সঙ্গীকে সন্দেহ!

সন্দেহ একটা কঠিন এবং ভয়ংকর অসুখ—সুখী এবং স্বাভাবিক জীবনকে বিনষ্ট করার ছোট্ট একটা মহাষৌধ, সন্দেহ মনে একবার ঝেঁকে বসলে পারিবারিক জীবন তছনছ হয়ে যায়,শেষ পর্যন্ত ছাড়াছাড়ি অব্দি গড়িয়েও যায়-রায়হান আর তনিমার বিয়ের বয়স প্রায় পাঁচ বছর। প্রেমের বিয়ে, সুখেই কাটছিল দিন। একদিন রাতে পড়ার ঘরে বসে ফোনে কথা বলছে রায়হান। তনিমা ঢুকতেই তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দিল। কিছুটা অপ্রস্তুত। তনিমা জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল? রায়হানের শুকনো জবাব, এই তো এক বন্ধুর সঙ্গে। তনিমা মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে ডায়াল লিস্ট দেখে বুঝল, অপর প্রান্তের মানুষটা রায়হানের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এক সহপাঠিনী। তার সঙ্গে রায়হানের হয়তো সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। সেই পুরোনো ঈর্ষার মেঘ সন্দেহের বৃষ্টি ঝরাল তনিমার হূদয়ে। এ ঘটনার জের ধরে শুরু হলো নিত্য কলহ, মান-অভিমান। সুখী দম্পতির ঘরে অসুখি বাতাস।বিষয়টির সমাপ্তি টানতে রায়হান-তনিমা দুজনকেই সেবার মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হয়েছিল। তাঁর নিবিড় পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সুখ ফিরেছিল দুজনের সংসারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক রওশন জাহান বললেন, ‘দাম্পত্যে কিছুদিন গড়ানোর পর এ রকম ছোটখাটো খটোমটো লাগতেই পারে। কিন্তু দুজন মিলে কীভাবে সেসব সামাল দেওয়া যাচ্ছে, সেটাই আসল।’ তাঁর মতে, রায়হান যদি তনিমার কাছে খুলে বলত, কার সঙ্গে কথা বলছে, তা হলেই আর জটিলতার সূত্রপাত হতো না। তনিমার মধ্যে হয়তো কিছুটা ঈর্ষা জাগত, কিন্তু তা আকাশকুসুম কল্পনায় গিয়ে ঠেকত না।

রওশন জাহান বললেন, ‘দিনে দিনে আমাদের জীবনযাত্রা জটিল হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে দাম্পত্যের ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যাও বাড়ছে।’ সুখশান্তি আর বোঝাপড়া ঠিক রাখতে তিনি কিছু পরামর্শও দিলেন:

.দুজনের মধ্যেই ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকা দরকার। দরকার নিজেকে সংবরণ করতে পারার ক্ষমতা।
পরস্পরের মতামত, যুক্তিগুলো মন দিয়ে শোনা বা প্রাধান্য দেওয়ার অভ্যাসও থাকা চাই। যে বিষয়ে কথা হচ্ছে, সে বিষয়েই থাকুন। অন্য বিষয় টেনে এনে তিক্ততার জন্ম দেবেন না।
 রাগকে ‘না’ বলুন। রাগ থেকেই দাম্পত্যের যত জটিলতার সৃষ্টি হয়। আর তুচ্ছ বিষয় থেকে জন্ম নেয় বড় কোনো বিপর্যয়।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের পরামর্শক নাদিরা সুলতানা বলছিলেন দাম্পত্যের বিবিধ সমস্যা নিয়ে। ব্যক্তিত্বের সংঘাত, পছন্দ বা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য (সন্তানের ভালোমন্দ বিষয়ে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা বা সন্দেহ), ক্যারিয়ার নিয়ে সমস্যা (কোনো একজন হয়তো অতিরিক্ত উচ্চাভিলাষী), জীবনের অতিরিক্ত চাহিদা, অর্থনৈতিক সংকট ইত্যাদি সমস্যা নিয়েই তাঁর কাছে আসেন বেশির ভাগ দম্পতি। এ ক্ষেত্রে পরামর্শগুলো হয় এমন:
 কথাবার্তা বা মেলামেশায় উদারতা বজায় রাখা
 সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রাখা
 সঙ্গীর প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলার আগে নিজের সীমাবদ্ধতা বা দোষত্রুটিগুলো মূল্যায়ন করা, নিজেকে কোথায় কতটা পাল্টানো দরকার তা বুঝতে শেখা
 ছোটখাটো সমস্যাকে বড় করে না দেখ
 দুজন মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই, তবে সেসব অমিলের মধ্যেই খুঁজতে হবে মিলগুলো, উপভোগ করতে হবে জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই।
হাজারটা প্রতিবন্ধকতা দাম্পত্যে আসতেই পারে। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই এই সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা নির্ভর করে চর্চার ওপর। তাই কিছু জিনিসের চর্চা করলে দাম্পত্যে বিবাদ এড়িয়ে চলা সম্ভব।
 সঙ্গীকে ভালোবাসার কথা বলুন কারণে-অকারণে। এই বিষয়টি কিন্তু তার মন ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। সেই সঙ্গে ছোট্ট স্পর্শও হতে পারে হাজারটা কঠিন শব্দের বিকল্প। আমাদের দেশে এর চল নেই। প্রকাশ্যে আমরা সন্তানকেও আদর করতে সংকোচ করি, সেখানে সঙ্গী তো দূরের কথা। ধরুন, হাত ধরে রাস্তা পার হলেন। অফিসে যাওয়ার সময় কপালে একটা ছোট্ট চুমু…। এই স্পর্শে অন্য কিছু নয় বরং সম্পর্কের গভীরতা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
 ছোটখাটো মিথ্যে কথা বললে এমন কিছু দোষ নেই, যদি দাম্পত্যজীবনে সুখ থাকে। স্বামী একটা শাড়ি নিয়ে এসেছেন, সেটা খুব বেশি পছন্দ না হলেও তাঁকে বলুন ভালো লেগেছে। স্ত্রী খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করেছেন, খেতে বেশি ভালো না লাগলেও প্রশংসা করুন। এতে কোনো ক্ষতি নেই বরং দাম্পত্যে এমন ব্যবহার প্রয়োজনীয়।
 কোনো একটা কিছু মনের মধ্যে চেপে নিয়ে বসে থাকার দরকার কী? বরং খুলে বলুন। আলোচনা করুন। স্পষ্টবাদী হয়ে উঠুন। স্পষ্ট করে বলুন। বোঝান কী চান। কী সমস্যা। দেখবেন সমাধান হাতের কাছেই আছে।
 আজকাল সবাই অনেক ব্যস্ত। কথা বলার অবকাশই নেই। আর এ থেকেই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। সময় বের করুন কথা বলার, নিজেকে ব্যক্ত করার। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে চলে যান। রোজকার তেল-নুনের হিসাব বাদ দিয়ে কী বই পড়লেন, কোন সিনেমাটা দেখা যায়, তা নিয়েই আলোচনা করুন।
 ঝগড়া হবেই—এমনটা সবাই বলে থাকেন। যদি হয়, তবে সে ক্ষেত্রেও মাথা ঠান্ডা রাখুন। পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে বুঝিয়ে বলুন, প্রতিবাদ করুন।
কিন্তু একদমই চুপ করে যাবেন না। অনেকে চুপ করে যান। একেবারেই। পরেও কোনো কথা বলেন না। সেটা কিন্তু বিরাট ভুল। মনে রাখতে হবে, এ রকম চুপ করে যাওয়া যেমন ঠিক না, তেমনি নিজেদের সমস্যায় তৃতীয় ব্যক্তির (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছাড়া) হস্তক্ষেপ যেন না হয়। কখনোই সম্পর্কের তিক্ততা অন্যের সামনে প্রকাশ করবেন না।
 কোনো বন্ধুর জন্য দাম্পত্যে সমস্যা বাড়াবেন না। বন্ধু ও জীবনসঙ্গী দুজনের স্থান ভিন্ন। এই বিষয়টি নিজেও মনে রাখবেন এবং সঙ্গীকেও বুঝিয়ে দেবেন।
 সঙ্গীকে বিশ্বাস করাই সম্পর্কের ভিত। একে অপরের বিষয়ে জানাটাও জরুরি।
তাই কী করছেন-না করছেন, পরস্পরকে জানান। এতে বিশ্বাস বাড়বে। না হলে নির্ভেজাল ঘটনাকেও জটিল মনে হবে।

-ফারহানা আলম

প্রকাশ করেছেন

Best Marriage Media Bangladesh

Best Marriage Media in Bangladesh | Bibahabd is the Leading Bangladeshi Matrimony website, Provides online and offline matchmaking service for marital relationship.

মন্তব্য করুন