অমিল গুলো মেনে নিন – সুখে থাকুন

তাকে বোঝার চেষ্টা না করাটাই হল প্রধান বাধা। ভালবাসা চান কিন্তু তার মন, মেজাজ, রুচি কেমন সেদিকে খেয়াল রাখছেন না, এমন হলে মিল হবে না। মিলন ত দূরে! খেয়াল রাখার কাজটা মানুষ সাধারণত অভ্যাসবশে করে। অভ্যাসবশে সবটা খেয়াল করতে পারলে সেটা খুব চমৎকার, কিন্তু অভ্যাসবশে সবটা খেয়াল করা নতুন নতুন মোটেও সম্ভব না।

বিশেষ মনোযোগ আবশ্যক। কারণ নতুন নতুন সে তার মনের কথা, সব কথা গড়গড় করে আপনাকে বলে দেবে না। হয়ত একটা শব্দ বলল, তাও এমনভাবে বলল যে তা আপনার মনে কোনো দাগ কাটল না। একটু পরেই ভুলে গেলেন। এমন হলে বিপদ আছে।

যা বলছে তা গভীরভাবে মন দিয়ে উপলব্ধি করুন। সমস্যা বোঝার চেষ্টা ও ভাল লাগার বিষয়-আশয় জানার চেষ্টা থাকবে। তারপর সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ ও ভাল লাগায় পানি ঢালা, সার দেওয়া, ভালবাসার চারা লাগানোর কাজটা! প্রক্রিয়া লম্বাই বটে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সবাই লম্বা সময় দেয়ও বটে, কিন্তু প্রায়ই একপক্ষ মোটেও ধৈর্য ধরতে চায় না! এখানে যথেষ্ট গোল বাধে।

তার মনের কথা, সমস্যার কথা বোঝার উপায় কী?

প্রয়োজনে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করতে হবে! নয়ত বলবে কেন? আপনি তার কে যে আপনাকে গড়গড় করে সব বলে দেবে?

বোঝার জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। আগ্রহ থাকবে পুরোপুরি। তবে এগোতে হবে একটু করে। তাড়াহুড়ো করলে ফল ধরার সম্ভাবনা কম।

জানতে হবে বোঝাপড়ার সীমানা।

সে যতটুকু চায় ততটুকু বোঝার চেষ্টা করা ভাল। এমনকি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেও মনে রাখা ভাল সে কতটুকু আপনাকে বলতে চায়। যা বলতে চায় না তার জন্য চাপাচাপি ভাল না।

ভালবাসা মানে সবকিছু শেয়ার করা?

এ ব্যাপারে সবাই এক মত না। সুতরাং তার একান্ত কিছু বিষয় তার মধ্যেই থাকতে দেওয়া ভাল। আপনি বরং আরো ঘনিষ্ঠ, আরো বিশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলে একদিন হয়ত সব বলে দেবে। প্রতিটা মানুষই দেহে ও মনে আলাদা। তাহলে আপনি তার সঙ্গে শতভাগ মিল চান কোন আক্কেলে? সে আমাকে এটা বলল না, সে কেন এটা করল—এসব নিয়ে দুঃখ-মনস্তাপ না করাই ভাল। বরং কিছু অমিল মেনে নিতে পারলেই সুখের সম্ভাবনা বেশি।

বিয়ের প্রস্তুতিঃ বর-কনের আচরণ ও কিছু সতর্কতা

বিয়ের আগের ও পরের আচরণ বর-কনের পরবর্তী জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। তাই দুজনই সতর্ক থাকুন।  ভেবেচিন্তে একে অপরের সঙ্গে আচরণ করুন।  কী করবেন আর করবেন না, জানাচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহমেদ তুষার –

বিয়ের পর প্রায়ই স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে নানা রকম কষ্ট, যন্ত্রণা কিংবা অসন্তুষ্টি দেখা যায়।  অথচ একটু সচেতন হলেই অশান্তি দূর করে সাংসারিক জীবনে বসন্তের রং ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।   বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব সাধারণ কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো একটু জেনে নেওয়া যাক।

বিয়ের আগে: বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীরা ছোটবেলা থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করে রাখা আদর্শ বা পারফেক্ট পাত্র বা পাত্রী খুঁজতে থাকে। জেনে রাখা দরকার যে পৃথিবীর কেউই পারফেক্ট নয়। এ ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থানের কথা মাথায় রেখে প্রত্যাশার একটা ন্যূনতম মান নির্ধারণ করে পাত্র-পাত্রী খোঁজা ভালো। পাত্র-পাত্রী খোঁজার সময় তাদের ব্যক্তিত্ব, পেশাগত কাজের ধরন, পারিবারিক সংস্কৃতি ও রীতিনীতি জানা প্রয়োজন।

দেখতে যাওয়া: বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীকে দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। পাত্র-পাত্রীর নিজেদেরও পরিচিত হয়ে নেওয়াটা দরকার। কিন্তু বারবার দেখতে এলে তার মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। বিয়ের পরও এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যেতে পারে। ছবি দেখে ও খোঁজখবর নিয়ে পছন্দ হলে কোনো রেস্টুরেন্ট বা মার্কেটে পাত্রীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে দেখা করুন এবং স্বাভাবিক সামাজিক কথাবার্তা বলে একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করুন। সব দিক থেকে পছন্দ হলেই শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্র-পাত্রীর বাসায় যাওয়া উচিত। পাত্র বা পাত্রীকে দেখতে গিয়ে এমন কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য করবেন না, যা তার জন্য অপমানজনক।  কোনো তথ্য জানতে হলে কৌশলী হোন।

বিয়ে ঠিক হলে: বিয়ে ঠিক হলে পাত্র-পাত্রী নিজেদের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে নিতে পারলে ভালো। একই সঙ্গে উভয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অন্তত ফোনে হলেও কথা বলে সম্পর্কগুলো সহজ করে নেওয়া যেতে পারে। এ সময় সততার সঙ্গে তথ্যর আদান-প্রদান করা উচিত। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী তার ভাবী স্ত্রী বা স্বামীকে একজন আদর্শ স্ত্রী বা স্বামী হিসেবে কল্পনা করতে পছন্দ করে। শ্বশুর-শাশুড়িসহ সবাই তাকে আদর করবে, সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক থাকবে। মনে রাখতে হবে, আদর্শ ও বাস্তবতার মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য থাকবে। কারণ কেউই সব দিক থেকে আদর্শ নয়। অন্যদিকে তাদের মধ্যে কিছু আশঙ্কাও কাজ করতে থাকে। মেয়েদের মধ্যে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন হবে, তাদের সঙ্গে মানাতে পারবে কি না, স্বামী তাকে বুঝবে কি না, এ ছাড়া তার প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে যেতে হবে—এটার একটা কষ্ট তার মধ্যে দানা বাঁধতে থাকে। বিয়ের আগে ও পরে পাত্র-পাত্রীর একে অপরের আশঙ্কাগুলো বুঝে তাকে আশ্বস্ত ও সহায়তা করা উচিত।

বিয়ের দিন কনেকে ঠাট্টা নয়: বিয়ের দিন ঠাট্টা বা ঠকানোর বিষয়টি পুরনো প্রচলন। ঠকানোর বিষয়টি অন্যদের ওপর তেমন প্রভাব বিস্তার না করলেও কনের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। কনে অনেক মানসিক চাপ, আশঙ্কার মধ্যে থাকে এবং তাকেই নতুন পরিবেশে যেতে হয়। এ কারণে তার মনের অবস্থা নাজুক থাকে। তাই সামান্য পিনের খোঁচা বুলেটের চেয়েও বেশি ব্যথিত করে। এটার প্রভাব মেয়েটির মনের অজান্তেই দীর্ঘদিন থেকে যায়। এ জন্য বিয়ের দিন প্রথম দেখাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন বউয়ের সঙ্গে ঠাট্টা না করে সহমর্মিতার সঙ্গে কথা বললে তার সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

বিয়ের পর:  বিয়ের পর স্ত্রী স্বামীকে আরো বেশি করে অনুভব করে এবং স্বামীও তার মতো করে প্রচণ্ড আবেগ দিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করুক—এটা প্রত্যাশা করে। অনেকে এই আবেগকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনে করে বিরক্ত হয়। অন্যদিকে সামাজিক কারণেই স্বামীকে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়—স্ত্রীকে সম্মানজনক অবস্থায় রাখতে হবে, সন্তানদের ভবিষ্যৎ তৈরি করতে হবে ইত্যাদি। ফলে স্ত্রী মনে করে, স্বামী তাকে আর আগের মতো ভালোবাসে না। এ সময় সন্দেহের সুপ্ত বীজ উপ্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ছেলেটি যে মেয়েটিকে ভালোবাসে না তা নয়, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারে না অথবা প্রকাশ করার প্রয়োজন অনুভব করে না। হয়তো স্ত্রী-সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্যই সে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এ সময় স্বামীর উচিত স্ত্রীর আবেগকে বোঝার চেষ্টা করা এবং স্ত্রীকে যথাসম্ভব সময় দেওয়া। একই সঙ্গে স্ত্রীরও বোঝা উচিত স্বামীর ব্যস্ততার অর্থ ভালোবাসা কমে যাওয়া নয়, এই পরিশ্রমের উদ্দেশ্য তাদের ভালো রাখার প্রচেষ্টা।

নবদম্পতি ও যৌথ পরিবার: যৌথ পরিবারে অনেক সময় দম্পতিরা একান্তে সময় কাটানো বা একটু কাছাকাছি আসতে কুণ্ঠা বোধ করে। ফলে তাদের মানসিক চাহিদা পূর্ণ হয় না। বরং এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। স্বামী হয়তো বাইরে গিয়ে অস্বস্তি কিছুটা কমিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু স্ত্রীর মধ্যে দিনে দিনে অস্বস্তিটা জমাট বাঁধতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এই অস্বস্তি সংযুক্ত হয়ে যায়। ফলে মেয়েটির মনের অজান্তেই পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিরক্তিবোধ তৈরি হতে থাকে। একান্ত সময়গুলোতে যাতে সে অবাধে সারা দিনের আবেগ প্রকাশ করতে পারে, সেই সুযোগ দিতে হবে। তার আবেগের প্রতি অতিপ্রতিক্রিয়াশীলতা দেখানোর প্রয়োজন নেই, বরং তার আবেগকে স্বীকৃতি দিতে হবে। যৌথ পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত নবদম্পতিকে কিছুটা সময় একান্তে কাটানোর সুযোগ দেওয়া। মেয়েটি যাতে এই পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠতে পারে, এ বিষয়ে তাকে সহায়তা করা।

স্ত্রী ও পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা: বিয়ের পর ছেলেটিকে যে শক্ত কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় তা হচ্ছে স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্য, বিশেষত মায়ের মধ্যে ব্যালান্স করা। ছেলেটির জন্য মা ও স্ত্রী তার দুই হাতের মতো; কোনোটিই তার বেশি আপন বা পর নয়। একইভাবে সে মা ও স্ত্রী উভয়েরই ভালোবাসার পাত্র, দুজনই তার কাছ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ প্রত্যাশা করে, যা খুবই স্বাভাবিক। তাই ছেলেটিকে এ ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে হবে। মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে এবং কাউকে কষ্ট না দিয়ে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে।

জীবনধারার পরিবর্তন: বিয়ের পর ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই তার লাইফস্টাইল পরিবর্তন করতে হয়। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় দেওয়া কমে যায় এবং খাওয়া, ঘুমসহ জীবনের নানা উপাদান নতুন মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে উভয়কেই কিছুটা ছাড় দিতে হবে। খরচের হাত কিছুটা সীমিত করতে হয়। তবে মনে রাখা দরকার, হঠাৎ করে লাইফস্টাইল পরিবর্তন করা কঠিন। এ জন্য তাকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত এবং উন্নতি হলে উৎসাহিত করা উচিত।

বিয়ের পর ভালো সম্পর্ক রাখতে করণীয়:
♦ মনে রাখুন, বিয়ে হলেই অবধারিতভাবে ভালোবাসা থাকবে তা নয়। ভালোবাসা তৈরি ও রক্ষার জন্য সব সময় স্বামী ও স্ত্রী দুজনকেই ভূমিকা রাখতে হয়।
♦ নতুন জীবনের সঙ্গে আপনার লাইফস্টাইলটা অ্যাডজাস্ট করে নিন।  যেকোনো সম্পর্কই ছাড় প্রত্যাশা করে।
♦ স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে আনন্দদায়ক কিছু করুন; যেমন—দূরে বেড়াতে যাওয়া, একসঙ্গে হাঁটা, মার্কেটে যাওয়া। আপনার কোনটাতে ভালো লাগবে তা আপনার সঙ্গীকে বলুন এবং তারটিকেও গুরুত্ব দিন।
♦ সঙ্গীর ভালো কাজের সত্যিকারের প্রশংসা করুন।
♦ মাঝে মাঝে উপহার দিন, সারপ্রাইজ দিন এবং সৃজনশীল কিছু করুন, যাতে আপনার স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি যত্ন ও ভালোবাসা প্রকাশিত হয়।
♦ মনের মধ্যে কষ্ট বা ভালো লাগা তৈরি হলে তা ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করুন এবং সঙ্গী প্রকাশ করলে তার স্বীকৃতি দিন। রাগ সঠিকভাবে প্রকাশ করুন। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে পছন্দনীয় কোনো নামে ডাকুন।
♦ পরিবারে কোনো সমস্যা তৈরি হলে খোলামেলা আলোচনা করে সমাধান করুন। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো দুজনে মিলে আলোচনা করে নিন।
♦ উভয় পরিবারকে শ্রদ্ধা করুন এবং পরস্পরকে খোঁচা মেরে কথা বলা এড়িয়ে চলুন।
♦ নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া একে অপরকে সন্দেহ করা এড়িয়ে চলুন। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো বারবার মনে করিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গীকারগুলো রক্ষা করুন এবং তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করুন।  সুত্রঃ কুমিল্লার কাগজ