রবি ঠাকুর প্রিয়নাথ সেনকে নিজের বিয়ের নেমন্তন্ন জানিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন তার মাথায় লিখিত ছিল – ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’। বিয়ে এমনই এক লঘু রসের সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বাঙালি মানসে। খ্যাতিমান থেকে অখ্যাত সকলের কাছেই বিয়ে এক অনিবার্য রসিকতা। আমার এক বন্ধু বলেছিলেন – ‘ভাই হে আর যাই কর, বিয়ে কর না’। বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘নিজে তাহলে বিয়ে করলে কেন’? উত্তরে বন্ধুবর কাঁচুমাঁচু মুখে বলেছিলেন – ‘আর করব না’।
দাশুরায় সেই কবে গান বেঁধেছিলেন – ‘সংসার রাঙা ফলে ভুলিও না আর। মিছে মায়া ভুমণ্ডলে অসার অপার’। ছেলেবেলায় সংস্কৃত পণ্ডিত জিজ্ঞেস করেছিলেন উদ্বাহন শব্দটির অর্থ কি? কিছু না ভেবেই বলেছিলাম – গলায় দড়ি। উদ্বন্ধন শব্দটির সঙ্গে হয়তো মিল পেয়েছিলাম। পরে অবশ্য জেনেছি উদ্বাহন মানে বিয়ে। এইরকমই আর একটি শব্দ আছে – পাত্রসাৎ। শব্দটিকে আমার আত্মসাৎ শব্দের যমজ ভাই বলে মনে হয়। বরং পাণিপীড়ন শব্দটিকেই যথেষ্ট অর্থবহ মনে হতে পারে বিয়ের সার্থক প্রতিশব্দ হিসাবে। অবশ্য পীড়ন শব্দটি আছে বলেই। তবু বিয়ের ফুল ফোটে। প্রজাপতির নির্বন্ধে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায় মোক্ষম ভুক্তভোগী ছেলে-মেয়ের বাপ। এসো, তোমরা খেয়ে-দেয়ে এই নবদম্পতির ভবিতব্যটিকে পোক্ত করে যাও। মালাবদল হয়, কোন কোন সম্প্রদায়ে মালার বদলে কণ্ঠিবদল। তারা বরং অনেক প্র্যাকটিক্যাল। ফুলকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলানোর বদলে তারা শুকনো কাঠিকে সে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। গাঁটছড়া বাঁধা হয়। শুরু হয় গাঁটে গাঁটে বহনের যন্ত্রণা। ঘর বাঁধে মিঞা আর জরু।
আগে বাঙালি জীবনে বিয়ের অনুষঙ্গ ছিল ঘটক বিজড়িত। ঘটকালি ছিল বড় মজাদার পেশা। সেইসব ঘটকরা চিরকালই বাংলা সাহিত্যে কমিক চরিত্রের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। মুকুন্দর চণ্ডীমঙ্গল থেকে এই সেদিন পর্যন্ত ঘটক ছিল সাহিত্যের অনিবার্য চরিত্র। তাঁরা আর নেই। ফাঁসুড়েদের আর প্রয়োজন হয় না, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিরা স্বয়ং জাটিঙ্গার পাখির মতো বিবাহানলে ঝাঁপ দেয়। ঘটকের মতো কত শব্দই যে বাতিল হয়ে গেল ও যাচ্ছে বাঙালির জীবন থেকে। পাকা কথা, পাটিপত্র, আশীর্বাদ, যোটক বিচার, আইবুড়োভাত, ননদ পুঁটুলি ইত্যাদি শব্দ ধীরে ধীরে আরও অপরিচিত হবে নতুন প্রজন্মের কাছে। বাঙালির বিবাহকেন্দ্রিক সংস্কৃতি পরিবর্তমান। নতুন নতুন শব্দাগমন কয়েক দশকের মধ্যে জায়গা দখল করেছে। যথা – ক্যাটারার, পার্লার, বিউটিশিয়ান, রেজিস্টার, ডেকোরেটর, লাইটম্যান, ম্যাট্রিমনি ডট কম ইত্যাদি ইত্যাদি। নামবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মালাবদলটি একই আছে। ফলত এ সেই ‘ফুটা পাত্রে জল ঢালা দিবারাত্রে। বৃথা চেষ্টা তেষ্টা মেটাবার’।
তবুও বিয়ে নিয়ে বাঙালির ইয়ের অন্ত নেই। প্রেম করে বিয়ে নাকি বিয়ে করে প্রেম – এই উত্তরটি জানার জন্য প্রাণ হাঁকুপাঁকু করে। যদিও দুটোই প্রায় সমান সমান। আমাদের প্রাণকেষ্টবাবু যেমন বলেছিলেন – ‘তুমি দিব্যি ছিলে, একটা সাপ এসে তোমাকে ছোবল দিল – এটা হল সম্বন্ধ করে বিয়ে, আর সাপটা দিব্যি ছিল, তুমি তার লেজে পা দিয়ে ছোবল খেলে – এটা হল প্রেম করে বিয়ে। যেভাবেই কর না কেন, করেছ তো বাপু বিয়েই’।
বাঙালি জানে এককথায় বিয়ে হয় না। অন্তত সম্বন্ধ করে বিয়ে তো নয়ই। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অথবা বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমে লিস্ট বানানও। চিঠি অথবা ফোনাফুনি। তারপর দেখাদেখি। পছন্দ হলে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে হবু কনে বা বরের চাল-চলন নিয়ে চিরুনি-তদন্ত। ইদানীং আবার এর পরে হবু পাত্র-পাত্রীর একটু-আধটু ঘোরাঘুরিও যুক্ত হয়েছে। একে অপরকে চিনে নাও, জেনে-বুঝে নাও বাপু তারপর সিদ্ধান্ত নিও। পরে কিচাইন হলে যেন বাপ-মা’কে শাপশাপান্ত না করতে পারে তার যথোপযুক্ত প্রিকশান নেওয়া। সব দিক দেখেশুনে বিয়ে তো হয় কিন্তু তাতেই কি সব সমস্যা মেটে, বরং সমস্যা বাড়ে। আমার এক লেখক বন্ধু বলেছিলেন – ‘তুমি তোমার বউকে কতটা ভালবাস, তার ওপর বিবাহিত জীবনের সুখ-শান্তি নির্ভর করে না, তুমি যাদেরকে বিয়ে করলে না, নির্ভর করে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর’। কত ধুমধামের বিয়ে যে শেষ পর্যন্ত ৪৯৮ ঘাটের জল খেয়ে হাজতে ঢোকে তার কোনও পরিসীমা নেই।
আসলে বিয়ে হল অনেকটা তিন-পায়ে দৌড়ের সমগোত্রীয়। বাঁধা পা দু’টো একসঙ্গে আগে ফেলতে হয়। এক ছন্দে দৌড়তে পারলে দিব্যি দৌড়বে, কোনও ঝামেলা নেই। যে যার মতো দৌড়তে গেলেই হুমড়ি খাবে দু’জনেই। সুতরাং হয় নিয়ম মেনে পা ফেলে ছোটো, নয়তো দড়িটা খুলে ফেলে যে যার নিজের পথে হাঁটো। অবশ্য আজকাল বিয়ে না করেও একসঙ্গে থাকা যায়, যার পোশাকি নাম লিভ টুগেদার। সে কাসুন্দি অন্য একদিন ঘাঁটা যাবে, আপাতত দেখুন আজকের ডাকে কোনও বিয়ের চিঠি এল কি না। মানুষ বংশ রক্ষার জন্য বিয়ে করে কিন্তু নেমন্তন্ন রক্ষার জন্য যে বাঁশটা দেয় সেটা আগে সামলান। নিদেনপক্ষে ৫০০ টাকার নিচে কি গিফ্ট দেওয়া যায়!