সংসার এর টানাপোড়ন

সবার জীবনেই একটা ভবিষ্যত পরিকল্পনা থাকে।খুব হাস্যকর মনে হলেও একসময় আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছিল একজন আদর্শ গৃহিণী হব।যদিও বিয়ের পরপরই বুঝতে পেরেছিলাম সেটা আদোতে কত কঠিন।শ্বশুর বাড়িতে প্রথম প্রথম অনেকেই আস্ত নতুন বউ দেখতে।ভেবেছিলাম মানুষগুলো আমাকে দেখতে এসেছে।তাই যথাসম্ভব তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলার চেষ্টা করেছি।যদিও দুদিন না যেতেই আমার সে ভুল ভেংগে গেল তাদের কথাবার্তা শুনে।  বউ কি শুধু হাসতেই জান?মা কাজকাম কিছু শেখাইনি?দেখি তো মা তোমার বাপে কি কি দিছে? ওমা শুনলাম বড়লোকের বেটি।এখন তো দেখি সবই শোনা কথা।আপা আপনার কপাল বড়ই খারাপ।সেদিন জামালের বউ দেখতে গেলাম আহা তার শ্বশুরে ঘরডা সাজায়ে দিছে।সবই কপাল।  পাড়া প্রতিবেশির আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে যায়।তার ছিটেফোঁটা আমার শ্বশুর বাড়িতে ও পড়ে।তাদের মধ্যেও শোকের ছায়া নেমে আসে।

আমি পড়েছি মহা মুশকিলে। আদর্শ গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন বুঝি অংকুরেই বিনষ্ট হল।তবু হাল ছাড়ার পাত্রি আমি না।মহা উতসাহে গৃহস্থালি কাজে মনোনিবেশ করলাম।মা সব সময় বলত লেখাপড়ার মত কঠিন কাজটা যে মেয়ে পারে তার জন্যে কোন কাজ ই কঠিন না।বিয়ের পর দায়িত্ব ঘারে এসে পড়লে ঠিকই সব শিখে যাবি।সত্যিই দেখলাম একটু একটু করে সব কাজ শিখে ফেলছি।যদিও পেয়াজ কাটতে গিয়ে নাকের জল চোখের জল এক করছি।ভাতের মাড় গালাতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলছি, মরিচ কাটলে সারাদিন হাত জ্বলছে তবুও পারছি।কিছুদিন পরেই দেখলাম এসব আর সেভাবে হচ্ছেনা।মনে মনে খুশি হলাম এবার বুঝি পাকা রাঁধুনি হব।আদর্শ গৃহিণী হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।বান্ধবীরা যখন চাকরির পরীক্ষা একের পর এক দিয়ে যাচ্ছে আমিও তখন আমার স্বপ্ন পুরনে একএক টা ধাপ পার হচ্ছি। সবকিছু যখন শিখে ফেলেছি তখন মনে হল আমি আসল জিনিসটা আজও শিখিনি।সংসারে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল অভিনয় জানা।যে যত ভাল অভিনেত্রী হতে পারে সে তত সবাইকে সুখি করতে পারে।আর নিজেও সুখি হতে পারে।আমার তখন মনে হল কি করলাম এতদিন লেখাপড়া শিখে।যদি অভিনয়টাই না পারলাম।সেই সাথে মায়ের উপর খুব রাগ ও হল।ছোটবেলা থেকে যদি সব কিছুর পাশাপাশি অভিনয়টাও একটু শেখাত তাহলে আজ আর বিপদে পড়তে হত না। মনে হল আমার আদর্শ গৃহিণী হবার স্বপ্ন বুঝি এ জীবনে আর পুরন হলনা।তবুও আমি হাল ছাড়লামনা।সংসারে সুখি হতে গেলে এবং অন্যকে সুখি করতে গেলে যে যে অভিনয় গুলো করতে হয় তা ইতোমধ্যে আমি জেনে গিয়েছিলাম।

এই যেমন স্বামী রাগ করলে বকাঝকা করবে।মাঝে মাঝে গায়ে হাত তুলবে।স্ত্রীর তাতে মোটেও রাগ করলে চলবেনা।বরং এক গালে চড় মারলে হাসি হাসি মুখ করে আরেক গাল বাড়িয়ে দিতে হবে।শ্বশুরের জন্যে চা বানিয়ে আনলে তা যদি তার পছন্দ না হয় এবং তিনি যদি সেটা ফেলেও দেন তবে কষ্ট পাওয়া যাবেনা।বরং কিছুই হয়নি এমন ভাবে আবার চা বানানোই মনোনিবেশ করতে হবে।শ্বাশুড়ির যেকোন কথা হাসি মুখে গ্রহন করতে হবে।বাপের বাড়ি থেকে ফোন করলে যেমন ই থাকিনা কেন তাদের কে বোঝাতে হবে যে আমি ভালো আছি।পাড়া প্রতিবেশিরা যখনি যেটাই বলুক তাতেই আমার মংগল ভেবে চুপ থাকতে হবে।ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।   যদিও এতকিছু আমার জন্যে কঠিন ছিল তবুও আমি দমে গেলাম না।জীবনের লক্ষ আমাকে পূরন করতেই হবে।

এরই মধ্যে আবারও পাড়া প্রতিবেশিদের আহাজারি শুরু হল।আহারে এ কেমন বউ।শুনছিলাম এত এত লেখাপড়া জানে।তা এতদিনে তো কোন চাকরিই পাইলনা।আজকালকার দিনের কোন মাইয়াডা ঘরে বইসা থাকে।রমিজের পুলার বউডা আই এ পাশ দিছে।সে তো সরকারী প্রায়মারি স্কুলে চাকরি করে।মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন পায়।তোমারি কপাল খারাপ গো।   আবার ও তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাসের সাথে আমার সংসার ও কেঁপে উঠল।আমার মনে হল এতদিন যা করেছি তা পুরোটাই পন্ডশ্রম।আদর্শ গৃহিণী হওয়ার স্বপ্ন আমার আর এ জন্মে বুঝি পূরণ হলনা।সংসারের মান বাঁচাতে আমি এবার চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে লাগলাম।

#ফ্যানপোস্ট