মা আগে না বউ আগে

একজন নতুন দোকান দিয়েছেন। দোকানের নাম কী হবে, তা নিয়ে দেখা দিল সংকট। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি নাম রাখলেন ‘মায়ের দোয়া স্টোর’। মাকে গিয়ে বললেন, ‘তোমার কথা মাথায় রেখেই এমন নাম দিলাম।’ এরপর বউয়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘শুনছ, তোমার ছেলেমেয়েদের কথামতো নাম রাখলাম মায়ের দোয়া।’শুনে মাও খুশি। বউও খুশি।বাস্তবে এমন দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত সমাধান একটু কষ্ট-কল্পনাই বটে। চিরায়ত বউ-শাশুড়ি দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে যে মানুষটার প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি, তিনি একই সঙ্গে মায়ের পুত্র এবং বউয়ের স্বামী। মায়ের সঙ্গে তাঁর নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক—অবিচ্ছেদ্য ও চিরন্তন। আর বউয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা নির্ভরতার—চিরকালীন ও আমৃত্যু। তাঁর কাছে দুটো সম্পর্কই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

দুই প্রজন্মের এই দুই নারীর বিরোধ যদি চরমে ওঠে, তাহলে তার মাঝখানে পড়ে ‘অসহায়’ মানুষটার অবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। কপাল ভালো হলে, কখনো মেলে দারুণ সমাধান। কখনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে হাবুডুবু।ছোটবেলা থেকেই যে ছেলে মায়ের আঁচল কিংবা মায়ের হাতের রান্না ছাড়া কিছু বুঝতই না, বিয়ের পরে সেই ছেলে হঠাৎ করেই ‘স্ত্রৈণ’। মায়ের এটা মেনে নেওয়া কঠিন। মানুষ তো সে, রোবট তো আর না।মায়ের মনে থাকে, আহা, ছেলেটা বুঝি পর হয়ে যাচ্ছে। আর ছেলে যদি মায়ের কথা বেশি বলে বউ ফুঁসতে থাকে, দেখেছ, মা এখনো ছেলেকে কবজা করে রেখেছে। দিন যায়, ক্ষোভ বাড়ে, জন্ম নেয় ঝামেলা। কোনো ঘটনায় ছেলে যদি মায়ের পক্ষ নেয়, বউয়ের মুখজুড়ে অন্ধকার। আর বউয়ের পক্ষ নিলে মায়ের মনে কালবৈশাখীর পূর্বাভাস। কই যাই!

নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘নকশা’-তে সুবন্ধু সমীপেষু বিভাগে পাঠকের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীরা অনেক বেশি ঘরকেন্দ্রিক। ঘরের ক্ষমতা ধরে রাখতে, মা আর বউ দুজনেরই ভরসা ছেলে। ব্যাপারটা এমন, ছেলে যাঁর পক্ষে, জয় যেন তাঁরই। তবে আশার কথা হচ্ছে, আজকাল বউ-শাশুড়ি দুজনই বাইরে কাজ করেন। এ কারণে তাঁদের বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। ঘরের বাইরে আজকাল এত বেশি চাপ সামলাতে হয় যে বাড়ি ফিরে শান্তিপূর্ণ বসবাসের স্বার্থে ছোটখাটো বিষয়গুলোতে আপনাআপনি সমঝোতা হয়ে যায়। আরও একটা-দুটো প্রজন্ম পরে হয়তো সমস্যাটা এত বেশি প্রকট থাকবে না।’

রায়হান ইসলাম বিয়ে করেছেন সাত বছর হলো। মা, বউসহ বেশ ভালোভাবেই তাঁর দিন কেটে যাচ্ছে। তাঁর মতে, ছেলে যদি বুদ্ধিমান হয়, তাহলে বিয়ের পরও সে মায়ের সঙ্গে আগের মতো সম্পর্ক চালিয়ে যাবে। এতে পরিবারে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা তৈরি হবে না। ঘরে বউ আসার আগে মায়ের সঙ্গে পরামর্শও করে নেওয়া যেতে পারে, যাতে নতুন সদস্যের কোনো সমস্যা না হয়। এতে মায়ের মনে হবে, ছেলের নতুন জীবনেও তাঁর কিছু অবদান আছে। আবার বউও খুশি হবে তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে স্বামী যদি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রওশন জাহান বলেন, একসঙ্গে থাকতে গেলে খটোমটো লাগবেই। সব সময় তো আর মনমানসিকতা এক রকম থাকে না। ক্ষমা, ধৈর্য ও সহনশীলতার চর্চা বাড়লে ছোটখাটো বিষয় কখনোই বড় হয়ে উঠবে না। মাকে বুঝতে হবে, বিয়ের পরে ছেলের আলাদা জগৎ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বউকেও বুঝতে হবে, ছেলের কাছে মায়ের কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। সেই দায়িত্বটা পালনে ছেলের সঙ্গে তাঁকেও সহযোগিতা করা উচিত। তাহলে সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে।

তবে মূল দায়িত্বটা অবশ্যই ছেলের। তাকে অবশ্যই প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। কিংবা সে কোনো দিকে কান না দিয়ে নিজের মতোও থাকতে পারে। কোনো একদিকে না হেললেই হলো। ছেলেকে বুঝতে হবে, মা তো আছেই, বউয়ের প্রতিও সহানুভূতিশীল হতে হবে। যেহেতু তিনি অচেনা একটি পরিবারে এসেছেন নিজের পরিবার ছেড়ে।

মা যদি ছেলেকে নিজের পছন্দের কিছু বানিয়ে খাওয়াতে চান, তাহলে ছেলের উচিত বউকে অন্য কিছু তৈরি করতে উৎসাহিত করা। মা ও বউয়ের মধ্যে কে কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে স্বচ্ছন্দ, সেটা শুরুতেই ঠিক করে নেওয়া দরকার। এতে দুজনই নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে সচেতন হবেন। কিছু কিছু কাজ একদমই করা ঠিক নয়। তা হলো, একজন সম্পর্কে অন্যকে মন্দ কথা বা নালিশ, রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ প্রকাশ না করা। অধিকারবোধ নিয়েই যেহেতু সব গোলমাল, তাই দুটো সম্পর্ককেই সম্মান করলে, সচেতন থাকলে টানাপোড়েন কম হবে। কারণ, একজনের অধিকারবোধের প্রকাশ আরেকজনের মনে ঈর্ষা জাগিয়ে তোলে।

ফারহানা আলম

ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থেকে বিরত থাকে পুরুষ

বিবাহিত নারীর সঙ্গে অনুচিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা পুরুষের জীবনে বিরল নয়। তাঁরা প্রতিবেশী বা অন্য কারও স্ত্রীর প্রতি ঘটনাচক্রে দুর্বল হয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক তৈরি থেকে পুরুষেরা সাধারণত বিরত থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইসে অবস্থিত মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউএমএসএল) একদল গবেষকের দাবি, সম্ভবত মানসিক গঠনের কারণেই তাঁরা বন্ধুর প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখার ব্যাপারে সচেতন থাকেন।

ইউএমএসএল কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মার্ক ফিনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের পরিমাণের তারতম্য নিয়ে গবেষণা করেন। মানসিক অবস্থাভেদে পুরুষের শরীরে এই হরমোন নিঃসরণে তারতম্য হয়। হিউম্যান নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভাব্য প্রেমিকা বা শত্রুর স্ত্রীর সান্নিধ্যে অবস্থানকালে পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু ঘনিষ্ঠ কোনো বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে অবস্থানকালে টেস্টোস্টেরন নিঃসরণের পরিমাণ তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। এমনকি সুযোগ পেলেও বন্ধু এবং বন্ধুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট রাখার স্বার্থে অনুচিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে পুরুষ নিজেকে সংযত রাখেন। গোটা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয়।

গবেষকদের দাবি, মানুষের প্রকৃতিগত এই বিশ্বস্ত মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘ বা ন্যাটোর মতো সংগঠনও মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক কার্যপদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।
সূত্রঃ প্রথম আলো (ঢাকা, সোমবার,২৫ মার্চ ২০১৩,)

 

বধূ মিছে রাগ কোরো না

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মান-অভিমান হবেই, আবার মান ভাঙাতেও হবে। ছোট ছোট সমস্যা যেন বড় আকার ধারণ না করে।আটটার দিকে বাড়ি ফিরেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বামী। একের পর এক ফোন সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসা। ওদিকে মুখ থমথমে স্ত্রীর। সারা দিন পর দেখা, একটু হাসিমুখে কথাও বলা হলো না। এতই ব্যস্ততা!ছুটির দিন দুপুরে বসার ঘরে জেঁকে বসে আছে স্বামীর বন্ধুরা। স্বামীকে বারবার ইশারা করেও লাভ হচ্ছে না। ওঠার নাম নেই। একটা ছুটির দুপুর মাটি হয়ে যাবে তাহলে! ব্যস, স্ত্রীর মুখ অন্ধকার।

কিংবা মায়ের পরামর্শ ছাড়া স্ত্রী যেন চলতেই পারছেন না, তাই বলে দুজনের সব কথাই গিয়ে বলতে হবে মাকে? স্বামীর মনে অভিমানের ছায়া।খরচ বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছেন দুজনই, তাই বলে একটা দিনও কি একটু ভালো রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া যাবে না। এই নিয়ে মতান্তর, শেষমেশ দুজনের কথা বন্ধ।

ছোট ঘটনা, বড় অভিমান। তুচ্ছ কথা-কাটাকাটি থেকে বড় ঝগড়া। কয়েক মিনিটের ঝগড়াতেই আপন এ মানুষকে মনে হতে পারে খুব দূরের কেউ। আর এসবের জের অনেক দূর পর্যন্তও গড়ায়। হয়তো মনে হতে পারে, একটু ঝগড়া হয়েছে এ আর এমন কী। কিন্তু সময়মতো মিটিয়ে না ফেলে তা জিইয়ে রাখা মোটেও উচিত নয়। হয়তো আবার কথা বলা শুরু হলো দুজনের। কিন্তু মনের কোণে একটু ক্ষোভ রয়েই গেল। এভাবেই মেঘের ওপর মেঘ জমে দুজনের জীবনে ফেলতে পারে কালো ছায়া।

‘যত বড় ঝগড়া-ই হোক। সঙ্গী কিন্তু আপনার জীবনের একটা বড় অবলম্বন। একটু অভিমান হয়েছে। তিনি ই কিন্তু আবার আপনার সমর্থনে সারা দুনিয়ার সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত।’ বলেন মনোয়ারা চৌধুরী। শিক্ষকতা পেশায় আছেন তিনি। আর তাঁর স্বামী এস আর চৌধুরী কাজ করছেন গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের মেডিকেল অ্যাডভাইজার হিসেবে। ৪৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে অভিমান, ঝগড়া হয়েছে অনেকবার। কিন্তু কোনোবারই তা মিটে যেতে বেশি সময় লাগেনি বলে জানালেন।ঝগড়া হয়েছে, কথা বন্ধ। এটা যেন দাম্পত্যের অলিখিত নিয়ম।রাগ হলে কে আগে মান ভাঙাতে আসে? সানজিদা আহমেদের (ছদ্মনাম) উত্তর—‘অবশ্যই আমি।

কথা বলা বন্ধ করে আবার নিজেই শুরু করে দিই। আমার এসব মান-অভিমানের পালা সাধারণত ঘটে রাতে ঘুমানোর আগে। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতেই আবার শেষ।’আর স্ত্রী রাগ করলে হেঁড়ে গলায় গান ধরাটাকে বেশ ভালো উপায় বলেই মানেন আহসান হাবীব (ছদ্মনাম)। আর এ ক্ষেত্রে ‘তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী…’ এমন লাইনগুলোই নাকি ভালো। ‘গান ধরলে ও প্রথমে একটু রাগ রাগ ভাব করে। তার পরই হেসে ফেলে। ব্যস ঝগড়া শেষ। আমি বলি, আর কোনো দিন এমন হবে না। ও বলে, তুমি তো বারবারই এমন বলো, তার পরও একই কাজ করো। আমি আর কী বলব, বলি, আমি তো এমনই।’ বললেন তিনি।কে আগে মান ভাঙাবে? এগিয়ে আসা একটু কঠিনই বটে। মনোয়ারা চৌধুরী মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ছেলেদের এগিয়ে আসাই ভালো। ‘মেয়েরা এমনিতেই একটু বেশি অভিমানী হয়। আবার অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।  ঝগড়ার মুহূর্তটা জিইয়ে না রেখে স্বামী যদি একটু নরম হন, তাহলেই তো হলো।’

দুজনের ঝগড়ায় ভালো কোনো বন্ধু, কাছের আত্মীয়রাও মিটমাটের উদ্যোগ নিতে পারেন। আর সন্তানেরা তো বড় একটা ভূমিকা রাখেই। নিজে হয়তো স্যরি বলতে পারছেন না। সন্তানকেই বলতে পারেন মান ভাঙানোর ব্যবস্থা নিতে। তারা হয়তো সবাইকে নিয়ে আয়োজন করে ফেলতে পারে চমৎকার একটা পার্টি আবার পছন্দের কোনো কিনে আপনার তরফ থেকে উপহার দিতে পারে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার জানান, একজন রেগে গেলে অবশ্যই অন্যজনকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর যে কারণেই মতান্তর হোক, তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করে মতের অমিলটা দূর করতে হবে। তবে ঠিক সেই মুহূর্তেই নয়, বরং পরে দুজনই যখন শান্ত হবেন, তখন আলোচনা করা উচিত। এ নিয়ে কথা না বললে তা চাপা ক্ষোভ হিসেবে জমা হতে পারে, যা পরে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে।তবে নিজেদের ঝগড়ার কথা কাকে বলব আর কাকে বলব না সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই আবার এর সুযোগ নিতে পারে।

যা নিয়েই মতান্তর হোক আদতে তো সেটা মান-অভিমানের দিকেই গড়ায়। আর তা যেন সেখানেই শেষ হয়ে যায়। এর বেশি যাতে না যেতে পারে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই।

রাগ কিভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখবেন এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ডাঃ মেখলা সরকার

ছোট নীড়েই আনন্দ

বাড়িটা ছোট।  ঘরগুলোও তেমন খোলামেলা নয়। দুটো শোবার ঘর, খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা।নতুন দম্পতিদের সংসার শুরু হয় সাধারণত এ রকম বাড়ি বা ফ্ল্যাট দিয়েই। ঘর সাজানোর বাজেটও সাধারণত সীমিত হয়। পছন্দ হলেই কিছু কিনে ফেলা যায় না। সঞ্চয় করে প্রয়োজনীয় আসবাবগুলো কেনা হয় একটু একটু করে। তবে ভালোবাসা আর রুচির স্পর্শে এই ছোট্ট নীড়েই গুছিয়ে তুলতে পারেন আপনার সংসার। বিয়ের মৌসুম শেষ হলো মাত্র। এবার সংসার শুরু করার পালা। অনেকেই বিয়ের পর স্বতন্ত্রভাবে সংসার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উল্টোটাও হয়। যেটাই হোক নতুন বাসস্থানটি সাজানো নিয়ে ভালো লাগা থাকে দুজনের মধ্যেই। মাত্র সংসার শুরু করেছেন রাহানুমা হারুন। পুরোপুরি এখনো বাড়ি গুছিয়ে তুলতে পারেননি। সকালে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে সন্ধ্যার পরই কেনাকাটা শুরু হয়। ‘কেনাকাটার তালিকায় প্রথমেই আছে খাট, আয়না, খাওয়ার টেবিল, সোফা। এরপর কিনব ফ্রিজ। উপহার হিসেবে অনেক বাসনকোসন পেয়েছি। এ কারণে প্রয়োজন ছাড়া এখন এগুলো আর কিনব না। তবে সবকিছুর শুরুতে প্রথমেই দুজনের পরিকল্পনা করে নেওয়াটা জরুরি’, বলেন রাহানুমা হারুন।

খোলামেলা পরিবেশ:
ছোট ঘর, শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে চারপাশের দেয়ালটাকে আরেকটু সরিয়ে দিতে। দেয়াল না পিছিয়েও ঘরকে বড় দেখানো যাবে ইচ্ছে করলেই। স্থপতি মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী জানালেন সে রকমই কিছু পদ্ধতির কথা। ছোট ঘরকে বড় দেখানোর জন্য খাটো ও হালকা আসবাব ব্যবহার করতে পারেন।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাব না কেনাই ভালো। বাড়ির মধ্যে কোনো কোনা অথবা কলাম থাকলে সে ক্ষেত্রে কিছুটা জায়গা নষ্ট হয়। ইতিবাচকভাবে দেখলে এতে কিছুটা জায়গাও বের হয়। এই জায়গাটুকুতে শেলফ বানিয়ে তাতে বিভিন্ন জিনিস রাখার পরামর্শ দিলেন মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী। নিচু উচ্চতার চেয়ারের জন্য সর্বনিম্ন তিন ফুটের চেয়ার বানাতে বা কিনতে পারেন। উচ্চতা এর কম হলে বসার সময় স্বস্তি নাও পেতে পারেন।

নিচু উচ্চতার খাটে আপনার শোবার ঘরকে বড় দেখাবে। এ ছাড়া মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে শোবার ব্যবস্থাও করতে পারেন। বিছানার দুপাশে টেবিল ল্যাম্পও ভালো লাগবে।ছোট ঘরে হলুদ, কমলা, উজ্জ্বল নীল রংগুলো ব্যবহার করতে পারেন। এই রঙগুলো আলো প্রতিফলিত

করে, ফলে ঘর বড় দেখায়। চাইলে রঙের বদলে ওয়াল ম্যাটও ব্যবহার করতে পারেন। তবে অবশ্যই এ বিষয়ে যাঁরা পারদর্শী তাঁদের সাহায্য নিতে হবে। কারণ ওয়াল ম্যাট দেয়ালে লাগানোর সময় বাতাস ঢুকে গেলে পরবর্তী সময়ে সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়া ভালো মানের প্লাস্টিক পেইন্ট ব্যবহারে ঘরে চকচকে ভাব আসে। এটাতেও আপনার ঘর দেখতে বড় লাগবে বলে জানান মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী ।

নান্দনিক বাসন:
সারা দিন ব্যস্ততার মধ্যে একসঙ্গে বসে সময় কাটানো হয় না অনেকেরই। সকালের চা কিংবা রাতের খাওয়ার সময়টায়ই যা একটু গল্প করা হয়। এ কারণে খাবার পরিবেশনের পাত্রগুলো যদি একটু নান্দনিক নকশার হয় তাহলে তা মন ভালো রাখার মন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার জানান, ‘সাধারণত নতুন দম্পতিরা একসঙ্গে সবকিছু কেনেন না। একটু একটু করে প্রয়োজনমতো বাসন কিনে নিয়ে যান। ক্লে ইমেজে দম্পতিদের জন্য ডিনার সেট, নাশতা খাওয়ার সেট, চা খাওয়ার সেট পাওয়া যায়। বিশেষ কিছু রং ব্যবহার করি আমরা নতুন সংসারকে রঙিন করে তোলার জন্য। তাঁরা চাইলে বাসনের একদিকে আমরা তাঁদের নামও লিখে দিই।’

খাবারের বাসনগুলো দৃষ্টিনন্দন হলে পরবর্তী সময়ে এগুলো অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন প্লেট পুরোনো হয়ে গেলে টবের নিচে রাখতে পারেন। ঠিক একইভাবে কাপের হাতল ভেঙে গেলে সেটিকে টব কিংবা রান্নাঘরে চামচ রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

কম বাজেটেই ষোলো আনা:
নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাগবে, এমনটি নয়। একটু পরিকল্পনা করে নিলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নতুন দম্পতিদের দেশীয় জিনিসের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ থাকে। কাঠের আসবাবের থেকে এগুলোর দামও কিছুটা কম হয়ে থাকে।কাঠের আসবাবের বদলে বিভিন্ন বোর্ডের তৈরি আসবাব ব্যবহার করা যায়।এ ক্ষেত্রে বেতের আসবাব, রট আয়রনের আসবাব, হোগলা পাতার তৈরি আসবাবও রুচিশীল পরিবেশ তৈরি করবে।

ডেকর ইডের আসবাব ডিজাইনার তৌহিদা হক জানান, ‘মানুষের জীবনযাত্রা ও রুচির পরিবর্তনে বদলে গেছে বাড়ি সাজানোর ধরনও। বাড়ি সাজানোর সময় শুধু প্রয়োজন ছাড়াও একটু সৌন্দর্যের ছোঁয়া সবাই চায়। অনুষঙ্গগুলো রুচিকর হলে তা বাড়ির পরিবেশে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলবে।’হোগলা পাতার তৈরি আসবাবগুলো একসঙ্গে দুটি কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারবেন। দম্পতিদের জন্য ডেকোর ইডেতে আছে মিনি প্রিক্স সোফাসেট। এতে আছে একটি দুই সিট, একটি এক সিটের সোফা এবং একটি সেন্টার টেবিল। এর নিচের অংশে ড্রয়ার

 

বানিয়ে নিতে পারেন। এ ছাড়া মোড়া, বেবি চেয়ার, অটোমান চেয়ারগুলো নতুন সংসারের জন্য সাশ্রয়ী ও উপযুক্ত বলে জানান তৌহিদা হক।

দেশীয় উপকরণে তৈরি টেবিল ল্যাম্প, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, ঝুড়ি, শো-পিস দামেও কম হবে, দেখতেও ভালো লাগবে। এগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ছোট গাছ বা মানিপ্ল্যান্ট রাখার পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। দেয়ালে পেইন্টিং ঝোলাতে পারেন। তবে সেটি আপনার ঘরের অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে যাচ্ছে কি না, সেটি খেয়াল করবেন। ঘরের বিভিন্ন কোনায় রাখা টেবিল ল্যাম্পের আলো মায়াবী ও রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করে। দেয়ালে আয়নাও লাগাতে পারেন। আয়নার প্রতিফলনে ঘরকে কিছুটা বড় লাগে। প্রয়োজনীয় চাবি রাখার জন্য দেয়ালেই ব্যবস্থা রাখুন।

স্নানঘরের নান্দনিকতা:
স্নানঘর ছোট হোক কিংবা বড়, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যদি জায়গা থাকে তাহলে ছোট গাছ রাখুন। প্রাণবন্ত ভাব আসবে। ছোট মোমদানি কিংবা দু-একটি শো-পিসও রাখতে পারেন। বেসিনের বা তাকের ওপর জায়গা না হলে দেয়ালেও কোনো কিছু ঝোলাতে পারেন। এতে করে বৈচিত্র্য তৈরি হবে। শাওয়ার কার্টন ব্যবহার করলে সব জায়গায় পানি ছড়িয়ে যাবে না। মেঝেতে ম্যাট্রেস রাখতে পারলে ভালো, ভেজা জায়গায় পা পিছলে পড়ার ভয় থাকবে না। মেঝে সব সময় শুকনা রাখার চেষ্টা করুন।বাথরুমের সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ও অন্যান্য প্রসাধনী রাখার পাত্রের সেট পাওয়া যায়। চাইলে দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কিনে নিতে পারেন। ছোট-বড় কয়েক আকৃতির তোয়ালে রাখুন। কোনোটি হাত মোছার জন্য, কোনোটি গোসলের পর ব্যবহারের জন্য।

বাড়তি একটু জায়গা:
বাড়িতে প্রয়োজনের তুলনায় একটি ঘর বেশি পেলে মনের মতো করে সাজান। সেটাকে টিভি দেখার ঘর কিংবা পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। নিচু বিছানা, উজ্জ্বল নকশার শতরঞ্জি, নিচু চেয়ার, অনেক কুশন দিয়ে বৈচিত্র্য তৈরি করতে পারেন। তবে একটি ঘরের সব আসবাব নিচু হলে দেখতে ভালো লাগবে না। উঁচু আসবাবগুলো পেছনে বা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে রাখুন। নিচু আসবাবগুলো সামনের দিকে রাখুন। সারা দিন পরে যেখানে নিজেদের মতো করে কাটানো যাবে একান্ত কিছু মুহূর্ত। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার জন্যও কিন্তু এমন একটি ঘরের কথাই প্রথমে মনে আসবে।

উজ্জ্বলতা বাড়াতে:
নতুন দম্পতির বাড়িতে রঙের ছটা না থাকলে দেখতে কিছুটা বেমানান লাগে। বাড়িতে উজ্জ্বলতা আনার কিছু জন্য কিছু পদ্ধতির কথা জানালেন এথনিকার স্বত্বাধিকারী নাসিরা মানসুর। উজ্জ্বল রঙের শতরঞ্জি, পর্দা, কুশন ব্যবহারে ঘরে বৈচিত্র্য আসবে। প্রিন্ট করা সুতির পর্দা ব্যবহার করলে ঘরে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারবে। একরঙা পর্দা ব্যবহার করলে প্রিন্ট করা কুশন কভার পছন্দ করুন। উল্টোটাও করতে পারেন। শোবার ঘরের কোনায় সম্ভব হলে ছোট একটা বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। না হলে শতরঞ্জির ওপরেও অনেক রঙের কুশন রাখা যায়। এতে করে বাড়তি বসার জায়গাও হবে, কিছুটা ভিন্নতাও আসবে।

– রয়া মুনতাসীর

ওকে সময় দিচ্ছেন তো?

কাজ তো থাকবেই, তবু দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরকে সময় দেওয়া জরুরি। আধুনিক জীবনে ‘কোয়ালিটি টাইম’-এর কথা উচ্চারিত হচ্ছে বারবার। অর্থাৎ, কতটা সময় দিলাম, তার চেয়েও বড় কীভাবে সময় দিলাম…

ব্যস্ত জীবন। ব্যস্ত দিন। স্বামী-স্ত্রী দুজনরেই দম ফেলার অবকাশ নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুজন দুদিকে। স্বামী তো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিস নিয়েই ব্যস্ত। ওদিকে ভোরে সন্তানদের স্কুলের জন্য তৈরি করে দিয়ে স্ত্রীও অফিসমুখী। শুধু কর্মজীবী স্ত্রীই নন, গৃহিণীর কাজের পরিমাণও কোনো অংশে কম নয়। ভোর থেকে শুরু হয় তাঁর কর্মযজ্ঞ। এই ব্যস্ততার মধ্যে কখন যে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছেন, টেরও পাননি। দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকলেও শেষ কবে খুনসুটিতে মেতেছিলেন, মনে করতে পারছেন না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দাম্পত্য জীবনে কোয়ালিটি টাইম বা গুণগত সময়ের খুব প্রয়োজন। তাহলে অনেক ব্যস্ততার মধ্যে পুরোনো সেই দিনের মতো এখনো ভালোবাসার রেশ থাকে সম্পর্কে। ১০ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকার চেয়ে এক ঘণ্টার গুণগত সময় অনেক বেশি কার্যকর সম্পর্কের বুনটে।

কাজের বাইরে একান্তে

সারা সপ্তাহেই ব্যস্ততা। এর মধ্যেও দুজন দুজনের জন্য খানিকটা সময় রাখতেই পারেন। অফিস থেকে ফেরার পথে স্বামী-স্ত্রী কোনো কফি শপে গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে কিছু মুহূর্ত কাটাতে পারেন। তখন সংসারের হালচাল, সন্তানের ভবিষ্যৎ কিংবা অফিসের সমস্যাগুলো ছাপিয়ে নিজেদের জন্য একটু সময় দিন। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোরশেদা বেগমের মতে, গুণগত সময় মানেই পরিবারের জন্য একান্ত কিছু সময়, যে সময়টুকুতে সব ধরনের সমস্যা দূরে সরিয়ে শুধু ভালোবাসার আবেশে থাকবেন দুজন। তখন পরস্পরের প্রতি অভিযোগগুলো তুলবেন না। তাহলে দাম্পত্য জীবনের অনেক সমস্যা মাথা চাড়া দেবে না।

এই দিন তোমার-আমার

মনে হতেই পারে, কেন প্রয়োজন কোয়ালিটি টাইম? এই তো বেশ ভালো আছি। সংসারের জন্যই তো কাজ করছি। স্বামী-সন্তানের দেখভাল করেই তো জীবন কাটিয়ে দিলাম। তবুও কোথায় যেন বেদনার সুর বাজে। অনেকে তো বুঝতেই পারেন না যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলাফলে কারও কারও ক্ষেত্রে দেখা যায় দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ কিংবা ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি। এটি যেন না হয়। হাজারো কাজের মধ্যে একটি দিন বেছে নিন। সেই দিনে স্বামী-স্ত্রী বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন। রাতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে পারেন। অল্প আয়োজনে রিকশায়ও আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করতে পারেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার বিটপী দাশ সব সময় চেষ্টা করেন পরিবারের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটাতে। ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে না গেলে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে বাড়িতে বসে সিনেমা দেখেন। বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি বলেন, ‘কাজের বাইরে আসলে পুরো সময়টা আমার স্বামী-সন্তানের জন্য বরাদ্দ। সন্ধ্যার চা এবং রাতের খাবার সব সময় স্বামীর সঙ্গে খাওয়ার চেষ্টা করি। এই সময়টুকু না দিলে পারিবারিক বন্ধন মজবুত থাকে না।’

এগিয়ে আসতে হবে স্বামীকেও

শুধু স্ত্রী একাই কোয়ালিটি টাইম নিয়ে ভাববেন, তা নয়। পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য দুজনেরই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে, বিশেষ করে স্বামীদের। তাঁরা অনেক সময় মনে করেন, সব দায়িত্ব শুধু স্ত্রীদেরই। বিষয়টি তেমন হওয়া উচিত নয়। কেউ কেউ ভাবেন, দামি উপহার কিংবা কেনাকাটার টাকা দিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ; বরং স্ত্রীকে হঠাৎ তাঁর প্রিয় কোনো ফুল, বই বা ছোট্ট কিছু দিয়ে অবাক করে দিতে পারেন। ব্যস্ততার মধ্যেও যে তাঁকে মনে রেখেছেন, এতেই স্ত্রী খুশি হবেন। কাজ তো থাকবেই, তবুও অফিস থেকে ফিরে একসঙ্গে এক কাপ চা খেলে ক্ষতি কী?

প্রাধান্য দিন সঙ্গীর পছন্দকে

সবচেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে সঙ্গীর ছোট ছোট পছন্দকে। খুব সূক্ষ্ম ভালো লাগাকে গুরুত্ব দিলে দাম্পত্য জীবন সুখকর হয়ে উঠবে। পারস্পরিক ভুল বোঝাঝুঝি বড় আকার ধারণ করে না, এমনটাই মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান তাহনিয়্যাত আহমেদ। সঙ্গীকে সব সময় বুঝিয়ে দিতে হবে, আপনার জীবনে তাঁর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। পর্যাপ্ত সময় না দিলে তিনি একাকিত্ববোধে ভুগতে পারেন। পরিস্থিতি এমন হওয়ার আগেই দিনের একটি সময় সঙ্গীর জন্য বরাদ্দ রাখুন।

তৌহিদা শিরোপা

পরকীয়া

বিয়ের পর দুই বছর পাড় হয়ে হয়েছে শাহেদ-প্রিয়ার, ভালোই চলছে সবকিছু। এরই মধ্যে সেদিন সকালে শাহেদের মোবেইল ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন এলো অপরিচিত একটি নম্বর থেকে। প্রিয়া দেখলো শাহেদ ফোনটি রিসিভ করছে না। প্রিয়া ভাবলো হয়তো শাহেদের অফিসের কোনো ফোন…

সে প্রতিদিনের মতো শাহেদের বাইরে যাওয়ার জোগার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সব ঠিকঠাক, হঠাৎ প্রিয়া লক্ষ্য করে সে যখন অন্য ঘরে থাকে তখন শাহেদ যেন কার সঙ্গে কথা বলে। তাকে দেখে দ্রুত ফোনটি কেটে দেয়, প্রিয়া জানতে চায় কার ফোন ছিল? উত্তর দিতে কেমন যেন গলা কেঁপে ওঠে শাহেদের। সে একবার বলে অফিসের ফোন তো আরেকবার বলে বন্ধুর। এটা বলে যখন বুঝতে পারে কিছু একটা লুকাচ্ছে এটা প্রিয়া বুঝতে পারছে, সে তখন রেগে যায়। আর তাকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে বলে উল্টো প্রিয়াকেই বকা দেয়।

প্রিয়া শাহেদকে কখনো এই রূপে দেখেনি। এতো বিশ্বাস, ভালোবাসা, একসাথে অনেক কিছু করার স্বপ্ন সবই তাহলে মিথ্যা হতে চললো…তার সুখের সংসার এভাবে ভেঙ্গে যাবে? প্রিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। তারপর প্রিয়া খোঁজ নিয়ে জানে বর্ষা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে শাহেদ নিয়মিত ফোনে কথা বলে, মাঝে মাঝে দেখাও করে। এটা জানার পরে শাহেদ সম্পর্কে আর কিছু জানার মতো মানসিক অবস্থা প্রিয়ার ছিল না…

আমরা নিশ্চিন্তে আমাদের স্বামী, স্ত্রী, ভাইবোন আর সন্তানদের বিশ্বাস করি। আমরা দেখি নিয়মিত তারা কাজের জন্য বের হচ্ছে সময় মতো ফিরেও আসছে কিন্তু আসলে তারা অন্য রকম অসামাজিক কোনো কাজে জড়িয়ে পড়ছে কিনা তার কি খোঁজ রাখছি?

পরিবারের একজনের এধরনের পরকীয়ার সম্পর্ক ধ্বংস করে দিতে পারে ব্যক্তি এবং পারিবারিক বিশ্বাস আর শ্রদ্ধার সম্পর্ককে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মিথ্যা মোহের বশবর্তী হয়ে পরকীয়ার মতো একটি সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত না হয়ে, বিবাহিত জীবনকে আরও সুন্দর এবং সুখী হতে যে বিষয়গুলোর আমাদের চর্চা করতে হবে:

সততা

সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল স্তম্ভ হচ্ছে সততা। প্রতিটি সম্পর্কের বিষয়ে সততা দেখাতে হবে। একজনকে অন্যজনের অনেক কাছে নিয়ে আসবে যখন সে বলতে পারবে,‘যাই হোক তুমি আমার সম্পর্কে সত্যটাই জানবে’।

ক্ষমা

একদিনে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। কোনো ভুল হলে প্রথমেই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়ার চিন্তা না করে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।

বোঝাপড়া

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া থাকাটা খুব জরুরি।

বিশ্বাস

এমন কিছু কখনো করা যাবে না যাতে করে দুজের মধ্যে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র অবিশ্বাসই একটি সম্পর্ক ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

সময় কাটানো

একসঙ্গে সময় কাটাতে আগ্রহী হতে হবে। দুজনের একান্ত সময়টুকু আনন্দময় করে তুলতে নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে হবে।

বন্ধুত্ব

‘বিয়ের আগে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম’। তো, বিয়ের পরে কী হলো? বিয়ের পর সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করতে চাই দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব।

ধৈর্য

দাম্পত্য জীবনের পুরো সময়টাই হানিমুন মুডে থাকতে পারবো…এটা ভাবলে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হতে পারে। দুঃসময় আসতে পারে, এমন অবস্থায় ভেঙ্গে না পড়ে ধৈর্য ধরতে হবে।এক বিয়েতে বিশ্বাস এক সঙ্গীর সঙ্গেই সারাজীবন কাটানোর জন্য মনস্থির করতে হবে।

ভালোবাসা

সব সম্পর্কের মূলে থাকে ভালোবাসা। সঙ্গীর জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে এবং সেই ভালোবাসার প্রকাশও করতে হবে।তবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এরকম অনেক বিষয় নিয়েই সন্দেহ দেখা দেয়, যেগুলোর হয়তো তেমন বাস্তব প্রমাণ নেই। তাই সন্দেহ করার আগে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলে বা খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হন।

আমরা কখনোই চাই না সুখের সংসার কোনো সন্দেহে ভেঙ্গে যাক। কিন্তু এটাও হওয়া উচিৎ নয় যে দিনের পর দিন একজনকে ঠকিয়ে অপরাধী পার পেয়ে যাবে।

সুত্রঃ বাংলা নিউজ ২৪ 

সঙ্গীকে সন্দেহ!

সন্দেহ একটা কঠিন এবং ভয়ংকর অসুখ—সুখী এবং স্বাভাবিক জীবনকে বিনষ্ট করার ছোট্ট একটা মহাষৌধ, সন্দেহ মনে একবার ঝেঁকে বসলে পারিবারিক জীবন তছনছ হয়ে যায়,শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি অব্দি গড়িয়েও যায়-রায়হান আর তনিমার বিয়ের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। প্রেমের বিয়ে, সুখেই কাটছিল দিন। একদিন রাতে পড়ার ঘরে বসে ফোনে কথা বলছে রায়হান। তনিমা ঢুকতেই তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দিল। কিছুটা অপ্রস্তুত। তনিমা জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল? রায়হানের শুকনো জবাব, এই তো এক বন্ধুর সঙ্গে। তনিমা মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে ডায়াল লিস্ট দেখে বুঝল, অপর প্রান্তের মানুষটা রায়হানের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক সহপাঠিনী। তার সঙ্গে রায়হানের হয়তো সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। সেই পুরোনো ঈর্ষার মেঘ সন্দেহের বৃষ্টি ঝরাল তনিমার হূদয়ে। এ ঘটনার জের ধরে শুরু হলো নিত্য কলহ, মান-অভিমান। সুখী দম্পতির ঘরে অসুখি বাতাস।বিষয়টির সমাপ্তি টানতে রায়হান-তনিমা দুজনকেই সেবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয়েছিল। তাঁর নিবিড় পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সুখ ফিরেছিল দুজনের সংসারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রওশন জাহান বললেন, ‘দাম্পত্যে কিছুদিন গড়ানোর পর এ রকম ছোটখাটো খটোমটো লাগতেই পারে। কিন্তু দুজন মিলে কীভাবে সেসব সামাল দেওয়া যাচ্ছে, সেটাই আসল।’ তাঁর মতে, রায়হান যদি তনিমার কাছে খুলে বলত, কার সঙ্গে কথা বলছে, তা হলেই আর জটিলতার সূত্রপাত হতো না। তনিমার মধ্যে হয়তো কিছুটা ঈর্ষা জাগত, কিন্তু তা আকাশকুসুম কল্পনায় গিয়ে ঠেকত না।

রওশন জাহান বললেন, ‘দিনে দিনে আমাদের জীবনযাত্রা জটিল হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে দাম্পত্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যাও বাড়ছে।’ সুখশান্তি আর বোঝাপড়া ঠিক রাখতে তিনি কিছু পরামর্শও দিলেন:

.দুজনের মধ্যেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা দরকার। দরকার নিজেকে সংবরণ করতে পারার ক্ষমতা।
পরস্পরের মতামত, যুক্তিগুলো মন দিয়ে শোনা বা প্রাধান্য দেওয়ার অভ্যাসও থাকা চাই। যে বিষয়ে কথা হচ্ছে, সে বিষয়েই থাকুন। অন্য বিষয় টেনে এনে তিক্ততার জন্ম দেবেন না।
 রাগকে ‘না’ বলুন। রাগ থেকেই দাম্পত্যের যত জটিলতার সৃষ্টি হয়। আর তুচ্ছ বিষয় থেকে জন্ম নেয় বড় কোনো বিপর্যয়।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের পরামর্শক নাদিরা সুলতানা বলছিলেন দাম্পত্যের বিবিধ সমস্যা নিয়ে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পছন্দ বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য (সন্তানের ভালোমন্দ বিষয়ে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা বা সন্দেহ), ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা (কোনো একজন হয়তো অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী), জীবনের অতিরিক্ত চাহিদা, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি সমস্যা নিয়েই তাঁর কাছে আসেন বেশির ভাগ দম্পতি। এ ক্ষেত্রে পরামর্শগুলো হয় এমন:
 কথাবার্তা বা মেলামেশায় উদারতা বজায় রাখা
 সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রাখা
 সঙ্গীর প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলার আগে নিজের সীমাবদ্ধতা বা দোষত্রুটিগুলো মূল্যায়ন করা, নিজেকে কোথায় কতটা পাল্টানো দরকার তা বুঝতে শেখা
 ছোটখাটো সমস্যাকে বড় করে না দেখ
 দুজন মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই, তবে সেসব অমিলের মধ্যেই খুঁজতে হবে মিলগুলো, উপভোগ করতে হবে জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই।
হাজারটা প্রতিবন্ধকতা দাম্পত্যে আসতেই পারে। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই এই সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা নির্ভর করে চর্চার ওপর। তাই কিছু জিনিসের চর্চা করলে দাম্পত্যে বিবাদ এড়িয়ে চলা সম্ভব।
 সঙ্গীকে ভালোবাসার কথা বলুন কারণে-অকারণে। এই বিষয়টি কিন্তু তার মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। সেই সঙ্গে ছোট্ট স্পর্শও হতে পারে হাজারটা কঠিন শব্দের বিকল্প। আমাদের দেশে এর চল নেই। প্রকাশ্যে আমরা সন্তানকেও আদর করতে সংকোচ করি, সেখানে সঙ্গী তো দূরের কথা। ধরুন, হাত ধরে রাস্তা পার হলেন। অফিসে যাওয়ার সময় কপালে একটা ছোট্ট চুমু…। এই স্পর্শে অন্য কিছু নয় বরং সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
 ছোটখাটো মিথ্যে কথা বললে এমন কিছু দোষ নেই, যদি দাম্পত্যজীবনে সুখ থাকে। স্বামী একটা শাড়ি নিয়ে এসেছেন, সেটা খুব বেশি পছন্দ না হলেও তাঁকে বলুন ভালো লেগেছে। স্ত্রী খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করেছেন, খেতে বেশি ভালো না লাগলেও প্রশংসা করুন। এতে কোনো ক্ষতি নেই বরং দাম্পত্যে এমন ব্যবহার প্রয়োজনীয়।
 কোনো একটা কিছু মনের মধ্যে চেপে নিয়ে বসে থাকার দরকার কী? বরং খুলে বলুন। আলোচনা করুন। স্পষ্টবাদী হয়ে উঠুন। স্পষ্ট করে বলুন। বোঝান কী চান। কী সমস্যা। দেখবেন সমাধান হাতের কাছেই আছে।
 আজকাল সবাই অনেক ব্যস্ত। কথা বলার অবকাশই নেই। আর এ থেকেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। সময় বের করুন কথা বলার, নিজেকে ব্যক্ত করার। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে চলে যান। রোজকার তেল-নুনের হিসাব বাদ দিয়ে কী বই পড়লেন, কোন সিনেমাটা দেখা যায়, তা নিয়েই আলোচনা করুন।
 ঝগড়া হবেই—এমনটা সবাই বলে থাকেন। যদি হয়, তবে সে ক্ষেত্রেও মাথা ঠান্ডা রাখুন। পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বুঝিয়ে বলুন, প্রতিবাদ করুন।
কিন্তু একদমই চুপ করে যাবেন না। অনেকে চুপ করে যান। একেবারেই। পরেও কোনো কথা বলেন না। সেটা কিন্তু বিরাট ভুল। মনে রাখতে হবে, এ রকম চুপ করে যাওয়া যেমন ঠিক না, তেমনি নিজেদের সমস্যায় তৃতীয় ব্যক্তির (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়া) হস্তক্ষেপ যেন না হয়। কখনোই সম্পর্কের তিক্ততা অন্যের সামনে প্রকাশ করবেন না।
 কোনো বন্ধুর জন্য দাম্পত্যে সমস্যা বাড়াবেন না। বন্ধু ও জীবনসঙ্গী দুজনের স্থান ভিন্ন। এই বিষয়টি নিজেও মনে রাখবেন এবং সঙ্গীকেও বুঝিয়ে দেবেন।
 সঙ্গীকে বিশ্বাস করাই সম্পর্কের ভিত। একে অপরের বিষয়ে জানাটাও জরুরি।
তাই কী করছেন-না করছেন, পরস্পরকে জানান। এতে বিশ্বাস বাড়বে। না হলে নির্ভেজাল ঘটনাকেও জটিল মনে হবে।

-ফারহানা আলম

বিয়ে – অতনু বর্মণ

রবি ঠাকুর প্রিয়নাথ সেনকে নিজের বিয়ের নেমন্তন্ন জানিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন তার মাথায় লিখিত ছিল – ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’। বিয়ে এমনই এক লঘু রসের সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বাঙালি মানসে। খ্যাতিমান থেকে অখ্যাত সকলের কাছেই বিয়ে এক অনিবার্য রসিকতা। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন – ‘ভাই হে আর যাই কর, বিয়ে কর না’। বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘নিজে তাহলে বিয়ে করলে কেন’? উত্তরে বন্ধুবর কাঁচুমাঁচু মুখে বলেছিলেন – ‘আর করব না’।

দাশুরায় সেই কবে গান বেঁধেছিলেন – ‘সংসার রাঙা ফলে ভুলিও না আর। মিছে মায়া ভুমণ্ডলে অসার অপার’। ছেলেবেলায় সংস্কৃত পণ্ডিত জিজ্ঞেস করেছিলেন উদ্বাহন শব্দটির অর্থ কি? কিছু না ভেবেই বলেছিলাম – গলায় দড়ি। উদ্বন্ধন শব্দটির সঙ্গে হয়তো মিল পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি উদ্বাহন মানে বিয়ে। এইরকমই আর একটি শব্দ আছে – পাত্রসাৎ। শব্দটিকে আমার আত্মসাৎ শব্দের যমজ ভাই বলে মনে হয়। বরং পাণিপীড়ন শব্দটিকেই যথেষ্ট অর্থবহ মনে হতে পারে বিয়ের সার্থক প্রতিশব্দ হিসাবে। অবশ্য পীড়ন শব্দটি আছে বলেই। তবু বিয়ের ফুল ফোটে। প্রজাপতির নির্বন্ধে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায় মোক্ষম ভুক্তভোগী ছেলে-মেয়ের বাপ। এসো, তোমরা খেয়ে-দেয়ে এই নবদম্পতির ভবিতব্যটিকে পোক্ত করে যাও। মালাবদল হয়, কোন কোন সম্প্রদায়ে মালার বদলে কণ্ঠিবদল। তারা বরং অনেক প্র্যাকটিক্যাল। ফুলকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলানোর বদলে তারা শুকনো কাঠিকে সে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। গাঁটছড়া বাঁধা হয়। শুরু হয় গাঁটে গাঁটে বহনের যন্ত্রণা। ঘর বাঁধে মিঞা আর জরু।

আগে বাঙালি জীবনে বিয়ের অনুষঙ্গ ছিল ঘটক বিজড়িত। ঘটকালি ছিল বড় মজাদার পেশা। সেইসব ঘটকরা চিরকালই বাংলা সাহিত্যে কমিক চরিত্রের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। মুকুন্দর চণ্ডীমঙ্গল থেকে এই সেদিন পর্যন্ত ঘটক ছিল সাহিত্যের অনিবার্য চরিত্র। তাঁরা আর নেই। ফাঁসুড়েদের আর প্রয়োজন হয় না, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা স্বয়ং জাটিঙ্গার পাখির মতো বিবাহানলে ঝাঁপ দেয়। ঘটকের মতো কত শব্দই যে বাতিল হয়ে গেল ও যাচ্ছে বাঙালির জীবন থেকে। পাকা কথা, পাটিপত্র, আশীর্বাদ, যোটক বিচার, আইবুড়োভাত, ননদ পুঁটুলি ইত্যাদি শব্দ ধীরে ধীরে আরও অপরিচিত হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। বাঙালির বিবাহকেন্দ্রিক সংস্কৃতি পরিবর্তমান। নতুন নতুন শব্দাগমন কয়েক দশকের মধ্যে জায়গা দখল করেছে। যথা – ক্যাটারার, পার্লার, বিউটিশিয়ান, রেজিস্টার, ডেকোরেটর, লাইটম্যান, ম্যাট্রিমনি ডট কম ইত্যাদি ইত্যাদি। নামবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মালাবদলটি একই আছে। ফলত এ সেই ‘ফুটা পাত্রে জল ঢালা দিবারাত্রে। বৃথা চেষ্টা তেষ্টা ‍মেটাবার’।

তবুও বিয়ে নিয়ে বাঙালির ইয়ের অন্ত নেই। প্রেম করে বিয়ে নাকি বিয়ে করে প্রেম – এই উত্তরটি জানার জন্য প্রাণ হাঁকুপাঁকু করে। যদিও দুটোই প্রায় সমান সমান। আমাদের প্রাণকেষ্টবাবু যেমন বলেছিলেন – ‘তুমি দিব্যি ছিলে, একটা সাপ এসে তোমাকে ছোবল দিল – এটা হল সম্বন্ধ করে বিয়ে, আর সাপটা দিব্যি ছিল, তুমি তার লেজে পা দিয়ে ছোবল খেলে – এটা হল প্রেম করে বিয়ে। যেভাবেই কর না কেন, করেছ তো বাপু বিয়েই’।

বাঙালি জানে এককথায় বিয়ে হয় না। অন্তত সম্বন্ধ করে বিয়ে তো নয়ই। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অথবা বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমে লিস্ট বানানও। চিঠি অথবা ফোনাফুনি। তারপর দেখাদেখি। পছন্দ হলে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে হবু কনে বা বরের চাল-চলন নিয়ে চিরুনি-তদন্ত। ইদানীং আবার এর পরে হবু পাত্র-পাত্রীর একটু-আধটু ঘোরাঘুরিও যুক্ত হয়েছে। একে অপরকে চিনে নাও, জেনে-বুঝে নাও বাপু তারপর সিদ্ধান্ত নিও। পরে কিচাইন হলে যেন বাপ-মা’কে শাপশাপান্ত না করতে পারে তার যথোপযুক্ত প্রিকশান নেওয়া। সব দিক দেখেশুনে বিয়ে তো হয় কিন্তু তাতেই কি সব সমস্যা মেটে, বরং সমস্যা বাড়ে। আমার এক লেখক বন্ধু বলেছিলেন – ‘তুমি তোমার বউকে কতটা ভালবাস, তার ওপর বিবাহিত জীবনের সুখ-শান্তি নির্ভর করে না, তুমি যাদেরকে বিয়ে করলে না, নির্ভর করে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর’। কত ধুমধামের বিয়ে যে শেষ পর্যন্ত ৪৯৮ ঘাটের জল খেয়ে হাজতে ঢোকে তার কোনও পরিসীমা নেই।

আসলে বিয়ে হল অনেকটা তিন-পায়ে দৌড়ের সমগোত্রীয়। বাঁধা পা দু’টো একসঙ্গে আগে ফেলতে হয়। এক ছন্দে দৌড়তে পারলে দিব্যি দৌড়বে, কোনও ঝামেলা নেই। যে যার মতো দৌড়তে গেলেই হুমড়ি খাবে দু’জনেই। সুতরাং হয় নিয়ম মেনে পা ফেলে ছোটো, নয়তো দড়িটা খুলে ফেলে যে যার নিজের পথে হাঁটো। অবশ্য আজকাল বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকা যায়, যার পোশাকি নাম লিভ টুগেদার। সে কাসুন্দি অন্য একদিন ঘাঁটা যাবে, আপাতত দেখুন আজকের ডাকে কোনও বিয়ের চিঠি এল কি না। মানুষ বংশ রক্ষার জন্য বিয়ে করে কিন্তু নেমন্তন্ন রক্ষার জন্য যে বাঁশটা দেয় সেটা আগে সামলান। নিদেনপক্ষে ৫০০ টাকার নিচে কি গিফ্ট দেওয়া যায়!