কথায় কথায় আমরা অনেকেই অতীতে কোন ঘটনা বলতে গিয়ে বলি সেই ১৯৫৩ সালের কথা। কিন্তু আদতেই ১৯৫৩ সালে স্বামীকে সেই শেষ দেখেছিলেন কিম। ভেবেছিলেন যুদ্ধে বুঝি মরেই গেছে স্বামী। কিন্তু অর্ধশতাব্দী পর জীবনের শেষ লগ্নে এসে আবার দেখা পেলেন সেই হারিয়ে যাওয়া স্বামী লি এর।
১৯৫৩ সালে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সইয়ের দুদিন আগে লি সুন-সাংকে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর আটক করে নিয়ে যায়। তারপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। মারা গেছেন লি, এমনটা ভেবে বিধবার মতোই জীবন কাটাতে থাকেন কিম ইউন-হায়ে। কিন্তু ২০০৪ সালে হঠাত একটি ফোন তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ফোনটি আর কেউ নয়, করেছিলেন লি।
২০০৪ সালে চীন থেকে একটি ফোনকল আসে কিমের কাছে। তিনি মনে করেছিলেন, তার কাছে টাকা-পয়সা চেয়ে কেউ ফোন করে থাকবেন। বিগত বছরগুলোতে এরকম অনেক ফোনকল পেয়েছিলেন তিনি। তাই ওই কলটির প্রতিও তেমন গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। কিন্তু ফোন রিসিভ করে অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর শুনে নিজেকে আর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কিম। ফোনে স্বামীকে কিম জিজ্ঞেস করেন, ‘আসলেই তুমি বেঁচে আছ?’ উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ, আমি জীবিত’।
কিন্তু তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না কিমের। নানা রকম প্রশ্ন করে যাচাই বাছাই করে নিচ্ছিলেন স্বামী হিসেবে দাবি করা মানুষটি আদতে সত্যিই তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী কিনা। শেষ পর্যন্ত সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিয়ে লি কিমকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে তিনিই কিমের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বামী।
কিন্তু যখন তারা সাক্ষাৎ করলেন, একে অপরকে তেমন একটা পরিচিত মনে হচ্ছিল না তাদের। হবেই বা কী করে, শুকিয়ে তো কৃশকায় বনে গেছেন লি, টলতে টলতে পথ চলেন। অন্যদিকে ভালোমন্দ খেয়ে বেশ মোটাসোটা হয়েছেন কিম। লির বিশ্বাসই হচ্ছিল না কিম তার সহধর্মিনী। অর্ধ শতাব্দী পর একে অপরের দেখা পেয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন দুজনেই।
কিম নাক দেখে স্বামীকে শনাক্ত করতে পারলেও স্ত্রীর চেহারা দেখে ঠাহর করতে বেশ বেগ পেতে হলো লিকে। ‘ওকে দেখেতো মনে হচ্ছিল আগের সময়ের জমিদারনী। সব দক্ষিণ কোরীয় না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর আমেরিকানরা সব চাল নিয়ে যাচ্ছে, শুধু পঁচা আটাগুলো দিয়ে যাচ্ছেন-এমন অপপ্রচার শুনে তো আমি বিশ্বাস করেছিলাম সে মারা গেছে।’
লি শোনালেন তার হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। ১৯৫৩ সালে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার পরে যুদ্ধশিবিরের একটি কারাগারে সাড়ে তিন বছর কাটান তিনি। এরপর তাকে উত্তর কোরিয়ার বিপজ্জনক কয়লা খনির স্থান অজিতে পাঠানো হয়। অজিতে গানপাউটার উৎপাদিত হয়। সেখানে তিনি ফের বিয়ে করেন, বাচ্চা-কাচ্চায় আসে নতুন সংসারে। কিন্তু যুদ্ধের আগের জীবন কখনও ভুলতে পারেননি তিনি।
লি বলেন, “উত্তর কোরিয়ার জীবন ছিল কঠিন। তাই আমি আমার নিজ শহরের কথা ভাবতাম। যদিও আমি বিশ্বাস করতাম আমার স্ত্রী মারা গেছে তবু আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম একদিন আমি ফিরব।’
কয়েক দশক পর ২০০৪ সালে উত্তর কোরিয়ার বাইরে লোক পাঠানো ও ভেতরের প্রবেশ করানোর দালাল চক্রের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় লি’র। ওই ব্যক্তিই কিমের খবর দেন লিকে। ‘সে আমাকে বলে যে কিম ইউন-হায়ে ও আমার ছেলে চীনে রয়েছে, তারা অনেক টাকা পয়সার মালিক। টাকা পয়সা নিয়ে ভালো জীবন যাপনের জন্য উত্তর কোরিয়ায় (নিজ শহরে) ফিরে যাওয়া উচিত বলেও আমাকে পরামর্শ দেয় সে।’
সিগারেট বিক্রি করে অতিকষ্টে ২০ হাজার উত্তর কোরীয় মুদ্রা ওন (প্রায় ১৫০ মার্কিন ডলার) জমা করেন লি। সেই সব টাকা দ্বিতীয় স্ত্রীকে দিয়ে ওকে পারতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি ছাড়লেন লি। তারপর আর ফিরে যাননি। প্রথম ভালবাসা, প্রথম স্ত্রী কিমকে নিয়েই শেষ জীবনটা সুখে কাটাতে চান লি।
অপরাজিতা/শুভ্রা.