বিয়ে বলে কথাঃ শাকিল ফারুক

লাঠালাঠিতে হারাতে পারলেই সিলেটে বিয়েবাড়িতে ঢুকতে পারত বরপক্ষ। খুলনায় বিয়ের গেটে আজও হয় ইংরেজি তর্কযুদ্ধ। বাঙালি বিয়েতে এরকম কত কিছু যে হয় তা বলে শেষ করার নয়। তবু যতটা বলা যায় ততটা নিয়ে এবারের স্পটলাইটঃ

এও তাহলে সম্ভব! কত না অদ্ভুত কাজ করে থাকে মানুষ! তাই বলে তিন দিন কনের বাড়ির সামনে তাঁবু খাটিয়ে বসে থাকা! তবে যার মুখ থেকে ঘটনাটি জানা গেল, তার দাবি, ঘটনার পুরোটাই সত্য। কথকের মামার বিয়ের ঘটনা। বরযাত্রী নিয়ে তাঁরা বিয়ের দিন কনের বাড়িতে হাজির হয়েছেন। বাড়ির গেটেই তাঁদের পথ আটকে দাঁড়াল একদল লোক। তাদের হাতে লাঠি। বরপক্ষ এ ঘটনায় বিচলিত হলো না। কারণ তারাও তৈরি হয়ে এসেছে। লাঠি হাতে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হলো তারা। শুরু হয়ে গেল লাঠালাঠি। তবে তা কোনো পূর্বশত্রুতার জের ধরে নয়, রীতি অনুযায়ী!  সিলেটে তখন নাকি বিয়ের রীতিই ছিল এমন। কনেপক্ষের লাঠিয়ালদের হারাতে পারলে তবেই কনেবাড়িতে ঢুকতে পারবে বরপক্ষ, নইলে না।

তো কথকের মামাপক্ষ প্রথম দিন কনেপক্ষকে হারাতে পারল না বলে তাদেরকে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না। কিন্তু বরপক্ষ নাছোড়বান্দা। বিয়ে না হলে যে মান থাকে না। তাই ফিরে না গিয়ে তারা তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান নিল কনেবাড়ির বাইরে। সেখানে টানা তিন দিন অবস্থান করে, একাধিকবার চেষ্টার পরে কনেপক্ষের লাঠিয়ালদের হারিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। তার পরই সম্পন্ন হয়েছিল বিয়ে। অবাক হওয়ার মতো হলেও, ঘটনাটিকে অবিশ্বাস করার উপায় নেই। আনন্দ-উল্লাসের প্রকাশ তো কখনো-সখনো একটু অদ্ভুত ধরনের হয়ে থাকে। আর বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে সেটা আরো বর্ণিল আর বিচিত্র হয়ে উঠতে পারে।

সব সমাজেই বিয়ের প্রচলন আছে। তবে রীতিনীতির কারণে সমাজভেদে বিয়ের ধরন হয় বিভিন্ন রকমের। মুসলমানদের বিয়ে হয় কনের বাড়িতে কাজির মাধ্যমে। পুরোহিতের মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে। কনের বাড়িতে মাঙ্গলিক আচারানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। বৌদ্ধদের রীতিও অনেকটা সে রকমেরই। ধর্মীয় শ্লোকের মাধ্যমে বিয়ে করানো হয় তাদের। আর খ্রিস্টানদের বিয়ে হয় চার্চে ফাদারের মাধ্যমে।

 তবে শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা আর উদ্যাপনে ভিন্নতা দেখা যায় অঞ্চলভেদেও। এক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসে ঢাকাই বিয়ের কথা। কোনো অনুষ্ঠান উদ্যাপনে ঢাকাবাসীর তুলনা মেলা ভার। সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বদলে গেলেও, ঢাকাই বিয়ে এখনো ব্যাপক বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিয়ে অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঢাকাইয়ারা করে থাকে নানা আয়োজন। প্রস্তাব দেওয়া, কনে পছন্দ করাসহ আর সব বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য বিয়ের আগে ‘পানচিনি’র আয়োজন করা হয়। এতে সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকেন পেশাজীবী ঘটকরা। তাদের বলা হয় ‘মোতাসা’। পানচিনি অনুষ্ঠানের ফল সন্তোষজনক হলে দিনক্ষণ আর লেনদেন বিষয় নিশ্চিত করার জন্য আয়োজন করা হয় মোতাসা-রাই বা ‘পাকাকথা’ অনুষ্ঠানের। এসব অনুষ্ঠানে মুখরোচক সব খাবারের আয়োজন থাকে।

এই ভূরিভোজনপর্বকে ঢাকাইয়া ভাষায় বলা হয় ‘খাস আপ্যায়ন’। বিয়ের কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় ‘হলদি’ বা ‘তেলাই’। গোসলের আগে বর ও কনের গায়ে হলুদবাটা দিয়ে শরীর মার্জন করা হয় এ অনুষ্ঠানে। আত্দীয়স্বজনের অংশগ্রহণ ও গান-বাজনার মধ্য দিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়। বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে তেলাইয়ের আয়োজন হয়ে থাকে। বরপক্ষের লোক মিষ্টি ও নানা উপাচার নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হন। আর কনেপক্ষের লোক উপস্থিত হন বরপক্ষের বাড়িতে। উপাচারের মধ্যে অবশ্যই থাকে দুটি বড় মাছ। একটি বরের প্রতীক, অন্যটি কনের। বরের প্রতীক মাছটির মুখে গুঁজে দেওয়া হয় একটি সিগারেট। আর কনে-মাছটির মুখ ঢেকে দেওয়া হতো একটুকরো কাপড় দিয়ে। যে মাছ কাটে, তার জন্য উপহারস্বরূপ মাছের ভেতর দেওয়া হয় টাকা। হলুদপর্ব শেষ হলেই শুরু হয় রং ছিটানোর খেলা।

এরপর বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে আয়োজন করা হয় ‘আইবুড় ভাত’ নামের অনুষ্ঠান। একে ‘কুমারী ভাত’ও বলা হয়। আইবুড় মানে অবিবাহিত অবস্থায় নিজের বাড়িতে বর বা কনের শেষ খাওয়া। এ পর্বেও থাকে প্রচুর খাবারদাবারের আয়োজন। তারপর আসে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। আগে কার্ড ছেপে দাওয়াত পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না। বিয়ের দাওয়াত দেওয়া হতো লবঙ্গ উপহার দিয়ে। প্রচলন ছিল না কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করারও। তাই গলির মোড়ে বা এলাকার মসজিদে বিয়ের কাবিননামা লেখার কাজ সারা হতো। এরপরই খাওয়াদাওয়া, উপহার প্রদান আর আতসবাজি ফোটানোর উৎসব। বিয়ের পরও আরো মাসখানেক রয়ে যায় এ উৎসবের আমেজ। বিয়ের পর কনের পিতৃগৃহে বর আর কনের বেড়াতে যাওয়াকে বলা হয় ফিরোল্টা’ (ফির+উল্টা)। এর মানে, বিয়ের পর আবার আগের মতো কনের বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া। সাম্প্রতিককালে কোনো কোনো আচার-প্রথা হারিয়ে যেতে থাকলেও অধিকাংশই এখনো টিকে আছে।

সিলেট অঞ্চলের বিয়েতেও বর্ণাঢ্য আয়োজন দেখা যায়। বিয়ের দিন গীত-গান এবং ‘ধামাইল’ নামের একটি মেয়েলি অনুষ্ঠানের আয়োজন বিশেষভাবে সিলেটী বৈশিষ্ট্য। বর ও কনের বাড়ি সাজানো হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। বিয়ের দিন বর ও কনের বাড়িতে যে গীত হয় তাতে বাড়ির মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে অংশ নেয়। সিলেটের বেশ কিছু জনপ্রিয় আঞ্চলিক বিয়ের গান রয়েছে। সেসব গানের সঙ্গে সব বাড়ির নারীরাই পরিচিত। তাই গীতের সঙ্গে প্রায় সবাই গলা মেলাতে পারে। এসব গীতের মাধ্যমে কখনো বর-কনেকে আকাশে উঠিয়ে দেন গায়করা, পরক্ষণেই হয়তো মাটিতে নামিয়ে আনেন। গীতের তালে তালে নারীরা তুলে ধরেন বরের মেজাজ, কনের চালচলন।

ধামাইলও একটি মজার আয়োজন। এর আয়োজক ও দর্শক উভয়ই হচ্ছে নারী। এখানে পুরুষের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। মেয়েরা শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে পা দিয়ে মাটিতে তাল ঠুকে হাতে তালি দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের গান গায়। এগুলো ধামাইল গান। এছাড়া বর-কনেকে নিয়ে লেখা কবিতা বা ছড়া ছাপিয়ে একটি সংকলন প্রকাশের রেওয়াজ রয়েছে। একে বলা হয় উপহার। এসব সংকলনের নাম দেয়া হয় সুখের বাসর, ঘি চমচম, মিলন বার্তা ইত্যাদি। আর লেখাগুলো হয় কৌতুকপূর্ণ ও রসে ভরপুর। রসালো আয়োজন রয়েছে রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতেও। তবে সেটা অবশ্য পিঠার রসে রসালো। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর গীতের তালে তালে বর-কনেকে নিজেদের বাড়িতে মিষ্টিমুখ করানো হয়। এতে ব্যবহৃত হয় ক্ষীর ও আন্ধাষা। আন্ধাষা হচ্ছে রাজশাহীর জনপ্রিয় মিষ্টি পিঠা, যা তেলে ভেজে বানানো হয়। এ ক্ষীর আর আন্ধাষা পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তৈরি করে পাঠানো হয় বর-কনের বাড়িতে। মিষ্টি খাওয়ানোর এ অনুষ্ঠানকে বলা হয় থুবড়া। থুবড়া অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় আঞ্চলিক গীত। গীতের সঙ্গে মিষ্টিমুখে মেতে ওঠে সবাই।

 বিয়েতে লাঠিযুদ্ধের প্রচলন সিলেটে আর না থাকলেও, খুলনা অঞ্চলে দেখা যায় বর আর কনেপক্ষের মধ্যকার অন্য রকম এক যুদ্ধ। এটি হচ্ছে বাকযুদ্ধ। তাও আবার বাংলা ভাষায় নয়, পুরোপুরি ইংরেজিতে। খুলনায় বিয়ের নিজস্বতা হচ্ছে এই ইংরেজি তর্কযুদ্ধ। বাড়ির গেটে বরপক্ষকে আটকে কনেপক্ষের লোকজন ইংরেজিতে কথোপকথন শুরু করে। তার জবাবে বরপক্ষকেও কথা বলতে হয় ইংরেজিতে। এ কথপোকথনে শেষ পর্যন্ত যে পক্ষ আর তর্ক চালিয়ে যেতে পারে না, তারা পরাজিত হয়। একপক্ষ অন্য পক্ষকে লজ্জা দেওয়ার জন্যই এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

চট্টগ্রামের বিয়েও বেশ বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য। বিয়ের প্রাথমিক কার্যকলাপ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সম্পন্ন হয়। তবে বিয়ের আগে আয়োজন করা হয় ‘বউ জোড়নি’ নামের একটি অনুষ্ঠান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বর ও কনের মধ্যে আলাপ-সালাপ করিয়ে দেয়া। এ জন্য বউ জোড়নি অনুষ্ঠানে কনেকে সাজিয়ে বরের সামনে উপস্থিত করা হয়। চট্টগ্রামের আরেকটি বিচিত্র আয়োজন হচ্ছে ‘ঘরজামাই বিয়া’। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ের পর বরের কনের বাড়িতে থেকে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এ বিয়েকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ঘরজামাই বিয়া।

তথ্য সংগ্রহ
গৌরাঙ্গ নন্দী, খুলনা; আনু মোস্তফা, রাজশাহী; আবদুর রহমান, সিলেট;
রফিকুল ইসলাম, বরিশাল; রাজীব নন্দী, চট্টগ্রাম।

মন্তব্য করুন