তখনই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। বাবা, মা ও গুরুজনদের থেকে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য অনেকে গঠনমূলক কাজ করে অর্থাৎ ভাবে ওই কাজটা করলে ভালোবাসা পাওয়া যাবে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা ব্যাহত হলে, অন্যের ক্ষতি করাটা মনে এলে তখন তাকে ধ্বংসাত্মক ঈর্ষা বলা যায়।

ঈর্ষার উৎস ও প্রকারভেদ: কেউ বলেন ঈর্ষা জিনঘটিত, কিছু অর্জন করার জন্য মানুষের মনে ঈর্ষা আসে। কিন্তু এ নিয়ে বিজ্ঞান এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। ঠিক কেমন করে কাজ করে মানুষের প্রবণতার পরম্পরা, তাও অনাবিষকৃত। ঈর্ষা ও জিনের সম্পর্ক যদি কখনো থাকেও, কোন প্রজন্মে তার প্রকাশ ঘটবে, তা আগে থেকে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এর প্রকাশ নির্ভর করে পরিবেশের ওপর। সত্যিকার অর্থে জিনের প্রকাশ এক প্রজন্মে হয় না। শারীরিক উপাদান ও পরিবেশের নানা উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে মানুষের একেকটা গুণ বা দোষের প্রকাশ ঘটে। অনেক সময় ঈর্ষা থেকে তুলনা ও অনুকরণ আসে। কিন্তু এগুলো ঠিকমতো করতে না পারলে ঈর্ষার জন্ম হয়। মূলত অভাববোধ থেকেই মানুষের মনে ঈর্ষার জন্ম হয়। এ অভাববোধ যে কোনো প্রকারের হতে পারে। এটা ঠিক পার্থিব বস্তুর অভাব নয়, সুখের অভাব। মনে মনে সুখী হওয়াটা বড় কথা। আমাদের প্রত্যেকের আমিত্বের একটা গণ্ডি বা সীমানা আছে। বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, বাড়ি-গাড়ি, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আমাদের জগৎ। এ আমিত্বের গণ্ডি যে ব্যক্তির যত সীমিত ততই তার মধ্যে নিরাপত্তার অভাব। এ অভাববোধ আমাদের মধ্যে অসম্পূর্ণতা নিয়ে আসে, যা ঈর্ষার জন্ম দেয়।

বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্রে দুটি জিনিস চোখে পড়ার মতো। প্রথমত, সাফল্যের প্রতি মানুষের একমুখী ধাববান গতি এবং দ্বিতীয়ত, মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতামূলক বিরোধের সম্পর্ক। ধরেই নেয়া হয়, কোনো কাজে সাফল্যই একমাত্র লক্ষ্য আর সফলতা লাভে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে দরকার প্রতিযোগিতার মানসিকতা। এ অবস্থায় মানুষ তার ব্যবহারে হয়ে পড়ে যান্ত্রিক, দেখা দেয় পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা। ফলে নিরন্তর মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয় এবং মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তাড়াতাড়ি ছন্দ হারায়। আজকের হাইটেক যত উন্নতির পথে এগোবে, মানুষ ততই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠার এ প্রবণতাকে সত্যিকার অর্থে ত্বরান্বিত করে ঈর্ষা।

ঈর্ষার উৎস ও প্রকারভেদ:  অর্থ, বিত্ত ও যৌনসংক্রান্ত বিষয় থেকেই যাবতীয় ঈর্ষার উৎপত্তি। এছাড়া ক্ষুধা থেকেও ঈর্ষা আসে। Hunger, Sex, Aggression are all basic instincts যেগুলো থেকেও ঈর্ষা জন্ম নেয়। ইতিহাসে দেখা যায়, নেফারতিতির বিবাহিত জীবন কিংবা গ্রিক দেবদেবীদের নিজেদের মধ্যেও এসবের অস্তিত্ব ছিল। আজকের সমাজে যে এত হানাহানি ও সংঘাত বেড়ে উঠছে তার মূলে রয়েছে সত্যিকার অর্থে ঈর্ষা।

ওথেলো সিনড্রম:  সাধারণত এ ধরনের ঈর্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকে না। ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি মিথ্যা বিশ্বাসে ভুগতে থাকেন যে তার ভালোবাসার মানুষ তাকে ঠকাচ্ছে, সে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িত। মাদকাসক্তি অথবা যৌন অক্ষমতার ফলে এ মানসিকতা প্রকাশ পায়। সাইকিয়াট্রিস্টদের মতে, এ ধরনের জেলাসি এক ধরনের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি।  সেক্সুয়াল অবসেশনযুক্ত ওসিডি পুরুষদের বেশি হয় বলে অনেকে মনে করেন।

এ ধরনের জেলাসি বা ঈর্ষায় মনে রাখতে হবেঃ  জীবনে সবকিছু নিজের চাহিদামতো পাওয়া যায় না।পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কমিউনিকেশন ক্ষমতা বাড়াতে চেষ্টা করতে হবে।   মানসিক ও আবেগগত দিক থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে চেষ্টা করতে হবে। নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অভাব বুঝতে হবে, নিজেকে ভালোবাসতে হবে। অন্যের সদিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে। ঈর্ষান্বিত হওয়ায় লজ্জার কিছু নেই। ঈর্ষা না থাকা মহান কোনো ব্যাপার নয়। একা না থেকে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে। অন্যের সঙ্গে আপনার ভাবনা ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

সিবলিং জেলাসি: এ শক্তিশালী ঈর্ষার উৎস মায়ের সঙ্গে থাকা দৃঢ় বন্ধন ও ভালোবাসা। দুটি সন্তানের মধ্যে বয়সের তফাৎ কম হলে প্রথম সন্তানের ঈর্ষা বেশি হয়। সাধারণত পাঁচ বছরের শিশু সবকিছুর জন্যই মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের স্কুল, খেলা ইত্যাদি নিয়ে বৃহত্তর জগৎ তৈরি হয়। তখন আর সন্তান বাড়ির ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না এবং তার ঈর্ষা কমে আসে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার উচিত ঈর্ষান্বিত সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা বেশি করে প্রকাশ করা।
সিবলিং জেলাসির ভালো দিক হচ্ছে এর মাধ্যমে সন্তান পরবর্তী জীবনে তার কর্মজগতে যে ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হয় তা মোকাবিলা করতে শেখে। মা-বাবা বিদ্বেষপূর্ণ ব্যবহারকে সহযোগিতামূলক আচরণে রূপান্তর ঘটাতে পারেন।

সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক ঈর্ষা: সুখ-সমৃদ্ধির উপাদান সবাই অর্জন করতে চায়। যেমন মধ্যবিত্তের তিন ভাগ-উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন। এদের মধ্যে সব সময় লড়াই চলতে থাকে। এই ‘ক্লাস শিফটিং’ কীভাবে হয় তা যদি লক্ষ করা যায় তবে দেখা যাবে হিংসা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উত্তরণের সপৃহাকে বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা অবাস্তব হলেই ঈর্ষা বেশি মানসিক ক্ষতি করে। ব্যর্থতা ও অসমতা মেনে নিতে না পেরেও কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হন। যেসব মানুষ সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না তারাও ঈর্ষার শিকার। ঈর্ষা থেকে আসে মানুষের অসামাজিক আচার-আচরণ। বাগানের ফুল ছিঁড়ে ফেলার আপাতত তুচ্ছ ঘটনাও যার মধ্যে পড়ে। সমাজের মূল স্রোত থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের মধ্যেই এ প্রবণতা প্রবল। কারণ এ ক্ষেত্রে মমত্ববোধ কাজ করে না। বাণ মারা, তুক-তাক করাও ঈর্ষার সংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক প্রকাশ। সমাজে ইচ্ছা ও ক্ষমতা একসঙ্গে এসেছে। ঈর্ষা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই উপাদানেই তৈরি। আমরা কতটা স্বাভাবিক ও সুস্থ আছি, অর্থাৎ সুস্থতার মানসিক বোধ State of well bering নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের ওপর। ঈর্ষানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে এ পারসপরিক সম্পর্কে ভারসাম্যহীনতা নিয়ে আসে। আর তখনই হয় ক্ষতির সূচনা।  মাত্রাহীন পরশ্রীকাতরতায় মানুষের বাস্তববোধ কাজ করে না।

ঈর্ষা থেকে মুক্তির উপায়: শেক্সপিয়ারের উপমায় ঈর্ষা হলো গ্রিন আইভ মনস্টার।  এ সবুজ চোখের দানব খুবই শক্তিশালী। এর দানবীয় শক্তি মোকাবেলায় চাই অন্তরের সুপ্ত মানবিক বোধের বিকাশ।  ঈর্ষা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করাটা নিজের দায়িত্ব। বল্গাহীন সমাজে যে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, তারা পিছিয়ে পড়ছে।  এরাই ঈর্ষার শিকার।  ঈর্ষা থেকে মুক্তির জন্য সুস্থ সমাজ, সমবণ্টন ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন।  চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা রাখাটাও জরুরি। নিজের বোধ, বিবেচনা, বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এর জন্য নিজেকে পরিশীলিত ও বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। মূল কথা হচ্ছে বোধ ও বিবেচনা দিয়ে যে কোনো ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করলে মনে ঈর্ষার কোনো জায়গা হতে পারে না।

ঈর্ষাজনিত যে দহন ও উৎকণ্ঠা তাতে আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রমাগত ক্ষয় হয়।  ঈর্ষাপ্রণোদিত হয়ে আমরা কর্মক্ষেত্রে যে শক্তি নিয়োগ করি তার অনেকটারই অপচয় হয় এ দহনজ্বালায়। এ শক্তিকে বেশি ক্ষয় না করে যদি কাজে নিয়োগ করা যায়, উৎপাদন শক্তিও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। কারণ তখন প্রেরণা আসে অন্তরের সম্ভাবনাময় শক্তিপুঞ্জের জাগরণ থেকে, সতীর্থ কিংবা সহকর্মীর সাফল্যজনিত ঈর্ষার অন্তর্দহন থেকে নয়। কর্মের প্রকৃত লক্ষ্য সাফল্য বা উৎকর্ষতাকে যদি লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তখনই সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রতি সমভাব বজায় রাখা যায়। তখন প্রতিযোগী আর বাইরের কোনো সফল সতীর্থ বা সহকর্মী নয়, অতীতের আমিই তখন বর্তমান আমির প্রতিদ্বন্দ্বী। অন্যের প্রতি যদি সাময়িকভাবে ঈর্ষার ভাব আমাদের মনে জেগে ওঠে, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের গভীরে ডুব দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারি।

ঈর্ষা কখন আসে: মূলত হেরে যাওয়ার ভয় থেকে ঈর্ষার জন্ম।  আর পাঁচটা অনুভূতি বা আবেগের মতো ঈর্ষাও একটি মানসিক অবস্থা। তার বাহ্যিক প্রকাশ একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। যে ব্যক্তি ঈর্ষা করে তার মধ্যে একটা হীনমমন্যতা কাজ করে। যাকে সে ঈর্ষা করছে তার মতো হতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, গুরুত্ব না পাওয়ার যন্ত্রণা, অন্যের চোখে ঈর্ষণীয় ব্যক্তিকে কীভাবে ছোট করা যায় তার নিরন্তর প্রচেষ্টাই এ হীনমমন্যতার জন্ম দেয়। ঈর্ষার নিজস্ব ডাইমেনশন রয়েছে। কেউ ভালো নাম্বার পেলে কম নাম্বার পাওয়া মানুষটি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এটা ঈর্ষার নেতিবাচক দিক। কিন্তু যখন মানুষটি ভাবেন ওই নাম্বার তাকেও পেতে হবে তখন ঈর্ষা ইতিবাচক। ক্ষমতার পায়ে পায়ে ঈর্ষার চলাফেরা। ক্ষমতা মানে Passessione, যে ক্ষমতার জন্য মানুষ প্যারানয়েড (অবিরাম সন্দেহ আর অবিশ্বাস, ভ্রমবাতুলতার মনোরোগ) হয়ে পড়ে। আর এ কারণেই রাজা-বাদশাদের যুগে প্রচুর গুপ্তহত্যার ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঈর্ষার আরেকটি কারণ। তবে মুখ্য হলো ব্যক্তিগত হিংসা। নিজেকে মহান ভাবার বোধ, যাকে বলা হয় অস্বাভাবিক অহংমন্যতা, এর থেকেও আবার তৈরি হয় কূপমণ্ডুতা। এর উৎস নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবা। তবে দুটি সমমেধা যদি একে অন্যের পরিপূরক হয় তবে তা গঠনমূলক, সেখানে একে অন্যের প্রতি ঈর্ষা নেই। কিন্তু এর মধ্যে আমিত্ব বড় হয়ে উঠলেই ঈর্ষার উদয় হয়। তবে সব ক্ষেত্রে তা হয় না, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সমানে সমানে। তাছাড়া সুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে।   সব মানুষ কি ঈর্ষাপরায়ণ না, যে মানুষ যথাযথ আত্মসমীক্ষা, আত্মবিশ্লেষণ করতে পারেন তাদের ঈর্ষা কম হয়। আকাঙ্ক্ষা না থাকলে ঈর্ষা আসে না। মনের প্রসারতা বাড়ালে ঈর্ষা কমে। সন্ন্যাসীর ঈর্ষা থাকে না। বিশেষণে কোনো একটা জায়গায় নিজেকে কম মনে হলে ঈর্ষা জন্মায়। ঈর্ষার পেছনে বুদ্ধি কাজ করে।  মানসিক প্রতিবন্ধীদের তাই কোনো ঈর্ষা থাকে না।

ঈর্ষা কিসের ওপর নির্ভর করে: সাইকোলজিতে ‘ওথেলো সিনড্রম’ বলে একটা কথা আছে। ওথেলো বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ায় নিজের স্ত্রীকে সন্দেহ করতেন। যার জন্ম হয়েছিল ঈর্ষা থেকে। এক পর্যায়ে ওথেলো স্ত্রীকে খুনও করেন। একে ‘প্যাথলজিক্যাল জেলাসি’ বলা হয়। ষড়রিপুর অন্যতম ‘মদ’ ঈর্ষাকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। তবে ঈর্ষান্বিত হয়ে যদি কেউ সঠিক কাজ করে, যেমন পড়াশোনা আরো বাড়িয়ে দেয়া, তখন তো ‘অসুখী মনন’ নয়। সহকর্মীর পদোন্নতি কেউ কেউ ঈর্ষার চোখে দেখেন আবার কেউ কেউ মনে করেন ওটা অর্জন করার চেষ্টা করতে হবে, যেখানে ঈর্ষার কোনো স্থান নেই।

ঈর্ষার পরিমাপ:  নিচের বাক্যগুলো পড়ুন! দেখুন তো কতটির সঙ্গে আপনি একমত হতে পারেন বা ‘হ্যাঁ’ বলতে পারছেন। তারকাযুক্ত বাক্যের ক্ষেত্রে ‘হ্যাঁ’ হলে ঈর্ষাকাতরতা ‘কম’ বা ‘নেই’।  তারকা ছাড়া প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে ঈর্ষাকাতরতা বেশি।   এবার সব বাক্যের ক্ষেত্রে আপনার মতামত মিলিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আপনি ঈর্ষাকাতর কি না।

  • ছোটবেলায় মনে হতো আমার থেকে বশিরকেই সবাই ভালোবাসত।
  • ছোটবেলায় ভাইয়া যা চাইত তাই পেত; কিন্তু আমি পেতাম না।
  • বন্ধুর স্কুলব্যাগটা অনেক সুন্দর। তা দেখে আমার মন খারাপ হতো।
  • আমি বিশ্বাস করি, খুব বেশি পয়সা থাকলে মানসিক শান্তি থাকে না, তার চেয়ে পয়সা কম থাকাই ভালো।  আমার থেকে সহকর্মীর ওপর অফিশিয়াল ব্যাপারে বেশি নির্ভর করা হয়।  বেশির ভাগ সময় ভাইয়া আর আমি একই রকম রেজাল্ট করা সত্ত্বেও বাবা-মা ভাইয়ার প্রশংসাই করত সবার কাছে। আমার বোনের স্বামী দেখতে খুব সুন্দর, যদিও বোনকে তার পাশে মানায় না।
  • বন্ধুর দামি মোবাইল দেখে আমার খুব রাগ হয়।
  • আমার সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে কারণ যে মেয়েটিকে আমার ভালো লাগত তার সঙ্গে আমার বন্ধুর বিয়ে হয়েছে।
  • আপনার বাবা-মা যদি আপনার কোনো ভাই বা বোনকে আপনার চেয়ে বেশি ভালোবাসে তাহলে কি কষ্ট পান?

ঈর্ষা এবং কল্পনা: বলা যায় ঈর্ষার সঙ্গে মানুষের কল্পনা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে যায়। প্রসঙ্গত, একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, স্বামীর জন্য বেল্ট কিনে এনেছেন স্ত্রী। স্বামীর সে সময় চাকরি নেই। দামি বেল্ট দেখে স্বামীর প্রশ্ন, কত দিয়ে কিনলে? চাকরি না থাকায় হীনমমন্যতায় ভুগতে থাকা ঈর্ষান্বিত স্বামী ভাবতে থাকেন স্ত্রী নিজের আর্থিক ক্ষমতা দেখাতে চাইছে। কল্পনার জাল বুনতে বুনতে সে সঙ্গে এটাও ভাবেন নিশ্চয়ই অন্য কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে, তাই তাকে বেশি খুশি রাখার জন্য এটা এক রকমের চেষ্টা। অথচ আসল ঘটনা কিন্তু খুবই সহজ। স্বামীর বেল্ট ছিঁড়ে গেছে দেখে স্ত্রী একটা বেল্ট কিনে এনেছেন।

ঈর্ষা এবং হিংসা :  ঈর্ষা সুযোগসাপেক্ষ। ঈর্ষার সঙ্গে এক ধরনের লজ্জাবোধ থাকে, যার ফলে ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি নিজেকেও ছোট মনে করেন। অন্যদিকে হিংসার মধ্যে একটা আক্রমণাত্মক ভাব থাকে এবং হিংসা বোধবুদ্ধি আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঈর্ষা মানুষকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে না, হিংসার ক্ষেত্রে তা সম্ভব। সম্পর্কের নৈকট্য ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক গঠনের ওপর। প্রতিটি ব্যক্তিসত্তা আলাদা, বিচ্ছিন্ন এক একটা দ্বীপের মতো, আলাদা চাহিদা যা সম্পর্ক-নিরপেক্ষ, সেখানে যখন আঘাত লাগে তখনই ঈর্ষার উদয় হয়। যে ব্যক্তি সব সময় নিজেকে অন্যের তুলনায় বড় দেখতে চান তার ঈর্ষা বেশি। ঈর্ষা সম্পর্কের ক্ষতি করে। যেমন-স্ত্রীর সাফল্যে স্বামীর প্রাথমিক ভালোলাগা থাকলেও যে কোনো জমায়েত, অফিস পার্টি, পারিবারিক অনুষ্ঠানে ক্রমাগত স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে শুনতে স্বামীর মধ্যে হীনমমন্যতা তৈরি হয়, স্বামী ঈর্ষান্বিত বোধ করেন, সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ঠিক বিপরীত দিকে সফল স্বামীর প্রতিও স্ত্রীর ঈর্ষা জন্ম নিতে পারে। ইচ্ছা আর হিংসা এ দুইকে এক চোখে দেখতে চান না মনস্তাত্ত্বিকদের একাংশ। আর সেখানেই ঈর্ষা হয়ে ওঠে আরোহণের ময়ূরকণ্ঠী লিপ্সা।

ঈর্ষার তত্ত্ব: ঈর্ষার দুটি মৌলিক তত্ত্ব ইভুলিউশনারি থিয়রি অব সোশ্যাল কন্সট্রাক্ট থিওরি। বিবর্তনবাদ মতে, জেলাসি পারফর্মস অ্যান অ্যাকশন ইদ দি প্রিজার্ভেশন অব দি সিপশিস। ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের সেক্সুয়াল ইনফিডেলটিতে বা অবিশ্বস্ত যৌন সম্পর্কের কারণে বেশি ঈর্ষান্বিত হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। মেয়েরা ছেলেদের ইমোশনাল ইনফিডেলটি বা আবেগজনিত অসততায় ভয় পান এবং ঈর্ষাবোধ করেন। তাদের যুক্তি হলো, যখন ছেলেরা মানসিকভাবে বিশ্বস্ত থাকে তখন তারা অন্য কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলেও তা হয় সাময়িক। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি সম্পর্কের বিশেষণে দেখা যায় ভালোবাসা হারানোর ভয়; মনোযোগ হারানোর ভয় উভয়কেই তাড়া করে ফেরে। স্বামী অন্য কোনো মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হলে স্ত্রীর প্রথম যে প্রতিক্রিয়া সেটাই ঈর্ষা। সম্পর্কের মূল্য হারানোর দুঃখবোধ তাদের জন্য পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। স্বজন হারানোর দুঃখের থেকেও এ ক্ষেত্রে বোঝা হয়ে ওঠে এক নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা। আমার যা ছিল তা অন্যের হয়ে যাচ্ছে-এ অনুভূতি বা অসহায়তা থেকেই ইমোশনাল বা আবেগজনিত জটিলতা তৈরি হয়। ঈর্ষা দুই রকম-স্বাভাবিক ঈর্ষা, অস্বাভাবিক ঈর্ষা। অস্বাভাবিক ঈর্ষা মানসিক রোগের পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ঈর্ষার প্রকৃত কোনো কারণ নেই। এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর সৌন্দর্য সম্পর্কে সবার প্রশংসায় হীনমমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন। সন্দেহ শুরু হয় স্ত্রী যদি অন্যের হয়ে যান, এ হারানোর ভয় থেকে। যার ফলে অসময়ে অফিস থেকে এসে টেবিলে দুটি চায়ের কাপ দেখে ঈর্ষায় জ্বলতে থাকেন। ঈর্ষান্বিত হয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অতিরিক্ত যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হতে শুরু করেন। স্ত্রী রাজি না হলে স্বামী মনে করেন, স্ত্রী অবশ্যই পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। তবে ঈর্ষা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেই মানুষ এমন অপ্রকৃতিস্থ আচরণ করতে শুরু করে। সাধারণত আমাদের অন্তর্জগতে দুই রকম বৃত্তি কাজ করে-বুদ্ধিবৃত্তি (ইন্টেলিজেন্স) ও হৃদয়বৃত্তি (ইমোশন)। ঈর্ষার উৎস দ্বিতীয় বৃত্তি থেকে।

ঈর্ষা এবং ভালোবাসা:  সম্পর্ক গড়ার প্রথমদিকে নতুন দম্পতিদের মধ্যে ভালোবাসা থেকে ঈর্ষার মনোভাব দেখা যায়। নিজের আচরণের বিপরীতে সঙ্গীর মধ্যে কোনো রকম ঈর্ষার প্রকাশ না দেখে ধরে নেন তার সঙ্গী তাকে ভালোবাসে না। দখলদারিত্বের বিভিন্ন ধারণা থেকেই এ সমস্যার উৎপত্তি হয়। অনেক সময় এমনো দেখা যায়, পুরুষ সঙ্গীর ভালোবাসা পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে পার্টনার নানাভাবে ফ্ল্যাট (ফলমড়য়) করতে শুরু করেন। আসলে সম্পর্কের নিবিড়তায় যারা তৃপ্ত তাদের মধ্যে এ ধরনের ঈর্ষার জন্ম হয় না।

শিশুর ঈর্ষা :  ভালো পেনসিল বক্স, খেলনা, কানের দুল ইত্যাদি থেকেই সাধারণত শিশুদের ঈর্ষার শুরু হয়। শিশুরা চায় তার ভালোবাসার মানুষের ভাগ আর কেউ পাবে না। দেখা যায় ছোট শিশু মায়ের প্রিয় ফুলগাছগুলো ভেঙে ফেলেছে কারণ মা তাকে সময় না দিয়ে ওই গাছগুলোর যত্ন নেয়। একই মানসিকতা কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। স্বামী রোজ অফিসে বেরোনোর সময় তার পোষা টিয়াকে ছোলা খেতে দেন। যে কারণে দেখা যায় স্ত্রী বলছেন, পাখিটার গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে। সন্তান জন্মানোর পর অনেক সময় মানুষের ডিপ্রেশন হয়। স্বামীর কাছে ইম্পরটান্স হারানোর ভয় থেকেই এ অবসাদের জন্ম। মূলকথা যেসব মানুষ নিজেকে প্রাধান্য দেয় তারা সামান্য আঘাতেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে।

নবজাতকের প্রতি প্রথম সন্তানের ঈর্ষা, মা-বাবার করণীয়: 
প্রথম সন্তানের দৈনন্দিন রুটিনে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন ঘটাবেন না। তাকে যদি স্কুলে দিয়ে দিতে চান, নতুন শিশু আসার মাস দুয়েক আগেই তা করুন।   সব ব্যাপারে আগের অভ্যাস বজায় রাখুন, যেমন ঘুমানোর সময় গল্প বলা বা বই পড়ে শোনানো।   বড় হওয়ার ভালো দিকগুলো বোঝান।   দিনে অন্তত আধঘণ্টা সময় প্রথম সন্তানের জন্য আলাদা করে রাখুন।  নবজাতকের জন্য সে যদি আপনাকে সাহায্য করতে চায় তা করতে দিন।

    • প্রশংসা করুন।  কারণ ছাড়াই উপহার দিন।
    • কখনো ঈর্ষার ব্যাপারটি তার সামনে মুখ ফুটে বলবেন না।

ঈর্ষা সেসব মানুষের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে, যাদের মানসিক গঠন শক্তিশালী এবং ভারসাম্য আছে। এমন মানুষকে ঈর্ষা মোটিভেট বা উদ্বুদ্ধ করে। ঈর্ষা যখন চরম আকার নেয়, হিংসার রূপ ধরে, তখনই মানসিক সমস্যা শুরু হয়। এ সময়ে মানুষ নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেয়, ডিপ্রেশনে ভোগে, কখনো আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং সব ব্যক্তিকে ক্ষতিকারক মনে করে। ক্ষতির জন্য ক্ষতি করা আর ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষতি করা কিন্তু এক নয়।  দুটি ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় দেয়। তাই ঈর্ষাকে চেনা জরুরি। জানা দরকার, ঈর্ষা নামের এ বহুরূপীর নানা মুখ ও মুখোশ। সে সঙ্গে জানা দরকার নিজের মনের আঁধার গহীনের সাদা-কালো ছবি। পড়ুন-চিনুন নিজেকে, অচেনা ‘আমি’ কে?

  • ঈর্ষা সম্পর্কিত কয়েকটি ধারণা
  • আমার সঙ্গী যদি প্রকৃত আমাকে ভালোবাসে তাহলে অন্য কাউকে সে চাইবে না।
  • আমার সঙ্গী যদি আমাকে নিয়ে খুশি থাকে, সঙ্গী হিসেবে আমি যদি যথার্থ হই, আমার সঙ্গী শুধু আমাকে নিয়েই তৃপ্ত থাকবে।
  • প্রেম দুর্লভ।
  • একজনের বেশি কাউকে ভালোবাসা অসম্ভব।
  • সম্পর্কে অমীমাংসিত নিরাপত্তার অভাব।
  • বিশ্বাসের সমস্যা।
  • সঙ্গীর স্বীকার করার সৎ সাহসের প্রতি অনাস্থা।
  • সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অনীহা।
  • ঈর্ষা ভালোবাসার উল্টো
  • ছেলেরা সঙ্গী হারানোর আশঙ্কায় ভোগে, মেয়েরা সম্পর্কের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে থাকে।
  • ছেলেরা ঈর্ষাবোধকে প্রকাশ করতে চায় না, তারা তাদের হীনমমন্যতাবোধ স্বীকার করতে চায় না। মেয়েরা অনুভূতি প্রকাশ করে নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়।
  • তীব্র আত্মসমমানবোধ আছে এমন মেয়েরা ঈর্ষান্বিত হন না।
  • আত্মসমমানবোধ যাদের কম, আত্মবিশ্বাসের অভাবে যারা ভোগেন তারা ঈর্ষান্বিত বেশি হন।
  • আপনার সঙ্গীর ঈর্ষা স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক কীভাবে বুঝবেন?
  • আপনার সঙ্গী দিনের অধিকাংশ সময় বিষণ্ন থাকবে এবং যাকে ঈর্ষা করেন তার ভাবনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না।
  • সম্পর্ক খারাপ করার মতো কাজ করতে থাকেন।
  • সঙ্গীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন।
  • সঙ্গীকে অনুসরণ করা, ফোনে আড়ি পাতা, মোবাইলের এসএমএসের ওপর নজরদারি করা। বাইরে থেকে ফিরলে ব্যাগ, জামাকাপড় তন্ন তন্ন করে খুঁটিয়ে দেখা।