নাগরিক জীবন। নাভিশ্বাস দৌড়। কর্মক্ষেত্র-পরিবার। ব্যস্ততা। একফুটো অবকাশের দেখা মেলা ভার। নিত্য ব্যস্ততার এই সময়ে আলাদা করে সময় মেলে কী দুজনকে দেয়ার। আর এরই ফাকফোঁকরে দূরত্ব নামক শব্দটি জায়গা করে নেয় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে। অনেকে হয়তো টেরই পান না দূরত্বের এই উপস্থিতি। তাই ঘোচাতে হবে এই দূরত্বটাকে। সময় দিতে হবে দুজন দুজনকে।
নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ, নতুন অভ্যাস। হাজার আলোর সম্ভাবনা আর আশা নিয়ে সুখ সাগরে ভাসতে ভাসতে মনটাকে মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেতে হচ্ছে। বিয়ের পরে প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই কিছুটা পরিবর্তন অবশ্যই আসে। আগের সেই অদম্য উচ্ছল জীবনে কোথাও যেন একটু ইতস্তত ভাব ক্ষণিকের জন্য হলেও জেগে ওঠে। সত্যি কথা হলো, বিয়ের আগে যেভাবে চলা যেত বিয়ের পর কী সেই একই গতিতে চলা সম্ভব? এখানে নতুন দায়িত্ববোধের একটা ব্যাপার আপনাআপনিই এসে জড়িয়ে যায়। অনেকের মনেই ভাবনা থাকে—বিয়ের পরে মানিয়ে নিতে পারব তো? আমাকে মানিয়ে নিতে পারবে তো সে? কেমন হবে তার চালচলন? বিয়ের পরে আমার উপরে আমার কর্তৃত্ব ফলাবে না তো? এমন নানা ধরনের আশঙ্কাই মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দেয় তখন। এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান সঙ্গীকে সময় দেওয়া। সুখী দাম্পত্যজীবন চাইলে বিয়ের পরে সংসারজীবনে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া উচিত।
একটা ঘটনা বলা যাক। মিতু আর নিলয়ের নতুন বিয়ে হয়েছে। ভীষণ ব্যস্ত দম্পতি ওরা। একজন কর্পোরেট অফিসের উচ্চ পদস্থ অফিসার। আরেকজন ব্যবসা চালায়। একজনের যখন কাজের অবসর মেলে আরেকজন তখন অফিসের কাজে বিদেশ সফরে ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে সহকর্মীদেরই স্বামী বা স্ত্রীর থেকে বেশি আপন মনে হয় ওদের। ধীরে ধীরে দু’জনের মধ্যকার দূরত্বটা যেন বেড়েই চলেছে।
যেখানে মিতু-নিলয় দম্পতিদের মতো স্বামী বা স্ত্রীর একজন বা দু’জনই চাকরি করেন সেখানে দু’জনার ব্যস্ততা থাকবে, ব্যস্ততার মধ্যে একটা ফারাকও থাকবে। ব্যস্ততাকে দাম্পত্যের নিত্যসঙ্গী ধরে নিয়েই নিজেদের জন্য সময় বের করার প্ল্যানিং করুন। দাম্পত্য যদি আপনার প্রায়োরিটি হয় তাহলে আপনি সফল হবেনই। মনে করে দেখুন তো বিয়ের আগের দিনগুলো কেন একে অপরকে ভালো লেগেছিল। হয়তো তার উদার মন, খোলা হাসি ভালো লাগত। সেই পুরোনো ভালোলাগাগুলোই ধরে রাখার চেষ্টা করুন কিংবা রিক্রিয়েট করুন। সপ্তাহান্তে দু’জনে চলে যান ভালোলাগে এমন কোনো জায়গায়। সঙ্গে বন্ধুবান্ধব কাউকে নেবেন না। সংসারী আলাপ বাদ দিয়ে এদিন হবে শুধুই আড্ডা। স্বাভাবিকভাবেই পুরোনো কথা ঘুরেফিরে আসবে। তখন ভালোলাগা মুহূর্তগুলো শেয়ার করতে ভুলবেন না। স্বামী যখন ট্রাভেল করছেন তখন মাঝে মাঝে তার সঙ্গী হতে পারেন। পুরোটা না হোক কিছুটা সময় তো একসাথে কাটবে। নিজের লম্বা ট্যুর থাকলে স্বামীকেও সাথে নিন। সন্ধ্যেটা একটু স্পেশাল করে প্ল্যান করুন। সুস্বাদু ডিনার, সুন্দর কোনো গিফট আর লং ড্রাইভ—সম্পর্কের সুতোটাকে আরও মজবুত করে তুলবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দাম্পত্য জীবনে কোয়ালিটি টাইম বা গুণগত সময়ের খুব প্রয়োজন। তাহলে অনেক ব্যস্ততার মধ্যে পুরনো সেই দিনের মতো এখনও ভালোবাসার রেশ থাকে সম্পর্কে। সম্পর্কে ভালোবাসা রাখতে দুজন দুজনকে দিতে হবে সময়। করতে হবে শ্রদ্ধা।
একটুকু সময় নিজেদের
সারা সপ্তাহেই ব্যস্ততা। এর মধ্যেও দুজন দুজনের জন্য খানিকটা সময় রাখতেই পারেন। অফিস থেকে ফেরার পথে স্বামী-স্ত্রী কোনো কফি শপে গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে কিছু মুহূর্ত কাটাতে পারেন। তখন সংসারের হালচাল, সন্তানের ভবিষ্যৎ কিংবা অফিসের সমস্যাগুলো ছাপিয়ে নিজেদের জন্য একটু সময় দিন। গুণগত সময় মানেই পরিবারের জন্য একান্ত কিছু সময়, যে সময়টুকুতে সব ধরনের সমস্যা দূরে সরিয়ে শুধু ভালোবাসার আবেশে থাকবেন দুজন।
দূরত্ব বুঝতে হবে
অনেকে তো বুঝতেই পারেন না, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলাফলে কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ কিংবা ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি। এটি যেন না হয়। হাজারো কাজের মধ্যে একটি দিন বেছে নিন। সেই দিনে স্বামী-স্ত্রী বাইরে ঘুরতে যেতে পারেন। রাতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতে পারেন। অল্প আয়োজনে রিকশায়ও আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করতে পারেন। ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে না গেলেও সঙ্গীর সঙ্গে বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পারেন। বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে পারেন।
কোয়ালিটি টাইম কথা
শুধু স্ত্রী একাই কোয়ালিটি টাইম নিয়ে ভাববেন, তা নয়। পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য দুজনেরই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে, বিশেষ করে স্বামীদের। তারা অনেক সময় মনে করেন, সব দায়িত্ব শুধু স্ত্রীদেরই। বিষয়টি তেমন হওয়া উচিত নয়। কেউ কেউ ভাবেন, দামি উপহার কিংবা কেনাকাটার টাকা দিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ। বরং স্ত্রীকে হঠাৎ তার প্রিয় কোনো ফুল, বই বা ছোট্ট কিছু দিয়ে অবাক করে দিতে পারেন। ব্যস্ততার মধ্যেও যে তাকে মনে রেখেছেন, এতেই স্ত্রী খুশি হবেন। কাজ তো থাকবেই, তবুও অফিস থেকে ফিরে একসঙ্গে এক কাপ চা তো খাওয়াই যায়।
শ্রদ্ধা থাকুক পারস্পরিক
স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে শ্রদ্ধা! অবাক হতে পারেন। এটা তো শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক নয় রে বাবা। কিন্তু মনে রাখতে হবে শ্রদ্ধাতে-ই শ্রাদ্ধ হয় না সম্পর্কের। সঙ্গীকে সময় দিচ্ছেন, তার মনের চাওয়া-পাওয়াকে শ্রদ্ধা করেই তো ঘড়ির কাঁটার কাছ থেকে আপনার এই সময় ছিনিয়ে নেয়া। তাই সবসময় শ্রদ্ধা থাকুক পারস্পরিক।
সম্পর্কটা থাক সতেজ
দম্পতি; হোক সে নতুন বা পুরোনো, সম্পর্ক হতে হবে সব সময়ই সতেজ। স্নিগ্ধতায় ভরা। মধুময়। স্বামী কাজে ব্যস্ত। দৈনিক আট ঘণ্টা অফিস শেষে বাসায় পৌঁছাতে আরও দেরি। স্ত্রী সারা দিন বাসায় একা। টিভি দেখা, ম্যাগাজিন পড়া, ফোনে কিছুটা সময় কাটানো। তার পরও কিছু করার নেই। সবাই ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যে একাকিত্ব কাটানোর জন্য আপনি ফেসবুককে সঙ্গী করে নিলেন। ক্রমেই আপনার একাকিত্ব কেটে যেতে থাকল। স্ট্যাটাস দিচ্ছেন, চ্যাটিং করছেন, অন্যের স্ট্যাটাস ও ছবিতে লাইক করছেন, কমেন্টস করছেন—মনের ভাব বিনিময় হচ্ছে। বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকল। এরপর সম্পর্ক শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ থাকল না। ক্যাফে, শপিং মলে আড্ডাও চলে। এখন স্বামীর অনুপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ করেন না, কিন্তু একটা সময় যদি স্বামীর মনে খটকা লাগে বা নিজেই যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, তবে এই নতুন সম্পর্কের কী নাম দেবেন?
এ ধরনের সমস্যায় কি বৈবাহিক সম্পর্কে চিড় ধরবে আর নতুন সম্পর্ক অটল হয়ে থাকবে? অযথা সন্দেহের আবর্তে স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব কি বাড়তেই থাকবে?
দুজনে মিলে যা করতে পারেন
স্ত্রী যখন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে চান, তখন তাঁকে বাধা দেওয়ার কিছু নেই। এই স্বাধীনতা তাঁকে দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় স্বামী যদি একটু সময় বের করে স্ত্রীকে দেন। সময় অল্প হলেও আন্তরিকতা থাকলে বা কোয়ালিটি সময় দিলে স্ত্রীর মনে স্বামীকে নিয়ে আর খারাপ লাগা থাকবে না। কাজের ফাঁকে ছুটি নিয়ে কোথাও একবেলার জন্য ঘুরে আসতে পারেন। সব সময় যে কারণ ধরেই যেতে হবে এমন নয়, অকারণ পাগলামিতে অভিমানের বরফ গলে যায়। আর ব্যস্ততার মাঝেও ফেসবুকে নিজেরা চ্যাটিং করতে পারেন। নিজেদেরও সময় দিন। ঘরের মধ্যে নিত্যদিনের সংসারসঙ্গীর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের খানিক সময়ের ভাববিনিময় আরও প্রাণময় করবে দুজনকে।
সচেতন থাকুন
নিজের মনের অগোচরে যদি কোনো নতুন ‘বিশেষ’ সম্পর্ক উঁকি দেয় বা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে প্রথমেই তা সামলে নিন। ফেসবুকসহ অন্য সব যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম প্রতারণা বাড়ছেই। ফেসবুকে অনৈতিক নানা প্রস্তাবও পেতে পারেন বন্ধুদের কাছ থেকে। ইদানীং দেশেও এ চক্র সক্রিয়। মানবমনের আকাঙ্ক্ষা বড় বিচিত্র। মনে রাখতে হবে, এই চক্রগুলো সক্রিয় আমাদের নানা গোপন আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরেই। এসব বিষয় সব সময় মাথায় রাখতে হবে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও আন্তরিক হতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । ক্ষণিকের ভুলে যেন সারা জীবন কষ্ট পোহাতে না হয়। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর খোলাখুলি আলাপ করতে পারেন।
যা কখনোই করবেন না
সংসার মধুময় বন্ধন। এ ধরনের ফেসবুক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্মল বন্ধুত্বের সীমা কখনোই যেন অতিক্রম না করে। জীবন চলার পথে পুরোনো কোনো ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সঙ্গে আবার আলাপ-পরিচয় হতেই পারে। এ নিয়ে আবেগের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেবেন না। সহজভাবে নিন। ওই বন্ধুর কথা আপনার জীবনসঙ্গীকেও জানান। আড়াল করার দরকার নেই। বন্ধুকে বন্ধু হিসেবেই রাখুন। ফেসবুক হোক আর ই-মেইলেই হোক, কোনো ধরনের বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে দ্রুত সঙ্গীকে জানান। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিন কী করবেন।
আপত্তিকর ছবিসংবলিত কোনো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এলে সেটা এড়িয়ে যান। এটাই সর্বোত্তম পথ। যেসব একাউন্ট থেকে আপত্তিকর ছবি, বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো হয়, সেগুলো পরিহার করুন।