আবার বিয়ে করার আগে

সঙ্গী হারালে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। বিচ্ছেদ বা মৃত্যুর ঘটনায় কেউ জীবনসঙ্গীকে হারাতে পারেন। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আর জীবনের প্রয়োজনেই অনেকে বিয়ে করার কথা ভাবেন। কিন্তু চাইলেই কি সব সহজভাবে মেলে?  মা-বাবা-সন্তানের কথা ভেবে তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। সন্তান, নাকি নিজের জীবন, কোনটাকে প্রাধান্য দেবেন? সমাজও অনেক সময় মনে করে, সঙ্গীবিহীন অবস্থায় জীবনযাপন কষ্টকর। তবে মনে রাখতে হবে, স্ত্রী থাকা অবস্থায় বা তাঁকে না জানিয়ে বিয়ে করলে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ।

অনেক সময় স্ত্রীর মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানকে না জানিয়ে হুট করে সংসারে নতুন সঙ্গীকে নিয়ে আসেন অনেকে। এটি সন্তানের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। আকস্মিক এই আঘাত সে মেনে নিতে পারে না। পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। এসব পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব যদি ভাবনার শুরু থেকেই সন্তানের কাছে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। সন্তানের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মানবিক সম্পর্কের এই জায়গাগুলো বেশ জটিল। মনোজগতে নানা ধরনের আলোড়ন চলতে থাকে। তাই বড়দের বেশি ধৈর্য ধরতে হবে।

অনেক সময় শিশুটি নিজের মা-বাবার জায়গায় নতুন ব্যক্তিটিকে পছন্দ করতে পারে না। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে। কোনোভাবেই সন্তান যেন মানসিক চাপ বোধ না করে। সন্তানকে বোঝাতে হবে, এই বিষয়ে সে-ই মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুতে তাকে সব বুঝিয়ে বলুন।

সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। আপনার সন্তানের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ভালো হলে বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। বিয়ের পর মা-বাবার উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। আগের মতো পারিবারিক আবহ বজায় রাখতে হবে। নতুন বাড়িতে উঠলে সেটিতে সে যেন পুরোনো পরিবেশ খুঁজে পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। হুট করেই তার আগের সব অভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলা যাবে না। কেননা, শিশুটির হয়তো মা-বাবার সঙ্গে ঘুমানো অভ্যাস। তাকে যদি আলাদা ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন সে ভাববে নতুন মানুষটির কারণে তার সব হারাতে হচ্ছে। সন্তানের সীমাবদ্ধতা, পছন্দ-অপছন্দ সব আগেই নতুন সঙ্গীকে জানিয়ে দিতে হবে। যদি দুপক্ষেরই সন্তান থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। কোনো ঝামেলা হলে এর মধ্যে মা-বাবার প্রবেশ না করাই ভালো। খুব ভালো হয় বিয়ের আগের একে-অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে। এমনকি বিয়ের দিনও কৌশলী হতে হবে। যাতে সন্তান মনে করে সে-ই সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

নতুন সঙ্গীকে সন্তানের কাছে আস্থাভাজন হতে হবে। মা-বাবার বিয়ের পর সন্তান যেন নিজেকে বাইরের কেউ মনে না করে। শিশুর মনস্তত্ত্ব মা-বাবাই সবচেয়ে ভালো বোঝেন। তবু এ সময় বাড়তি যত্ন নিতে হবে। আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে তাঁদের। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরও শুরুতে মা-বাবাকে ভুল বোঝা উচিত নয়। মনে কোনো প্রশ্ন না রেখে সরাসরি কথা বললে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে না।

সুত্রঃ প্রথম আলো
লিখেছেনঃ তৌহিদা শিরোপা | জুন ০৬, ২০১৬

সন্দেহের ভূত…

সন্দেহের ভূত অনেকের মাথাতেই চেপে বসে। দাম্পত্যেই সাধারণত বেশি দেখা যায় এমন পরিস্থিতি। কখনো স্বামী, কখনো স্ত্রী মনে করেন যে তাঁর সঙ্গীর অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তা বাস্তবে সত্য নয়। এই সন্দেহপ্রবণতাকে বলা হয় মরবিড জেলাসি, যার আরেকটি পোশাকি নাম ওথেলো সিনড্রোম। শেক্সপিয়ারের নাটকের চরিত্র ওথেলো এই সন্দেহের ভূতের কবলে পড়ে তাঁর স্ত্রী ডেসডিমোনাকে হত্যা করেছিলেন।

ভ্রান্ত বিশ্বাস, খুঁতখুঁতে মনোভাব থেকে এ সমস্যা হয়ে থাকে অনেকের। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। সাধারণত ব্যক্তিত্বের ধরন, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব, আর্থিক অসংগতি, নিজের যৌন দুর্বলতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, মাদকে আসক্তি, মানসিক রোগ ইত্যাদি কারণে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে ব্যক্তি। সন্দেহের কারণে অতি উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা, খুঁতখুঁতে বা মারমুখী আচরণ, ঘুমের সমস্যাও দেখা যায়। সন্দেহ দিনের পর দিন চলতে থাকলে দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল দেখা যায়, পারিবারিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো সন্দেহের বশবর্তী হয়ে সন্দেহভাজনকে হত্যা, সন্তান হত্যা, গুরুতর আঘাত বা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

সন্দেহের বিষয়টি যখন বড় আকার ধারণ করে, তখন সেটাকে বলা হয় প্যারানয়েড ডিলিউশন। যাঁর মধ্যে এ সমস্যা থাকে, তিনি তাঁর সঙ্গীকে অবিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন আশপাশের সবাই তাঁর ক্ষতি করতে চায়, কখনো মনে করতে পারেন তাঁর কাছের মানুষেরা তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে ইত্যাদি। অপর দিকে ওথেলো সিনড্রোমের ক্ষেত্রে সন্দেহটি খুবই সুনির্দিষ্ট, সঙ্গীর অন্য কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে—এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের মধ্যেই সন্দেহ সীমাবদ্ধ।

সন্দেহের ভূত তাড়াতে:

দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে সাধারণ ভুল-বোঝাবুঝি বা সন্দেহ তৈরি হলে বিষয়টিকে বড় হতে না দিয়ে শুরুতেই তা নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলোচনা করুন।
আপনার সন্দেহটি সঠিক কি না, তা বারবার যাচাই করে দেখুন।
সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া সঙ্গীকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না, সন্দেহের ঘটনাটি তাঁর দিক থেকেও দেখুন।
সন্তানদের এই বিষয়ে জড়াবেন না।
গোপনে নজরদারি এড়িয়ে চলুন, গোয়েন্দার ভূমিকায় না থেকে বন্ধুর ভূমিকায় বিষয়টি জানার চেষ্টা করুন।
অধীনের কর্মচারী, কাজের লোক, গাড়িচালক বা নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন না।
আপনাদের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে তৃতীয় কেউ ষড়যন্ত্র করছে কি না, তা যাচাই করুন।
আপনি নিজে সন্দেহের শিকার হলে, সাময়িক সমাধানের জন্য মিথ্যা বলবেন না।
হঠকারী আচরণ এড়িয়ে চলুন।যদি মনে হয়, এটি সাধারণ ভুল-বোঝাবুঝির চেয়ে কিছু বেশি বা দুজনের কারও মধ্যে কোনো মানসিক সমস্যা রয়েছে, তবে দেরি না করে দ্রুত মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

আহমেদ হেলাল (প্রথম আলো)

বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে

বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করতে চাইলে পাত্র ও পাত্রীকে একজন আইনজীবীর শরণাপন্ন হতে হবে৷ আইনজীবীর তত্ত্বাবধানে প্রস্তুতকৃত হলফনামায় পাত্র-পাত্রী স্বাক্ষর দানের পর ওই হলফনামা নোটারি পাবলিক কর্তৃক নোটরাইজড করতে হবে ৷ হলফনামায় অবশ্যই ‘বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে’ শব্দগুচ্ছ লিখতে হবে ৷ অতঃপর সরকার অনুমোদিত বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রারের কাছে নির্ধারিত ফরম পূরণপূর্বক ৩ জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয় ৷ উল্লেখ্য, বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ের ক্ষেত্রে যৌতুক প্রথা এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার বাহুল্যতা নেই ৷

বিশেষ বিবাহ আইন : ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইনানুসারে যেসব ব্যক্তি খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, মুসলিম, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাদের জন্য বিয়ের একটি ধরন নির্ধারণ করা এবং যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতা প্রদান করা সমীচীন ৷ বিশেষ বিবাহ আইনে বিয়ে অনুষ্ঠানের শর্তাবলী বিশেষ বিবাহ আইনের ২ ধারা মোতাবেক বিয়ে অনুষ্ঠানের শর্তাবলী নিম্নরূপ-

(ক) বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারোই কোনও জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না
(খ) গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুসারে পুরুষ ব্যক্তির বয়স ১৮ বছর এবং মহিলার বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হতে হবে,
(গ) পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবেন না, যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে৷

বিয়ে যেভাবে সম্পন্ন করতে হবে বিশেষ বিবাহ আইনের ১১ ধারা মোতাবেক বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সম্মুখে৷ উল্লেখ্য, পক্ষগণকে রেজিস্ট্রার ও সাক্ষীগণের উপস্থিতিততে বলতে হবে ‘আমরা পরস্পর পরস্পরকে আইনসঙ্গত স্ত্রী অথবা স্বামী হিসেবে গ্রহণ করলাম ৷’   ১১ ধারার বিধানাবলী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে [১৮ ডিএলআর (১৯৬৬) পাতা ৫০৯] ৷সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর কতিপয় বিয়ের ফলাফল হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনও যৌথ পরিবারের কোনও সদস্যের এ আইন মোতাবেক বিয়ে হলে অনুরূপ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে (২২ ধারানুসারে) ৷ বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ আইন বাংলাদেশের কোনও মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন বা তাদের একজন যে কোনও এটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত নিয়মাবলী অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক ৷

এক্ষেত্রে একজন আইনজীবী কর্তৃক হলফনামা সম্পাদনের পর ওই হলফনামা নোটারাইজড করে বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে সমুদয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে৷

ব্রাহ্ম সমাজের সিদ্ধান্ত : ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ব্যক্তিরা হিন্দু কিনা, তারা হিন্দু না হলে তাদের বিবাহরীতি পদ্ধতি কিভাবে হিন্দুমতে সম্পন্ন হবে ৷ যদি তাই হয় তাহলে ব্রাহ্ম সন্তানরা কোন আইনে উত্তরাধিকারের অধিকার পাবেন? এসব প্রশ্নের সমাধানকল্পে এগিয়ে আসেন ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠাতা কেশবচন্দ্র সেন ৷ তিনি ঘোষণা দেন, সর্বধর্ম সমন্বয়ক হিসেবে যে কোনও ধর্মের লোক ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য হতে পারেন ৷ সেক্ষেত্রে কোনও মুসলিম কিংবা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী যদি ব্রাহ্মের দীক্ষা নেন, তাহলে কোন বিধিতে তাদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হবে ৷ এসব সমস্যার আইনগত সমাধানের জন্য কেশবচন্দ্র সেন উদ্যোগী হন ৷ ১৮৬৭ সালের ২০ অক্টোবর ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্ম সমাজের এক অধিবেশনে তিনি ব্রাহ্ম বিবাহ বিধিবদ্ধ করার উত্কৃষ্ট উপায় নির্ধারণের জন্য ব্রাহ্মদের কাছে আবেদন জানান, ১৯৬৮ সালে সিভিল ম্যারেজ বিল উত্থাপন করলে সরকার সমর্থিত এ বিলে বলা হয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি হিন্দু অথবা মুসলমান অথবা ভারতবর্ষে প্রচলিত অন্য কোনও ধর্মাশ্রিত হয়ে সেই ধর্ম অবিশ্বাস করেন এবং সেই ব্যক্তি ওই ধর্ম প্রকাশ্যরূপে পরিত্যাগ না করে ওই ধর্মের বিবাহ পদ্ধতি অনুসারে বিবাহ করেন, তাহলে সেই বিবাহ আদালতে বৈধ বলে গণ্য হবে ৷’ কিন্তু এ ব্যাপা তত্কালীন সমাজে প্রবল মতবিরোধ দেখা দেয় ৷ ফলে এ আইন বিধিবদ্ধ না হয়ে পুনর্বিবেচনার জন্য পর্যালোচনা কমিটিতে পাঠানো হয় ৷

পর্যালোচনা কমিটি দীর্ঘ ২ বছর নানা দিক বিবেচনা করে ‘ব্রাহ্ম ম্যারেজ অ্যাক্ট’ প্রণয়রে সুপারিশ করে৷ অবশেষে নানা যুক্তিতর্ক, বাদানুবাদ ও শঙ্কা আশঙ্কার পর ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট নামে পাস হয় ৷ ব্রাহ্ম সমাজের বৈশিষ্ট্য হল- সাবালক পাত্র-পাত্রীরা ব্রাহ্ম সমাজ মন্দিরে উপস্থিত হয়ে স্ব স্ব ধর্মে বহাল থেকে ব্রাহ্ম রীতিতে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিবাহ করতে পারেন ৷ মন্দিরের আচার্য বিবাহে পৌরহিত্য করলেও তা রেজিিস্ট্র করে থাকেন সিভিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ৷ ওই রেজিস্ট্রার বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ ও আইনগতভাবে নিয়োগকৃত হতে হবে ৷ ব্রাহ্ম বিবাহে সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয় ৷ বিবাহ শেষে উপস্থিত অতিথিরা প্রার্থনা সভায় অংশ নেন এবং ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে বর-কনের মঙ্গল কামনা করেন ৷ এই প্রকার বিয়েতে যৌতুক প্রথা ও অতিথি আপ্যায়নের বাহুল্য নেই ৷

জানা যায়, ১২৮১ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত মুসলিম যুবক জালালউদ্দিন মিয়া ব্রাহ্ম বিবাহরীতিতে প্যারী বিবিকে বিয়ে করে সর্বত্র হৈচৈ ফেলে দেন ৷ ঢাকার ঐতিহাসিক সদরঘাট ও কোতোয়ালি থানার উত্তরে এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজিয়েট হাইস্কুল সংলগ্ন পাটুয়াটুলী রোডের ২-৪ লয়াল স্ট্রিটে বালাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ কার্যালয়ে দেশের একমাত্র সিভিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রার রেভারেন্ড প্রাণেশ সমাদ্দার বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন৷

সিভিল ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালনকারী প্রায় ৮৪ বছর বয়সী প্রাণেশ সমাদ্দার জানান, পাত্র-পাত্রীর পরস্পরের ধর্মীয় বিশ্বাস পৃথক হলে তারা যদি স্ব স্ব ধর্ম পালন করে বিয়ে করতে চায় তবে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে কার্য সম্পন্ন করতে হবে ৷ এ জন্য ৫০০০ টাকা এবং ৩ জন সাক্ষীর প্রয়োজন৷ বিশেষ বিবাহ রেজিস্ট্রার প্রাণেশ সমাদ্দারের চেম্বার সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের মেয়ে ফাল্গুনী বড়ুয়া এবং যাত্রাবাড়ীর শহীদ হোসেন রোডের (হালে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি) মোস্তফা ভূইয়ার ছেলে মঞ্জুরুল প্রায় দুই মাস আগে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ের সিঁড়িতে বসে ৷ ফাল্গুনী আর মঞ্জুরুলের মতো অনেকেই এভাবে যে যার ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ঠিক রেখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে ৷

প্রাণেশ সমাদ্দার জানান, প্রতিবছর ৮/১০টি বিয়ে পড়ান তিনি ৷ দু’জনার ধর্ম দুটি হলেও সারাজীবন একত্রে জীবনসঙ্গী হিসেবে বসবাস করার জন্য বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করার বিকল্প নেই৷

বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিয়ে করার সুযোগ আছে বলে স্বধর্মের উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে না করে ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের বিয়ে করার মানসিকতাকে এড়িয়ে চলার উদাত্ত আহ্বান জানাই ৷ বিশেষ বিবাহ আইনটি যুগোপযোগী করে সংশোধন করা দরকার ৷ তাছাড়া ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়োগ এবং কার্যকর পদ্ধতিতে বিয়ে সম্পন্ন করার বিষয়গুলো আরও সহজ ও স্বচ্ছ হওয়া দরকার ৷ আমাদের বিশ্বাস সরকার বিষয়গুলো নিয়ে ভাববে৷


বিশেষ বিবাহ আইন
খন্দকার মুজাহিদুল হক | তারিখ: ৩১-০১-২০১০ | প্রথম আলো 


বাংলাদেশে বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় ‘বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২’ অনুযায়ী। কিন্তু এ বিয়ে কাদের জন্য প্রযোজ্য, বিয়ে অনুষ্ঠানের শর্তাবলি কী, সম্পাদনের পদ্ধতি কী, কার দ্বারা এ বিয়ে সম্পাদন হবে, এ বিয়ের ফলে জন্ম নেওয়া সন্তান কোন ধর্মের পরিচয়ে বড় হবে, এ বিয়ের স্বামী বা স্ত্রী কোন ধর্ম অনুসরণ করবেন, এ বিয়ের ফলে উত্তরাধিকার কে কতটুকু ভোগ করতে পারবেন প্রভৃতি বিষয় অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।

যেসব ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাঁদের মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছেন, এ আইন দ্বারা তাঁদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়েছে এ আইন দ্বারা।

‘বিশেষ বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে। এ আইনের বিধানে যেকোনো ধরনের মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  আবেদনকারী যদি বাস্তবে ধর্ম ত্যাগ না করে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ধার্য হয়েছে—তিনি মিথ্যা বর্ণনা দিয়েছেন।’ [(১৯৬৬) ১৮ ডিএলআর ৫০৯]

বাংলাদেশে মুসলিম কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করলে অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম আইন অনুযায়ীই বিয়ে করতে পারেন।  যদি অন্য পক্ষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তবে কোনো সমস্যাই নেই, অর্থাত্ বিয়েটি ‘বৈধ বিয়ে’। আর যদি অন্য পক্ষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ নাও করেন, তবু মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়ে করা যাবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিয়েটি ‘অনিয়মিত’ হবে।  খ্রিষ্ট ধর্মের ক্ষেত্রেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।  অন্য পক্ষ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে কোনো সমস্যাই নেই। তবে অন্য পক্ষ খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ না করলে খ্রিষ্টান পারিবারিক আইন অনুযায়ী বিয়েটি ‘অনিয়মিত’ বিয়ে হবে।

বিয়ে সম্পাদনের ইচ্ছা পোষণ করলে দুই পক্ষের কোনো একজনকে অবশ্যই নিবন্ধক বরাবর লিখিত নোটিশ দিতে হবে। যে জেলার নিবন্ধক বরাবর নোটিশ প্রদান করবেন, নোটিশ প্রদানকারীকে অবশ্যই নোটিশ দেওয়ার কমপক্ষে ১৪ দিন আগে থেকে সেখানে বসবাস করতে হবে। নিবন্ধককে অবশ্যই ওই জেলার হতে হবে, যে জেলায় দুই পক্ষের অন্তত কোনো একজন নোটিশ দেওয়ার কমপক্ষে ১৪ আগে থেকে বসবাস করছেন।

বিয়ের প্রত্যয়নপত্র: বিয়ে সম্পাদনের পর নিবন্ধক ‘বিবাহ প্রত্যয়ন বই’য়ে প্রত্যয়নপত্র অন্তর্ভুক্ত করবেন, যা নির্ধারিত একটি ফরম। এবং এটি উভয় পক্ষ ও তিনজন সাক্ষী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হবে।

নিবন্ধক সরকার-নির্ধারিত ফরমে ‘বিবাহ প্রত্যয়ন বই’য়ে লিপিবদ্ধ সব অন্তর্ভুক্তির অনুলিপি তাঁর জেলার ‘জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল’-এর কাছে পাঠাবেন।

জন্মগ্রহণকারী সন্তানের বিবাহ: এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে তাঁর পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত-সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তাঁর ওপর প্রযোজ্য হবে। এ আইনের কোনো কিছুই এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ন করবে না।

মিথ্যা বর্ণনা-সংবলিত ঘোষণার প্রত্যয়নপত্র স্বাক্ষরের শাস্তি: এ আইন দ্বারা নির্দেশিত কোনো ঘোষণা বা প্রত্যয়নপত্র তৈরি করেন, স্বাক্ষর করেন বা সত্যায়ন করেন, যা মিথ্যা বর্ণনা, এবং তিনি জানেন ও বিশ্বাস করেন মিথ্যা বলে, বা সত্য বলে বিশ্বাস করেন না, এমন কোনো ব্যক্তি দণ্ডবিধির ১৯৯ ধারায় অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন। সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর ফলাফল: হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইনে বিয়ে হলে তিনি ওই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য হবেন।

উত্তরাধিকারের অধিকার: হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি এ আইনে বিয়ে করলে, ‘জাতিগত অসামর্থ্যতা দূরীকরণ আইন, ১৮৫০’ প্রযোজ্য হয় এমন ব্যক্তির মতো তাঁরও সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে একই অধিকার থাকবে এবং তিনি একই রকম অসামর্থ্যতার অধীন হবেন। তবে শর্ত হচ্ছে, এ ধারার কোনো কিছুই ওই ব্যক্তিকে ধর্মীয় পদ বা চাকরির, বা কোনো ধর্মীয় বা দাতব্য ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনার কোনো অধিকার প্রদান করবে না।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার: হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, যিনি এ আইনের অধীন বিয়ে করেছেন, তাঁর সম্পত্তির, এবং এ বিয়ের ফলে জাত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ‘উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫’  অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে, যাঁদের কেউই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কিংবা ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে, যাঁদের প্রত্যেকেই এর একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাস করেন— হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাসী, এ আইন দ্বারা তাঁদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতা দেওয়া হয়েছে এ আইন দ্বারা।