সঙ্গীর অতিরিক্ত ক্রোধ; কিভাবে সামলাবেন?

ভালোবাসার সঙ্গী যখন ক্রোধপূর্ণ আচরণ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই খারাপ লাগে, কিন্তু এ আচরণ যদি তার স্বভাবে বারংবার কাজ করে তাহলে মানিয়ে নেয়া একটু কঠিনই হয়ে যায় অপর পক্ষের জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক অ্যারন সেল বলেন, “ক্রোধ খুবই জটিল একটি বিষয়।

“”নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করলে বলা যায়, এটি মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত একটি যন্ত্র। আরেকজন ব্যক্তির মাথার ভেতরে ঢুকে নিজেকে ঐ ব্যক্তির কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদ্ধতি। তাদের মন পরিবর্তন করে তাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার একটি প্রক্রিয়া।”

সঙ্গীর এ আচরণ পুনঃ পুনঃ হতে থাকলে একটা সময় ভালোবাসা শেষ হয়ে তিক্ততায় সম্পর্কই ভেঙ্গে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সঙ্গীর অধিক ক্রোধ আচরণের জন্য সম্পর্কে কলহ-দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে যার ফলে সম্পর্ক অসুস্থ অবস্থায় বিরাজ করে।

যে মানুষটি মনের সবচেয়ে কাছে, যে মানুষটিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমরা, তাঁর সাথেই কিন্তু মান-অভিমান হয় সবচেয়ে বেশি! আর তাই অতিরিক্ত ক্রোধ ভালোবাসার মানুষটির সাথেই বেশী প্রকাশ করা হয়। সঙ্গীর চট করে রেগে যাওয়া বা খিটমিটে ক্রোধ কে মানিয়ে নয় সামলিয়ে নিন।

নিজেকে সঙ্গীর স্থানে রাখুনঃ

সবসময় সঙ্গীর স্থানে নিজেকে রেখে দেখবেন, রেগে আপনি সঙ্গীর সাথে যে ব্যবহার করেন, তার স্থানে আপনি থাকলেও একই অভিজ্ঞতা আপনার হবে। কিছুটা হলেও কষ্টটা অনুভব করতে পারবেন।

খোলামেলা আলোচনা করুনঃ

একে অন্যকে ছাড় দেয়া নিয়ে আলোচনা করুন জানার চেষ্ঠা করুন তার রাগের উৎস ও সে কি চায়। তাঁকে বুঝিয়ে বলুন যে রাগ করার ফলে আপনাদের সম্পর্কে কী ক্ষতি হচ্ছে।

সময় বুঝে উত্তর দিনঃ

রাগের মাথায় আপনার সঙ্গী যে আচরণই করুক না কেন আপনি উত্তর দেয়ার সময় ভেবে চিন্তে কথার উত্তর দিন। রাগ কিন্তু সময়ের সাথে শেষ হয়ে যাবে তবে কথা ফেরানো যাবে না। তাই কথা গুলো সতর্ক ভাবে বলতে সময় পাবেন, পরবর্তীতে নিজের কথার জন্য নিজেকে অনুতাপ করতে হবে না।

আলিঙ্গন করুনঃ

ভালোবাসার মানুষটির রাগ ভাঙ্গাতে আলিঙ্গনের বিকল্প নেই। তাকে আলিঙ্গন করে ভালোবাসা প্রকাশ করুন। আপনার ভালোবাসার উষ্ণতায় নিমিষেই গলে যাবে তার মন।

দোষ স্বীকার করুনঃ

এক পক্ষ দোষের কারনে সঙ্গীর রাগ কিন্তু সব সময় চড়া হবেনা তাই নিজের দোষগুলোও স্বীকার করুন। আপনার স্বীকারোক্তি স্বভাব সঙ্গীর ক্রোধ আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে।

শর্ত স্বভাব বাদ দিনঃ

যদি তুমি এমন বলো…বা যদি আমি এমন করি… এ সব বাদ দিন। সঙ্গীর রাগ মানাতে অনেকেই শর্ত গ্রহন করে থাকেন। এ শর্ত থেকে পুনরায় যোগ হয় নতুন রাগের কারন।

থেরাপি প্রয়োগঃ

আমরা যখন রেগে যাই, তখন শরীর এবং মনে খুব অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ তৈরি হয়। পুরো অবস্থাটা থেকে বেরিয়ে আসতে শরীর এবং মন, দু’টোই শান্ত করা প্রয়োজন। সঙ্গীর রাগ সামলাতে তাকে মানিয়ে তার রাগের মুহূর্তে থেরাপি প্রয়োগ করতে পারেন যেমন- ক্রিয়েটিভ, রিল্যাক্সেশন থেরাপি।প্রতিযোগিতা

প্রতিযোগিতা নয় মায়া বৃদ্ধি করুনঃ

সঙ্গীর সাথে রাগ নিয়ে পাল্লা দিতে যাবেন না। দুজন একই সাথে রাগ ধরে রাখলে অথবা রাগ কে প্রতিযোগিতায় নিয়ে গেলে সম্পর্ক খারাপের দিকে অগ্রসর হবে। সঙ্গীর প্রতি মায়া বাড়ান। তার রাগের সময়গুলো কে অবহেলা না করে ধৈর্য ধারন করে সামলে নিন এতে সেও আপনার প্রতি রাগ কমিয়ে আন্তরিক হবে।

সাইকোলজিস্ট বা বিশেষজ্ঞেদের পরামর্শ নিতে পারেনঃ

উপরের বলা কোনও পদ্ধতিতেই যদি সঙ্গীর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বা সাইকোলজিস্টদের সাহায্য নিতে পারেন। কেননা, রাগের আড়ালে কোনও শারীরিক বা মানসিক সমস্যা নিহিত রয়েছে কি না, তা একজন বিশেষজ্ঞই চিহ্নিত করতে পারেন।

বধূ মিছে রাগ কোরো না

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মান-অভিমান হবেই, আবার মান ভাঙাতেও হবে। ছোট ছোট সমস্যা যেন বড় আকার ধারণ না করে।আটটার দিকে বাড়ি ফিরেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্বামী। একের পর এক ফোন সেরে ল্যাপটপ নিয়ে বসা। ওদিকে মুখ থমথমে স্ত্রীর। সারা দিন পর দেখা, একটু হাসিমুখে কথাও বলা হলো না। এতই ব্যস্ততা!ছুটির দিন দুপুরে বসার ঘরে জেঁকে বসে আছে স্বামীর বন্ধুরা। স্বামীকে বারবার ইশারা করেও লাভ হচ্ছে না। ওঠার নাম নেই। একটা ছুটির দুপুর মাটি হয়ে যাবে তাহলে! ব্যস, স্ত্রীর মুখ অন্ধকার।

কিংবা মায়ের পরামর্শ ছাড়া স্ত্রী যেন চলতেই পারছেন না, তাই বলে দুজনের সব কথাই গিয়ে বলতে হবে মাকে? স্বামীর মনে অভিমানের ছায়া।খরচ বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করছেন দুজনই, তাই বলে একটা দিনও কি একটু ভালো রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া যাবে না। এই নিয়ে মতান্তর, শেষমেশ দুজনের কথা বন্ধ।

ছোট ঘটনা, বড় অভিমান। তুচ্ছ কথা-কাটাকাটি থেকে বড় ঝগড়া। কয়েক মিনিটের ঝগড়াতেই আপন এ মানুষকে মনে হতে পারে খুব দূরের কেউ। আর এসবের জের অনেক দূর পর্যন্তও গড়ায়। হয়তো মনে হতে পারে, একটু ঝগড়া হয়েছে এ আর এমন কী। কিন্তু সময়মতো মিটিয়ে না ফেলে তা জিইয়ে রাখা মোটেও উচিত নয়। হয়তো আবার কথা বলা শুরু হলো দুজনের। কিন্তু মনের কোণে একটু ক্ষোভ রয়েই গেল। এভাবেই মেঘের ওপর মেঘ জমে দুজনের জীবনে ফেলতে পারে কালো ছায়া।

‘যত বড় ঝগড়া-ই হোক। সঙ্গী কিন্তু আপনার জীবনের একটা বড় অবলম্বন। একটু অভিমান হয়েছে। তিনি ই কিন্তু আবার আপনার সমর্থনে সারা দুনিয়ার সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত।’ বলেন মনোয়ারা চৌধুরী। শিক্ষকতা পেশায় আছেন তিনি। আর তাঁর স্বামী এস আর চৌধুরী কাজ করছেন গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের মেডিকেল অ্যাডভাইজার হিসেবে। ৪৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে অভিমান, ঝগড়া হয়েছে অনেকবার। কিন্তু কোনোবারই তা মিটে যেতে বেশি সময় লাগেনি বলে জানালেন।ঝগড়া হয়েছে, কথা বন্ধ। এটা যেন দাম্পত্যের অলিখিত নিয়ম।রাগ হলে কে আগে মান ভাঙাতে আসে? সানজিদা আহমেদের (ছদ্মনাম) উত্তর—‘অবশ্যই আমি।

কথা বলা বন্ধ করে আবার নিজেই শুরু করে দিই। আমার এসব মান-অভিমানের পালা সাধারণত ঘটে রাতে ঘুমানোর আগে। সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হতেই আবার শেষ।’আর স্ত্রী রাগ করলে হেঁড়ে গলায় গান ধরাটাকে বেশ ভালো উপায় বলেই মানেন আহসান হাবীব (ছদ্মনাম)। আর এ ক্ষেত্রে ‘তোমার জন্য মরতে পারি ও সুন্দরী…’ এমন লাইনগুলোই নাকি ভালো। ‘গান ধরলে ও প্রথমে একটু রাগ রাগ ভাব করে। তার পরই হেসে ফেলে। ব্যস ঝগড়া শেষ। আমি বলি, আর কোনো দিন এমন হবে না। ও বলে, তুমি তো বারবারই এমন বলো, তার পরও একই কাজ করো। আমি আর কী বলব, বলি, আমি তো এমনই।’ বললেন তিনি।কে আগে মান ভাঙাবে? এগিয়ে আসা একটু কঠিনই বটে। মনোয়ারা চৌধুরী মনে করেন, এ ক্ষেত্রে ছেলেদের এগিয়ে আসাই ভালো। ‘মেয়েরা এমনিতেই একটু বেশি অভিমানী হয়। আবার অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।  ঝগড়ার মুহূর্তটা জিইয়ে না রেখে স্বামী যদি একটু নরম হন, তাহলেই তো হলো।’

দুজনের ঝগড়ায় ভালো কোনো বন্ধু, কাছের আত্মীয়রাও মিটমাটের উদ্যোগ নিতে পারেন। আর সন্তানেরা তো বড় একটা ভূমিকা রাখেই। নিজে হয়তো স্যরি বলতে পারছেন না। সন্তানকেই বলতে পারেন মান ভাঙানোর ব্যবস্থা নিতে। তারা হয়তো সবাইকে নিয়ে আয়োজন করে ফেলতে পারে চমৎকার একটা পার্টি আবার পছন্দের কোনো কিনে আপনার তরফ থেকে উপহার দিতে পারে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার জানান, একজন রেগে গেলে অবশ্যই অন্যজনকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর যে কারণেই মতান্তর হোক, তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করে মতের অমিলটা দূর করতে হবে। তবে ঠিক সেই মুহূর্তেই নয়, বরং পরে দুজনই যখন শান্ত হবেন, তখন আলোচনা করা উচিত। এ নিয়ে কথা না বললে তা চাপা ক্ষোভ হিসেবে জমা হতে পারে, যা পরে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে।তবে নিজেদের ঝগড়ার কথা কাকে বলব আর কাকে বলব না সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই আবার এর সুযোগ নিতে পারে।

যা নিয়েই মতান্তর হোক আদতে তো সেটা মান-অভিমানের দিকেই গড়ায়। আর তা যেন সেখানেই শেষ হয়ে যায়। এর বেশি যাতে না যেতে পারে এদিকে খেয়াল রাখতে হবে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই।

রাগ কিভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখবেন এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন ডাঃ মেখলা সরকার