সংসারের রসায়ন

প্রাচীন যুগের প্রারম্ভে জনৈক উদ্দালকের শিশুপুত্র উজ্জীবন একদিন সন্ধ্যায় খেলা শেষে বাড়ি ফিরে এসে তার মাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। বাবা উদ্দালক বিষণ্ন মনে বারান্দার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। উজ্জীবন বারবার তার বাবাকে প্রশ্ন করল—মা কোথায়? আমাকে বলো, আমার মা কোথায়? উদ্দালক হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন এবং মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লেন। পুত্র পিতার প্রতি মারমুখী হয়ে উঠল—সত্যি করে বলো, আমার মা কোথায়…?

উদ্দালক দুই হাঁটুর মধ্যে থুতনি রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন—তোর মাকে কতগুলো অচেনা লোক এসে ধরে নিয়ে গেছে। সাত বছর বয়সী উজ্জীবন বলল—কেন?

—ওদের মধ্যে একজন তোর মাকে খুব পছন্দ করত।

—তা কেন হবে বাবা? তুমি ওদের বাধা দিলে না কেন? মাকে ধরে রাখলে না কেন?

—ওকে ধরে রাখার কোনো অধিকার আমার নেই। এত বছর আমার সঙ্গে থেকেছে। তোর জন্ম হয়েছে, কিন্তু আইনত ও আমার কেউ নয়। ও যে আমার স্ত্রী

—এ রকম প্রমাণ আমি দিতে পারিনি। কারণ আমাদের তো বৈধ কোনো সম্পর্ক ছিল না।

জনশ্রুতি রয়েছে উদ্দালকের সেই ছেলেই বড় হয়ে একদিন সমাজে নর-নারীর সম্পর্কের বৈধতা—অর্থাৎ বিবাহের প্রথাটি চালু করে। পরবর্তী সময়ে সভ্যতার ঊষালগ্নে এসে এক ধরনের যুক্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে নৃবিজ্ঞানীরা বিয়ে সম্পর্কিত একটি বিশ্বজনীন তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কোনো কোনো নৃবিজ্ঞানী এই তত্ত্ব নির্মাণে মনোবিজ্ঞান, দৈহিক নৃবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞানের সাহায্য নেন। আবার কেউ কেউ এর একটি নিরেট সামাজিক ব্যাখ্যাও দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।

বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনা। তারপর আসে পারিবারিক সদস্যদের সহযোগিতা এবং পরামর্শ।

বিয়ের আগেই দেখা দরকার দুই পক্ষের পারিবারিক সমতা, ক্ষমতা এবং পাত্রপাত্রী দুজনের ব্যক্তিত্ব আর যোগ্যতার মাপকাঠি সঠিক বিন্দুতে রয়েছে কি না। সেটি বয়স হতে পারে, শিক্ষাগত যোগ্যতা হতে পারে, আবার বাহ্যিক সৌন্দর্যও হতে পারে। ভবিষ্যতে এ দুটি পরিবারের মধ্যে কোনো রকম সম্মান-শ্রদ্ধার ঘাটতি দেখা দেবে না তো? বংশ মর্যাদা নিয়ে কেউ কারও ওপর খড়্গ তুলবে না তো? তবে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বনিবনা না হলেও দুজনে দুজনের প্রতি বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং ভালোবাসা থাকলে কোনো অশুভ শক্তি তাদের মধ্যে ভাঙন ধরাতে পারবে না। বিয়ে টিকিয়ে রাখার জন্য শুধু দায়সারা সংসার করাটাই শেষ কথা নয়।

বিবাহিত জীবনকে সার্থক-সুন্দর এবং মধুময় করে তোলার উপায় হচ্ছে তিনটি:

এক. শ্রদ্ধা, পরস্পরের প্রতি।

দুই. বিশ্বাস, দুজন দুজনকেই।

তিন. ভালোবাসা, একে অপরের প্রতি। এর সঙ্গে কর্তব্যবোধটিকেও সংযুক্ত করতে চাই। সন্দেহ একটি সাংঘাতিক অসুখ। ক্যানসারের মতো। এটিকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে দিতে হবে। কান কথা শোনা আরেকটি অসুখ—যক্ষ্মার মতো। আমরা দেখেছি, একটি মেয়ে কখনোই সংসার এবং সন্তান ছেড়ে পালাতে চায় না। যতই অত্যাচারী স্বামী থাক তার ঘরে। কিন্তু পরকীয়া করে এমন স্বামীকে কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারে না।

সদ্য বিবাহিত একজন স্বামী তাঁর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটে গেলেন এবং তার মা, বোন এবং ভাগনি জামাইয়ের জন্য ঈদের জামা-কাপড় কিনে ১০ টাকার চীনাবাদাম চিবাতে চিবাতে রিকশায় চেপে বাড়িতে এলেন এবং স্ত্রীকে বললেন—ওগুলো সব সুন্দর করে প্যাকেট করে রেখে দাও, কাল গিয়ে দিয়ে আসব। অল্পবয়সী স্ত্রীর তখন মনের অবস্থা কী রকম হতে পারে? রাগ, দুঃখ, নাকি অভিমান? মাত্র তিন দিন বাকি ঈদের। বিয়ের পর এই প্রথম ঈদ বলে কথা!

প্রিয় পাঠক ভাবতে পারেন—দূর! এ-ও কি হতে পারে? নাকি হয়? চল্লিশ বছর আগে হয়েছিল। এ আমার চোখের দেখা। সবার প্রতি কর্তব্য পালন করবে আর স্ত্রীর প্রতি করবে না—এটা তো নির্বোধের কাজ। স্বামীর পক্ষের আত্মীয়স্বজন এলে পোলাও-মাংস রান্না করার হুকুম আসবে আর স্ত্রীর পক্ষের কেউ এলে যদি কোনো স্বামী বলেন—কী চায় এই অসময়? কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে বিদায় করো। তাহলে কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে শ্রদ্ধা করবে? এবং এভাবেই কিন্তু মন ভাঙতে ভাঙতে ঘর ভাঙার চিন্তা আসে। তিক্ততার সৃষ্টি হয় তুচ্ছ কারণেই। তাই মন থেকে ক্ষুদ্রতা এবং তুচ্ছতাকে সরিয়ে রাখতে হবে ভালো থাকার জন্য।

স্ত্রী যদি কখনো কখনো স্বামীর চেয়ে একটু বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে ওঠেন—তখন স্বামীর উচিত তাকে সম্মান করা। প্রশংসা করা কিংবা আনন্দিত হওয়া। এর উল্টোটা হলেই সংসারে অশান্তি আসে। অযোগ্য স্বামীরাই আস্ফাালন করেন বেশি। তাঁরা ভাবেন বউকে দাবিয়ে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়—‘প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে বড়াই। জেন মনে তাহার তখন বিধির সঙ্গে লড়াই।’ সংসারের বয়স যত বাড়ে; সন্তান যত বড় হবে। বাবা-মার সম্পর্কটা ততই পোক্ত এবং বিশ্বস্ত হওয়ার কথা। তবেই তো ছেলেমেয়েরা বাবা-মার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে।

একজন স্ত্রীকেও বুঝতে হবে তাঁর স্বামীর সার্বিক ক্ষমতা কতটুকু—সে অনুযায়ী তাঁর চাহিদা থাকতে হবে। অমুকের স্বামীর অত বড় বাড়ি, দামি গাড়ি এসব উদাহরণ দিয়ে স্বামীকে বিব্রত করা ঠিক নয়। স্বামীর বিশ্বাস এবং ভালোবাসার কাছে অন্য কিছুর প্রয়োজন কিন্তু মূল্যহীন।

ছেলেমেয়েরা যখন বড় হয়ে যায়, ওঁরা নিজেরা নিজেদের সংসার সন্তান-স্ত্রী নিয়ে একটি স্বতন্ত্র জগৎ গড়ে নেন এবং এটিই স্বাভাবিক। বয়সী বাবা-মার খোঁজখবর তাঁদের পক্ষে সব সময় নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। সব ক্ষেত্রে ওঁদের দোষারোপও করা যায় না। বৃদ্ধ বয়সে নিজেরা নিজেদের কাছে আন্তরিক হতে হবে। একজন রোগাক্রান্ত হলে অন্যজনের দেখাশোনা করার মানসিকতা থাকতে হবে। কিন্তু মধ্য বয়স থেকে যদি দুজনে দুজনের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে থাকে, তাহলে কিন্তু সমূহ বিপদ। কে কাকে দেখবে।

তাই দুজন দুই ঘরে দুই প্রান্তে না থেকে একবার এসে হাতটা ধরুন। মাথায় হাত রাখুন। কিংবা সেই চল্লিশ বছর আগের একটি সুন্দর স্মৃতির কথা ভাবুন। একজন আর একজনকে বুঝতে চেষ্টা করুন। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য একজন অন্যজনের কাছে ক্ষমা চাওয়া কোনো অপমান নয়—নিজেকে ছোট করাও নয়। বরং একে অন্যের কাছে বিশুদ্ধ হওয়া, ভবিষ্যতে এ রকম ভুল আর হবে না। এ মনোভাব ব্যক্ত করা উচিত। মনে রাখা উচিত, একরোখা গোঁয়ার্তুমির জন্য যেন ঘর ভেঙে না যায়। মনের ঝড় থেকে ঘরের ভাঙন ঠেকাতে হবে যে!

লেখক:নাসরীন নঈম
Prothom Alo 

প্রকাশ করেছেন

Best Marriage Media Bangladesh

Best Marriage Media in Bangladesh | Bibahabd is the Leading Bangladeshi Matrimony website, Provides online and offline matchmaking service for marital relationship.

মন্তব্য করুন