মানুষ কেন পরকীয়ায় জড়ায়

ইউকিপিডিয়ার মতে পরকীয়া (ইংরেজি: Adultery বা Extramarital affair বা Extramarital sex) হল বিবাহিত কোন ব্যক্তির (নারী বা পুরুষ) স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির সাথে বিবাহোত্তর বা বিবাহবহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক ও যৌন কর্মকান্ড। মানবসমাজে এটি লঘু বা গুরুভাবে নেতিবাচক হিসেবে গণ্য পাশ্চাত্য আধুনিক সমাজে এর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব বজায় থাকলেও এটি আইনত অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না, তবে অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরকীয়াকারী ব্যক্তির বিবাহিত সঙ্গী তার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কোর্টে আবেদন করতে পারেন।

তবে কিছু ইসলামি রাষ্ট্রসমূহে এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যা হল পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড প্রদান। মনোচিকিৎসায় একথা স্বীকৃত যে, পিতামাতার পরকীয়া সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এবং সামাজিক সম্পর্ক ও যোগাযোগে বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সন্তানের মানসিক বিষন্নতার ও আগ্রাসী মনোভাবের জন্ম দেয়। এছাড়া পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিতে পরকীয়া প্রভাব রাখে ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন –

“মনোদৈহিক ও সামাজিক কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। প্রথমে আসে দৈহিক বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন সম্পর্কে অতৃপ্তি থেকে অনেকে এ সম্পর্কে জড়ায়। সেক্স মানুষের একটি শরীরবৃত্তীয় চাহিদা। যদি স্বামী-স্ত্রীর যৌনজীবন দুর্বল হয়, তাহলে অপর ব্যক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হতে পারে। কারো মধ্যে যদি DRD4 জিনের উপস্থিতি বেশি হয়, তাঁদেরও পরকীয়া বা বাড়তি সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা থাকতে পারে।

অনেক সময় মানসিক সমস্যার কারণেও মানুষ পরকীয়ায় জড়াতে পারে। যাঁদের মধ্যে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আছে, তাঁদের পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তাঁরা কোনো কিছুর মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পায় না।

সঙ্গীর উদাসীনতা ও দূরত্বের কারণেও অনেক সময় মানুষ পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী বাস্তবতার কারণে, কাজের কারণে হয়তো দূরে চলে যায়। তখন তাঁদের মধ্যে পরকীয়ার আগ্রহ বাড়ে। অনেক সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচ নিজেদের মধ্যে আনতে চায়, তখন পরকীয়া বাড়ে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, দূরত্ব ইত্যাদির জন্যও অন্যের প্রতি আগ্রহ, আসক্তির ঘটনা ঘটে”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষার বলেন –

“প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পরকীয়ার বিষয়টি চলে আসছে। উন্নয়ন ও মঙ্গলের কথা চিন্তা করে মানুষ একগামী। তবে মানুষ মূলত বহুগামী। পরকীয়াতে যেকোনো একজনকে বিবাহিত হতে হবে অথবা দুজনই বিবাহিত থাকতে পারেন”।

মানুষ কেন পরকীয়ায় জড়ায় –

এ বিষয়ে তানজির আহম্মদ বলেন – “এক ধরনের প্রয়োজন বা চাহিদার কারণে মানুষ পরকীয়ায় জড়ায়। অনেক সময় শারীরিক প্রয়োজন থাকে। আর্থিক প্রয়োজন থাকে। স্ট্যাটাস বাড়ানোর জন্যও কেউ কেউ পরকীয়ায় জড়ায়। অনেক সময় মানসিক প্রয়োজন থাকে। আবার কিছু বিষয় শেয়ার করতে করতে অনেকে একসময় পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়।

অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকেও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তে পারে, আবার অনেক সময় অবস্থার কারণেও হয়তো পরকীয়ায় জড়ায়। হতে পারে একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেল। একপর্যায়ে হয়তো ভালো লেগে গেল। তখনও পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। আবার দীর্ঘসময় একসঙ্গে কাটাতে কাটাতে, বন্ধুত্ব থেকেও অনেক সময় পরকীয়া হয়ে যায়। অনেকে শখ থেকেও পরকীয়ায় জড়ায়।

অন্য আরেকটি শরীর কেমন, একে জানার একটি আগ্রহ থাকে। অনেকে আবার ভাবে, ‘ওরা কি সুখী! এই মানুষটির সঙ্গে থাকতে পারলে হয়তো আমার অনেক সুখ লাগত।’ এ থেকেও অনেকে ওই ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ অনুভব করে। অনেক সময় মিডিয়াও পরকীয়ার প্রবণতা তৈরি করে। বিভিন্ন ধরনের পর্নোসাইট দেখে পরকীয়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হতে পারে। আসলে অধিকাংশ মানুষেরই একটি বাড়তি চাহিদা থাকে। তবে সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মনীতির কারণে এ সম্পর্কে জড়ায় না। অনেকে কিছু সুবিধা আদায়ের জন্য পরকীয়া করে জানিয়ে তিনি বলেন, হয়তো আর্থিক সাহায্য পাবে এ সম্পর্কে জড়ালে, এমন ভাবনা থেকেও কেউ কেউ পরকীয়ায় জড়ায়”।

সাইকোলজিস্ট ইশরাত জাহান বীথি বলেন –

পরকীয়ার পেছনে জড়ানোর একটি বড় কারণ হলো শূন্যতা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন শূন্যতা তৈরি হয়, তখন আরেকজন সেখানে প্রবেশ করে। হয়তো স্বামী বা স্ত্রীর আর আগের মতো করে কথা বলে না বা আদর করে না। যত্ন কম নেয়। এই বিষয়গুলোর কারণে অন্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। স্বামী-স্ত্রী দূরে থাকলেও এ সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের বিয়ের আগে হয়তো যৌন চাহিদা তেমন থাকে না। বিয়ের পর তাঁরা বুঝতে পারে বিষয়টি। শুধু যৌনতায় অংশগ্রহণ নয়, কথাবার্তায়ও বিষয়টি থাকতে হয়। তখন যদি অন্য কেউ সেই কথাগুলো শোনায়, তাহলে তাঁর প্রতি আগ্রহ কাজ করে।

শারীরিক গঠন এ ব্যাপারে কাজ করতে পারে। কিছু কিছু ছেলে চিকন স্বাস্থ্যের মেয়ে পছন্দ করে। আবার কিছু কিছু ছেলে হয়তো একটু স্থুল স্বাস্থ্যের মেয়ে পছন্দ করে। সন্তান হওয়ার পর অনেক মেয়ে স্থুল হয়ে যায়। এতে স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে। আবার নারীর বেলায়ও অনেকে হয়তো খুব হ্যান্ডসাম ছেলে পছন্দ করে, যা হয়তো তাঁর স্বামীর সঙ্গে মেলে না।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোট ছোট চাওয়াগুলো হয়তো পূরণ হচ্ছে না। হয়তো স্ত্রী চাঁদ দেখতে পছন্দ করে, স্বামী সেটিকে বিলাসিতা মনে করে। এ রকম সময় অন্য কেউ যখন সেই জায়গায় আসে, তখন নির্ভরতা বেড়ে যায়। আবার অনেকে ভাবে, আমি তো একসঙ্গে দুটোকেই ব্যালেন্স করছি। তাই আমি এমন একটি সম্পর্ক করতেই পারি।

আবার অনেকে মনে করেন, স্বামী বা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও খুব ভালো একজন বন্ধু অথবা বান্ধবী থাকতে পারে। যার সঙ্গে মানসিক শেয়ারিং ও শারীরিক সম্পর্ক—দুটো বিষয়ই থাকতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। কারণ, বন্ধুত্বের সম্পর্কে কোনো প্রতিজ্ঞা নেই। যে কেউ যেকোনো সময় হয়তো এখান থেকে সরে আসতে পারে। একে অনেকে পরকীয়া বলে মনে করে না।

আবার অনেকে বিবাহবিচ্ছেদের পর বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে চায় না। বিবাহিত কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে চায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর বিষয়টিই এখানে মুখ্য হয়। এসব ভাবনা ব্যক্তিকে পরকীয়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে বলেই মনে করেন ইশরাত শারমীন রহমান।”

নারী-পুরুষের যৌন অধিকার বনাম বৈষম্যমূলক আইন!

একজন নারী যে কারও সাথে যে কোনও ধরণের যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।  নারীর এ যৌনতায় আইনে কোথাও কোনও বাঁধা নেই। নারীকে দণ্ড দেওয়ার কোন বিধানও বাংলাদেশের আইনে নেই।  আবার পুরুষের ক্ষেত্রেও যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আইনগত কোন বাঁধা নেই।

বলা আছে, যে কোন প্রাপ্ত বয়স্ক কুমারী, বিধবা এবং বিবাহ বিচ্ছেদে একা হয়ে যাওয়া নারীর সাথে সম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে।  নারী-পুরুষের এ যৌনতায় আইনে বাঁধা নেই কিন্তু সমাজে বাঁধা আছে, ধর্মে বাঁধা আছে, লালিত মনস্তত্ত্ব ও মূল্যবোধে বাঁধা আছে।  সেকারণে, সমাজে যৌনতার চৌর্যবৃত্তি অনেক বেশি। তবে পৃথিবীর অনেক দেশেই নর-নারীর যৌন সম্পর্ক একেবারেই জৈবিক, স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত ব্যাপার। সেখানে যৌনতা মানুষের মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত।

ভারতের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এ কে সিক্রি ২০১৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আলোচনা সভায় বলেন মহিলার যৌন অধিকারের অর্থই হল তার পছন্দের পুরুষের সঙ্গে তিনি যৌন মিলন করবেন, তাকে তার স্বামী হতেই হবে, এমন কোনও মানে নেই। তিনি বলেন, একজন মহিলার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে তার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টি। তিনি তার নিজের শরীরের সঙ্গে কী করবেন আর কী করবেন না তা সর্ম্পূণ নির্ভর করছে সেই নারীর ওপর। এটা নারীর শরীর, তাই অধিকারও তারই।

পৃথিবীর সকল দেশেই যৌনতার সীমানা সেখানকার আইন, সামাজিকতা ও সাংস্কৃতিক বোধের দ্বারা নির্ধারিত। তবে সীমানাটি কোথাও বিস্তৃত, কোথাও সংকীর্ণ। যৌনতার ক্ষেত্রে অতি প্রাচীনকাল থেকে গড়ে ওঠা একটি সীমানা হচ্ছে বিয়ে। যৌন সম্পর্ক স্থাপন এবং বিয়ের ক্ষেত্রে বয়স আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মেয়ের বয়স ১৮ আর ছেলের বয়স ২১ আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে পাই যে, ১৬ বছর বয়স যে কোন মেয়ের বিবাহের জন্য বিবেচনাযোগ্য একটি বয়স। পাশাপাশি ১৬-১৮ বছর বয়সের নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যৌন মিলনকে এ আইন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।

কোনও পুরুষ যদি ১৪ বছর কিংবা ১৪’র অধিক বয়সের কোনও নারীর সাথে (পারস্পরিক সম্মতিতে) যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তাকে দণ্ডবিধি অনুযায়ী ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে না। তবে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে। কারণ ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও নারী যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অনুমতি দিতে পারে না। দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী স্ত্রী ব্যাতিত ১৪ বৎসরের কম বয়স্ক কোনও নারীর সাথে তার সন্মতিক্রমেও যৌনকর্ম করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হয়।

উপরের দুটি আইন বিশ্লেষণে আমরা যা পাই তাহলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সম্মতি দেবার বয়স ১৬ বছর। আর দণ্ডবিধি অনুযায়ী ১৪ বছর বয়স পূর্ণ হলে একটি মেয়ে কোনও পুরুষকে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সম্মতি দিতে পারে। অথচ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী নারীর ১৮ বছরের আগে বিয়ে করার অধিকার নেই।

একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সে দেশের সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন। আবার ২৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুসারে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করতে পারে।

এদিকে ১৮ বছর বয়সী যে কোন নারী পুরুষ সাবালক-সাবলিকা হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম উঠছে এবং তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন, নিজের মতামত প্রকাশ করছেন। অথচ জীবন সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষের বয়স হতে হচ্ছে ২১ বৎসর।

দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বিয়ের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য ব্যাভিচারকে দুস্কর্ম এবং অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, “কোনও লোক যদি, অপর কোনও নারীর স্বামীর বিনা সম্মতিতে যৌনসঙ্গম করে, এরূপ যৌনসঙ্গম ধর্ষণের অপরাধ না হলে, সে লোক ব্যাভিচার করেছে বলে পরিগণিত হবে। এর জন্য ওই পুরুষকে যেকোনও বর্ণনার কারাদণ্ডে (যার মেয়াদ সাত বছর পর্যন্ত হতে পারে) বা জরিমানা দণ্ডে বা উভয় দণ্ডে শাস্তিযোগ্য হবে। এরূপ ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকটির পরকীয়া কিংবা দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী হিসেবে শাস্তিযোগ্য হবে না”। 

পরকীয়ার অপরাধ শুধু পুরুষের জন্য, নারীর জন্য নয়।  আবার নারী যদি অবিবাহিতা বা বিধবা হয় তাহলে পুরুষও কোনও শাস্তি পায় না।  কারণ এক্ষেত্রে মামলার বাদী হওয়ার মত কেউ থাকেনা।

তবে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট বলেছেন, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না যে, তারা ব্যাভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।

দণ্ডবিধি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের মধ্যে বিয়ের বয়স নিয়ে বিরোধ আছে। এ বিরোধের ফলে একটি মেয়েকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন, প্রেমঘটিত কারণে কোনও কিশোরী যদি অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া তার প্রেমিককে বিয়ে করে তবে মেয়ের অভিভাবক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উক্ত প্রেমিক এবং তার অভিভাবকদের বিরুদ্ধে অপহরণ বা ধর্ষণ অথবা উভয় ধরনের মামলা করে এ অজুহাতে যে, তাদের মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। বয়স প্রমাণের জন্য কোনও সনদপত্রের আইনগত বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা ও এর প্রয়োগ নেই বিধায় মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্কও হয় তবুও এ ধরনের মামলা করার সুযোগ আছে।

মামলা হবার পর মেয়েটিকে নিয়ে তার অভিভাবক, পুলিশ এবং তার প্রেমিক পক্ষের লোকজনদের মধ্যে টানাহেঁচড়া শুরু হয়। এর পরিণতিতে মেয়েটিকে প্রায়শঃ নিরাপদ হেফাজতের নামে জেলখানায় যেতে হয়। স্বেচ্ছায় বাল্যবিবাহকারী কিংবা বাল্যবিবাহের শিকার একটি মেয়ে যতকাল প্রাপ্তবয়স্কা না হবে তত কাল তাকে নিরাপত্তা হেফাজতের জন্য জেলে রাখার আদেশ দিতে পারে আদালত। এর ফলে হাজার হাজার মেয়ে দিনের পর দিন জেল খাটছে। 

আবার পুরুষের বিয়ে করার অধিকার তৈরি হয় ২১ বছরে। তবে কম বয়সে বিয়ে করলেও ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরুষকে জেলে থাকতে হয় না। অথচ অল্প বয়সে কোনও মেয়ের বিয়ে হলে যতদিন না তার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয় ততদিন সেই মেয়েটিকে জেলে থাকতে হয়। মানুষ এখানে আইন মানতে চায় না। কিন্তু সমাজ বাস্তবতাকে মানে।

ধর্মীয় বিশ্বাস বলছে, তুমি যদি যৌনতা চাও তবে বিয়ে কর। বয়স কোনও বিষয় নয়। সুরা নিসা বলছে ‘ শিশুরা যখন স্বপ্নে বীর্যপাত করে তখন তাদের শৈশব অতিক্রম করে সাবালকের সীমায় পৌছে যায়।’

আমাদের আইন, রাষ্ট্র, সংবিধান ও সামাজিক আচরণে আজব সব বৈপরীত্য! পৃথিবীর তাবৎ সহানুভূতি ঢেলে দেওয়া হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার প্রতি; সাহিত্যে, কলায়, রসবোধে, জীবনের সর্বত্র কিশোর প্রেমকে উপজীব্য করা হচ্ছে; তরুণ মনস্তত্ব ও মূল্যবোধকে প্রেমের প্রতি সহানুভূতিশীল করে গড়ে তোলা হচ্ছে। অথচ নরনারীর প্রেমবোধের বিজ্ঞানকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। অবৈজ্ঞানিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইনে মানুষকে বেঁধে ফেলার উপকার ও অপকারের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার জন্য আইনজ্ঞ বিজ্ঞজনদের প্রতি অনুরোধ রইল।

সর্বশেষ রাষ্ট্রযন্ত্রের সমীপে নিবেদন এই,
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন মানুষকে স্বাধীনতা বঞ্চিত করে, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক নারী-পুরুষের অধিকার ও সুবিধা-অসুবিধা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই। কাজেই মানবিকতার দিক দিয়ে হলেও এ আইনের শীঘ্রই সংশোধনের প্রয়োজন। খুব অবাক হই, আমরা কীভাবে মানবিকতা ভুলতে বসেছি।

একুশ শতকের দোরগোড়ায় যেখানে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে মহাকাশেও পা বাড়িয়েছি, সেখানে আজও নারী-পুরুষের অধিকার, তাদের ইচ্ছাকে বেঁধে রেখে দিয়েছি। যৌনতাকে এখনও আমরা মানবিকতার চোখে দেখি না, এটা খুবই কঠোর বাস্তব।

লেখক: সিরাজ প্রামাণিক
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীগবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।  
সুত্রঃ lawyersclubbangladesh