ভাঙার আগে-পরে

আমি ওকে কেবল আবার একটা ফোন দিতে চাই। যদিও আমি জানি এটা ঠিক হবে না। ও কেবলই আমার সঙ্গে চিৎকার ও দুর্ব্যবহার করবে আমি জানি। এটা ভেবেই আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি বাইরে কাজ-কর্ম করতে পারছি না। একেবারেই মনোযোগ দিতে পারছি না। আমি চিৎকার করে সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আমি ভালো নেই। কিন্তু আমি জানি, তারা আমাকে কাপুরুষ ভাববে। আমি স্বপ্নাকে ছাড়আর কিছুই ভাবতে পারছি না। আমি দিনে দিনে নিঃশেষ হতে যাচ্ছি।

এটি সম্প্রতি বিয়ে ভেঙে যাওয়া এক পুরুষের নীরব আর্তচিৎকার। তিনি ভেবেছিলেন সম্পর্কটি পুনরুদ্ধার করা যায় কিনা। স্ত্রী ও সন্তান থেকে দূরে থাকার ভয়ে তিনি ভীত। হতাশা আর অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। কাজকর্মে নিজেকে আগেরমতো সক্রিয় রাখতে পারছেন না।কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর এমন প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরুষ বা নারী যেকারো জন্যই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এক তীব্র মানসিক ও সামাজিক বিপর্যয় হিসেবে কাজ করে। বৈবাহিক সম্পর্ক আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

বৈবাহিক সম্পর্কে ‍সুখী হওয়া না হওয়া নানা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আবার বিবাহিত জীবনের নানা পর্বের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোও বেশ কঠিন বিষয়। অবাস্তব প্রত্যাশা, দায়িত্বহীনতা, স্বামী বা স্ত্রীর কাজের মাত্রা-ধরণ, শ্বশুড়-শাশুড়ি ও পরিবারের অন্য সব সদস্যের সাথে মানিয়ে চলা, আর্থিক সমস্যা, যোগাযোগ দক্ষতার অভাব, অবিশ্বস্ততা বৈবাহিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে ভূমিকা রাখে।

সম্পর্কে বিচ্ছেদ ধরার ক্ষেত্রে একক কোনো কারণ নেই। এটি শুরু হয় নানা প্রকিয়ার ভেতর দিয়ে। কখনও কখনও একজন সঙ্গী আলাদা থাকার হুমকি দিয়ে অন্য সঙ্গীর আবেগীয় প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নেয়। এই সংসারে আমি আর পারছি না। আমি চলে যাবো। এ জাতীয় কথাবার্তা মূলত যিনি সম্পর্ক ছেড়ে দিতে চান তার থেকেই বেশি শোনা যায়। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত আরও একধাপ এগিয়ে যায় যখন কোনো একজন সঙ্গী বলতে শুরু করেন, আমি কালই উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দেবো। আমি তোমার কাবিনের টাকা জোগাড় করে ফেলেছি। তুমি চলে যেতে পারো, ইত্যাদি। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা ভালোবাসা এবং ঘৃণাকে একই অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে থাকেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আমি মরতে চাই যেমন বেঁচে থাকার আকুতি বহন করে, একইভাবে আমি ডিভোর্স চাই এটিও কখনও কখনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আবেদন।

সম্পর্ক বিচ্ছেদ সবসময় বেদনাদায়ক না-ও হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বিচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যক্তি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। দুটি সত্য ঘটনা তুলে ধরা যাক।

ঘটনা -১

ষাট বছরের রীতা (ছদ্মনাম )সারা জীবন স্বামীর অত্যাচার, যন্ত্রণা সহ্য করে একটু ধাতস্থ হতে চেষ্টা করছিলেন। ভাইদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়ে দুজনকে বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন। তারা বর্তমানে বিদেশেই প্রতিষ্ঠিত। ছেলেমেয়ের সাথে রীতাও দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। স্বামী রীতার অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। অর্থনৈতিক বিচারে স্বামী নিজেও সমাজের উচুপর্যায়ের লোক। গা সওয়া রীতা ছেলেমেয়েকে সময় দিতে গিয়ে স্বামীর বিষয়ে ভুলতেই বসেছিলেন বলা যায়। দেশে আসার কিছুদিনর মাথায় রীতা জানতে পারেন, তার নামে প্রায় কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ হয় নি।স্বামীর অধিকার নিয়ে তিনি রীতার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িতে থাকার জন্য জোর দাবি তুলছেন। রীতা না করতে পারেন নি। ছেলেমেয়ের সামাজিক মর্যাদার দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি।

ঘটনা -২

বত্রিশ বছরের আরশির (ছদ্মনাম ) বিয়ের বয়স পাঁচ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ পরিচয় থেকে পরিণয়। শেষমেশ দুই পরিবারের সম্মতিতে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে ছিল মনে রাখার মতো। আস্থা ও ভালোবাসায় পূর্ণ আরশির স্বামী আর্য্য তার কাছে অনেকটা দেবতার মতো। আরশি চাকরি করতেন বিমানের ফ্লাই অফিসার হিসেবে। ফ্লাইটের সাথে জীবনের সূচী মেলাতে গিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন আরশি। আর্য্যর সহযোগীতায় আবারো কাজে মন দেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই আরশির মনে হতে থাকে, সংসারে সময় না দিতে পেরে জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। সংসারটা বড়ো ভালোবাসার জায়গা তার কাছে। এক জীবনে স্বামী-সংসার নিয়ে সুখের থাকার বিকল্প আর কী-ই-বা হতে পারে! এবার চাকরিই ছেড়ে দিলেন আরশি। ইতিমধ্যে মা হয়েছেন তিনি। স্বর্গসুখ যেনো হাতের মুঠোয়। ছোট্ট শিশুর দেখভাল করার জন্য নিয়ে আসেন নিজের খালাতো বোনকে। আর্য্যও খুব খুশি হয়েছেন আরশির কষ্ট কমবে বলে। স্বামীর ঘুমের সমস্যা এড়াতে আরশি প্রায়ই মেয়েকে নিয়ে অন্যঘরে ঘুমোতেন। সময়ের পরিক্রমায় হঠাৎ আর্য্যকে আবিষ্কার করেন তারই বোনের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায়। এই অবর্ণনীয় মানসিক আঘাত তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারেন নি। জীবনের দ্বিতীয় কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজে নিজেই সই করেন ডিভোর্সের দলিলপত্রে।

ডিভোর্স পরবর্তী মানসিক অবস্থা বুঝাবার জন্য দুটি উদাহরণ যথেষ্ট মনে করা যায়। যিনি ডিভোর্স দিতে উদ্যোগ নেন, তার জন্য সাময়িক চাপ লাঘবের অনুভূতি কাজ করতে পারে। তবে বেশিরভাগ দম্পতির ক্ষেত্রে ডিভোর্স তীব্র মানসিক ক্ষত তৈরী করে। সম্পর্কে বিচ্ছেদের আঘাত এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে।

আমরা আরশির দিকে তাকাই। সম্মানজনক পেশা ছেড়ে দেওয়া, চুরমার হয়ে যাওয়া স্বপ্নময় সংসার, এ যেন এক অসহনীয় রূপকথা। ক্ষিপ্রতার সাথে আরশি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছুতেই আরশি মেলাতে পারেন না তার জীবনের ঘটনাগুলো। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই ভাবেন, এমন কিছু যদি ঘটতো, যাতে সব কিছু পাল্টে যেতো! সময় ঘড়িটাকে পিছিয়ে দেওয়া যেতো!

মাঝে মাঝে এ-ও ভাবেন, আচ্ছা, কম্পিউটারের মতো আয্যর ওই অংশটুকু ডিলিট করে দেয়া গেলেইতো চলতো! এ জাতীয় হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় জমায় মনে!

বিচ্ছেদের ফলে নারীর আত্মপরিচিতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। বেশিরভাগ মানুষ কারও স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে সমাজে নিজের আত্মপরিচয় ধারণ করে অভ্যস্ত। বিচ্ছেদ হওয়াতে এই আকস্মিক পরিবর্তণের সাথে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসই মানুষ হিসেবে সমাজে তার স্বীকৃতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়।কেউ কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেন অন্য সকল যোগাযোগ থেকে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। সত্যিকারের বন্ধুর সহযোগিতা নিঃসন্দেহে উপকারী হবে।

অনেকের মধ্যে বিচ্ছেদের দীর্ঘ সময় পরও পূর্ববর্তী সঙ্গীর উপর তীব্র রাগ ও ক্ষোভ থেকে যায়। এটি ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি তৈরী করতে পারে। অনেকে এই ‍তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা ক্ষতিকর হতে পারে পরবর্তী সম্পর্কের জন্য। তাই একটি বিচ্ছেদের পর যথেষ্ট সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যেতে পারে। যাতে নতুন সম্পর্ক আরো বেশি পরিপূর্ণ হয়।

লিখেছেনঃ

মোসাম্মাৎ নাজমা খাতুন
অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন