ছোট নীড়েই আনন্দ

বাড়িটা ছোট।  ঘরগুলোও তেমন খোলামেলা নয়। দুটো শোবার ঘর, খাওয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা।নতুন দম্পতিদের সংসার শুরু হয় সাধারণত এ রকম বাড়ি বা ফ্ল্যাট দিয়েই। ঘর সাজানোর বাজেটও সাধারণত সীমিত হয়। পছন্দ হলেই কিছু কিনে ফেলা যায় না। সঞ্চয় করে প্রয়োজনীয় আসবাবগুলো কেনা হয় একটু একটু করে। তবে ভালোবাসা আর রুচির স্পর্শে এই ছোট্ট নীড়েই গুছিয়ে তুলতে পারেন আপনার সংসার। বিয়ের মৌসুম শেষ হলো মাত্র। এবার সংসার শুরু করার পালা। অনেকেই বিয়ের পর স্বতন্ত্রভাবে সংসার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উল্টোটাও হয়। যেটাই হোক নতুন বাসস্থানটি সাজানো নিয়ে ভালো লাগা থাকে দুজনের মধ্যেই। মাত্র সংসার শুরু করেছেন রাহানুমা হারুন। পুরোপুরি এখনো বাড়ি গুছিয়ে তুলতে পারেননি। সকালে স্বামী-স্ত্রী দুজনই ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে সন্ধ্যার পরই কেনাকাটা শুরু হয়। ‘কেনাকাটার তালিকায় প্রথমেই আছে খাট, আয়না, খাওয়ার টেবিল, সোফা। এরপর কিনব ফ্রিজ। উপহার হিসেবে অনেক বাসনকোসন পেয়েছি। এ কারণে প্রয়োজন ছাড়া এখন এগুলো আর কিনব না। তবে সবকিছুর শুরুতে প্রথমেই দুজনের পরিকল্পনা করে নেওয়াটা জরুরি’, বলেন রাহানুমা হারুন।

খোলামেলা পরিবেশ:
ছোট ঘর, শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে চারপাশের দেয়ালটাকে আরেকটু সরিয়ে দিতে। দেয়াল না পিছিয়েও ঘরকে বড় দেখানো যাবে ইচ্ছে করলেই। স্থপতি মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী জানালেন সে রকমই কিছু পদ্ধতির কথা। ছোট ঘরকে বড় দেখানোর জন্য খাটো ও হালকা আসবাব ব্যবহার করতে পারেন।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত আসবাব না কেনাই ভালো। বাড়ির মধ্যে কোনো কোনা অথবা কলাম থাকলে সে ক্ষেত্রে কিছুটা জায়গা নষ্ট হয়। ইতিবাচকভাবে দেখলে এতে কিছুটা জায়গাও বের হয়। এই জায়গাটুকুতে শেলফ বানিয়ে তাতে বিভিন্ন জিনিস রাখার পরামর্শ দিলেন মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী। নিচু উচ্চতার চেয়ারের জন্য সর্বনিম্ন তিন ফুটের চেয়ার বানাতে বা কিনতে পারেন। উচ্চতা এর কম হলে বসার সময় স্বস্তি নাও পেতে পারেন।

নিচু উচ্চতার খাটে আপনার শোবার ঘরকে বড় দেখাবে। এ ছাড়া মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে শোবার ব্যবস্থাও করতে পারেন। বিছানার দুপাশে টেবিল ল্যাম্পও ভালো লাগবে।ছোট ঘরে হলুদ, কমলা, উজ্জ্বল নীল রংগুলো ব্যবহার করতে পারেন। এই রঙগুলো আলো প্রতিফলিত

করে, ফলে ঘর বড় দেখায়। চাইলে রঙের বদলে ওয়াল ম্যাটও ব্যবহার করতে পারেন। তবে অবশ্যই এ বিষয়ে যাঁরা পারদর্শী তাঁদের সাহায্য নিতে হবে। কারণ ওয়াল ম্যাট দেয়ালে লাগানোর সময় বাতাস ঢুকে গেলে পরবর্তী সময়ে সমস্যা তৈরি হবে। এ ছাড়া ভালো মানের প্লাস্টিক পেইন্ট ব্যবহারে ঘরে চকচকে ভাব আসে। এটাতেও আপনার ঘর দেখতে বড় লাগবে বলে জানান মো. শওকত রাব্বি চৌধুরী ।

নান্দনিক বাসন:
সারা দিন ব্যস্ততার মধ্যে একসঙ্গে বসে সময় কাটানো হয় না অনেকেরই। সকালের চা কিংবা রাতের খাওয়ার সময়টায়ই যা একটু গল্প করা হয়। এ কারণে খাবার পরিবেশনের পাত্রগুলো যদি একটু নান্দনিক নকশার হয় তাহলে তা মন ভালো রাখার মন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার জানান, ‘সাধারণত নতুন দম্পতিরা একসঙ্গে সবকিছু কেনেন না। একটু একটু করে প্রয়োজনমতো বাসন কিনে নিয়ে যান। ক্লে ইমেজে দম্পতিদের জন্য ডিনার সেট, নাশতা খাওয়ার সেট, চা খাওয়ার সেট পাওয়া যায়। বিশেষ কিছু রং ব্যবহার করি আমরা নতুন সংসারকে রঙিন করে তোলার জন্য। তাঁরা চাইলে বাসনের একদিকে আমরা তাঁদের নামও লিখে দিই।’

খাবারের বাসনগুলো দৃষ্টিনন্দন হলে পরবর্তী সময়ে এগুলো অন্য কাজেও ব্যবহার করা যায়। যেমন প্লেট পুরোনো হয়ে গেলে টবের নিচে রাখতে পারেন। ঠিক একইভাবে কাপের হাতল ভেঙে গেলে সেটিকে টব কিংবা রান্নাঘরে চামচ রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।

কম বাজেটেই ষোলো আনা:
নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লাগবে, এমনটি নয়। একটু পরিকল্পনা করে নিলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নতুন দম্পতিদের দেশীয় জিনিসের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ থাকে। কাঠের আসবাবের থেকে এগুলোর দামও কিছুটা কম হয়ে থাকে।কাঠের আসবাবের বদলে বিভিন্ন বোর্ডের তৈরি আসবাব ব্যবহার করা যায়।এ ক্ষেত্রে বেতের আসবাব, রট আয়রনের আসবাব, হোগলা পাতার তৈরি আসবাবও রুচিশীল পরিবেশ তৈরি করবে।

ডেকর ইডের আসবাব ডিজাইনার তৌহিদা হক জানান, ‘মানুষের জীবনযাত্রা ও রুচির পরিবর্তনে বদলে গেছে বাড়ি সাজানোর ধরনও। বাড়ি সাজানোর সময় শুধু প্রয়োজন ছাড়াও একটু সৌন্দর্যের ছোঁয়া সবাই চায়। অনুষঙ্গগুলো রুচিকর হলে তা বাড়ির পরিবেশে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলবে।’হোগলা পাতার তৈরি আসবাবগুলো একসঙ্গে দুটি কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারবেন। দম্পতিদের জন্য ডেকোর ইডেতে আছে মিনি প্রিক্স সোফাসেট। এতে আছে একটি দুই সিট, একটি এক সিটের সোফা এবং একটি সেন্টার টেবিল। এর নিচের অংশে ড্রয়ার

 

বানিয়ে নিতে পারেন। এ ছাড়া মোড়া, বেবি চেয়ার, অটোমান চেয়ারগুলো নতুন সংসারের জন্য সাশ্রয়ী ও উপযুক্ত বলে জানান তৌহিদা হক।

দেশীয় উপকরণে তৈরি টেবিল ল্যাম্প, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, ঝুড়ি, শো-পিস দামেও কম হবে, দেখতেও ভালো লাগবে। এগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে ছোট গাছ বা মানিপ্ল্যান্ট রাখার পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞরা। দেয়ালে পেইন্টিং ঝোলাতে পারেন। তবে সেটি আপনার ঘরের অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে যাচ্ছে কি না, সেটি খেয়াল করবেন। ঘরের বিভিন্ন কোনায় রাখা টেবিল ল্যাম্পের আলো মায়াবী ও রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করে। দেয়ালে আয়নাও লাগাতে পারেন। আয়নার প্রতিফলনে ঘরকে কিছুটা বড় লাগে। প্রয়োজনীয় চাবি রাখার জন্য দেয়ালেই ব্যবস্থা রাখুন।

স্নানঘরের নান্দনিকতা:
স্নানঘর ছোট হোক কিংবা বড়, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যদি জায়গা থাকে তাহলে ছোট গাছ রাখুন। প্রাণবন্ত ভাব আসবে। ছোট মোমদানি কিংবা দু-একটি শো-পিসও রাখতে পারেন। বেসিনের বা তাকের ওপর জায়গা না হলে দেয়ালেও কোনো কিছু ঝোলাতে পারেন। এতে করে বৈচিত্র্য তৈরি হবে। শাওয়ার কার্টন ব্যবহার করলে সব জায়গায় পানি ছড়িয়ে যাবে না। মেঝেতে ম্যাট্রেস রাখতে পারলে ভালো, ভেজা জায়গায় পা পিছলে পড়ার ভয় থাকবে না। মেঝে সব সময় শুকনা রাখার চেষ্টা করুন।বাথরুমের সাবান, হ্যান্ডওয়াশ ও অন্যান্য প্রসাধনী রাখার পাত্রের সেট পাওয়া যায়। চাইলে দেয়ালের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কিনে নিতে পারেন। ছোট-বড় কয়েক আকৃতির তোয়ালে রাখুন। কোনোটি হাত মোছার জন্য, কোনোটি গোসলের পর ব্যবহারের জন্য।

বাড়তি একটু জায়গা:
বাড়িতে প্রয়োজনের তুলনায় একটি ঘর বেশি পেলে মনের মতো করে সাজান। সেটাকে টিভি দেখার ঘর কিংবা পড়ার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। নিচু বিছানা, উজ্জ্বল নকশার শতরঞ্জি, নিচু চেয়ার, অনেক কুশন দিয়ে বৈচিত্র্য তৈরি করতে পারেন। তবে একটি ঘরের সব আসবাব নিচু হলে দেখতে ভালো লাগবে না। উঁচু আসবাবগুলো পেছনে বা দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে রাখুন। নিচু আসবাবগুলো সামনের দিকে রাখুন। সারা দিন পরে যেখানে নিজেদের মতো করে কাটানো যাবে একান্ত কিছু মুহূর্ত। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার জন্যও কিন্তু এমন একটি ঘরের কথাই প্রথমে মনে আসবে।

উজ্জ্বলতা বাড়াতে:
নতুন দম্পতির বাড়িতে রঙের ছটা না থাকলে দেখতে কিছুটা বেমানান লাগে। বাড়িতে উজ্জ্বলতা আনার কিছু জন্য কিছু পদ্ধতির কথা জানালেন এথনিকার স্বত্বাধিকারী নাসিরা মানসুর। উজ্জ্বল রঙের শতরঞ্জি, পর্দা, কুশন ব্যবহারে ঘরে বৈচিত্র্য আসবে। প্রিন্ট করা সুতির পর্দা ব্যবহার করলে ঘরে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারবে। একরঙা পর্দা ব্যবহার করলে প্রিন্ট করা কুশন কভার পছন্দ করুন। উল্টোটাও করতে পারেন। শোবার ঘরের কোনায় সম্ভব হলে ছোট একটা বসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। না হলে শতরঞ্জির ওপরেও অনেক রঙের কুশন রাখা যায়। এতে করে বাড়তি বসার জায়গাও হবে, কিছুটা ভিন্নতাও আসবে।

– রয়া মুনতাসীর