শুরু হোক নতুন করে

মিলন আনন্দের। তবে তীব্রতার নিক্তিতে মাপলে বিচ্ছেদের পাল্লাটাই বোধহয় বেশি ভারী হয়। রিয়েল লাইফে অনেক সময়ই হ্যাপি এ্যান্ডিং হয় না। অনেকেই প্রথম লাইফ পার্টনারের সাথে শেষতক কন্টিনিউ করতে পারেন না। ত্রুটি কার সেটা নিয়ে মাতামাতি করে চললেও সমাজ কখনোই এর সমাধান বাতলায় না। কিংবা বাতলাতে পারে না।

পারিবারিক জীবনে ভাঙন ও বিপর্যয় অত্যন্ত মর্মান্তিক ব্যাপার। বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে এ বিপর্যয়ের চূড়ান্ত পরিণতি। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ-বিরোধ, মনোমালিন্য দেখা দিতেই পারে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ যখন চরমে, পরস্পর মিলেমিশে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্যমন্ডিত জীবন-যাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, পারস্পরিক সম্পর্ক যখন হয়ে পড়ে তিক্ত, বিষাক্ত, একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমনভাবে বিমুখ হয় যে, তাদের শুভ মিলনের আর কোন সম্ভাবনা থাকে না, তখনই মানুষ এই চূড়ান্ত পন্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়।

ডিভোর্সই তখন নিষ্কৃতিলাভের একমাত্র উপায়। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭ ধারামতে, তালাক সংক্রান্ত যে বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে, সেখানে তালাক ঘোষণার কোন পদ্ধতি বলা হয় নি। মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাহাকে মুসলিম আইনে অনুমোদিত যেকোনো পদ্ধতিতে ঘোষনার পরই তিনি তাহার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এ মর্মে চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে নোটিশ প্রদান করবেন এবং স্ত্রীকেও উহার নকল দিবেন। অর্থাৎ তালাক প্রদান বা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়তের প্রবর্তিত পদ্ধতিই হচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনের পদ্ধতি। তাই শরিয়ত প্রবর্তিত তালাক সংক্রান্ত বিধানাবলী ভালোভাবে জানা ও বোঝা খুবই জরুরী। বিশেষ করে নিকাহ রেজিষ্ট্রারদের এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।

তালাকের সংজ্ঞা

তালাক শব্দের অর্থ ত্যাগ করা বা বন্ধন খুলে দেওয়া বা বাঁধন খুলে ফেলা বা শক্ত রজ্জুর বাঁধন খুলে ফেলা। আরবি ভাষায় বলা হয়, আমি শহর ত্যাগ করেছি। শরিয়তের ভাষায় তালাক অর্থ বিবাহের বাঁধন খুলে দেওয়া বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলে দেওয়া। মুসলিম পারিবারিক আইনে বিরোধ মীমাংসার জন্য এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপস করার দায়িত্ব চেয়ারম্যান বা সালিস পরিষদের উপর। তিনি উভয়পক্ষকে নোটিশের মাধ্যমে উপস্থিত হবার জন্য বলবেন। কোন পক্ষ যদি হাজির না হয়, তবে তাকে হাজির করার ক্ষমতা তার নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করা ছাড়া চেয়ারম্যানের আর কোন দায়িত্ব নেই। মজার ব্যাপার হলো, এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যেই তালাক প্রবণতা বেশি।

ডিভোর্স-পরবর্তী জীবন-যাপন

বলা হয়, বিবাহবিচ্ছেদ মৃত্যুর মতোই যন্ত্রণাদায়ক। ডিভোর্সের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ে বাচ্চাদের উপর। বাবা-মায়ের মনোমালিন্যের কারণে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় শিশুদের। অনেক ক্ষেত্রেই সিঙ্গেল ফাদার কিংবা সিঙ্গেল মাদারের পক্ষে এককভাবে শিশুকে বড়ো করা সম্ভব হয় না। ফলে দ্বিতীয় বিয়ের অপশন গ্রহণ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে আগের পক্ষের বাচ্চাটি আরও নাজুক অবস্থায় পড়তে পারে। নতুন বাবা কিংবা মাকে মেনে নেয়া তার পক্ষে কঠিণ হয়ে পড়ে। যেমনটা হয়েছিলো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের জীবনে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের ফলে শৈশব তিক্ত হয়ে যাওয়ায় পরবর্তীকালে তিনি এর স্মৃতিচারণা করতে চাইতেন না।

বৈবাহিক দ্বন্দ্ব এবং বিবাহবিচ্ছেদ যেমন আপনার পরিবারে বয়ে আনে অন্থিরতা তেমনি আপনার সন্তানদের মাঝে তৈরী করে চরম অনিরাপত্তা। গবেষকরা বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ একটি শিশুর শিক্ষণ-প্রক্রিয়া ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ করে। বিশেষ করে আন্তব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়। পাশাপাশি বিবাহবিচ্ছেদের ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সমস্যা সৃষ্টি করে।

আমেরিকান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানেরা সারা জীবন আন্তর্ব্যাক্তিক যোগাযোগ এবং অন্যদের সঙ্গে আন্তরিকতা তৈরীতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। এতে সন্তানেরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। এবং পরবর্তীতে বিবাহিত জীবনে এর প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি বাবা-মায়ের প্রতি তাদের অবিশ্বাস বাড়ে। এতো আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকি পড়ে সন্তানেরা।

ক্লিনিক সাইকোলজিস্ট ইলসে টারবালন্স বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ কোনো বাবা, মা কিংবা সন্তানেরা চায় না। গবেষকেরা জানান, যেসব শিশু পারিবারিক চলমান দ্বন্দ্ব বা সংঘাতের মধ্যে বড় হয়, তারা স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠা শিশুদের চেয়ে মানসিকভাবে অনেক দুর্বল থাকে।

ডিভোর্সকে সবাই যে নেগেটিভ পারস্পেকটিভ থেকে দেখেন তা নয়। ডিভোর্স সম্পর্কে হলিউড তারকা টম হ্যাংকসের দৃষ্টিভঙ্গি শুনুন, এটা (ডিভোর্স ) কোন ক্রাইম নয়। কোনো ট্রাজেডিও নয়।আমার আব্বা তিনবার বিয়ে করেছেন। শেষ সঙ্গীদের সাথে তারা সুখেই আছেন।

যদিও আরেক সাক্ষৎকারে তিনি তার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে দুঃখও করেছেন। সেই সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়া মানে ছিলো, আমি আমার সন্তানদের সেই একই শাস্তি দিচ্ছি, যেটার ভিতর দিয়ে আমি ওই বয়সে গেছি। (হ্যাংকসের শৈশবে তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়েছিলো )। কিন্তু, আমার বয়স ছিলো খুবই কম। বিয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার পক্ষে সেটা ছিলো খুবই অনিরাপদ। আমার বয়স ছিলো ২৩ বছর। ছেলে কলিন্স ততদিনে দুই বছরের হয়ে গেছে। এই দায়িত্বগুলো নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হ্যাংকসের সরল স্বীকারোক্তি।

সবার পক্ষে বিবাহবিচ্ছেদকে এত সহজভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষত, ভারতীয় উপমহাদেশের রক্ষণশীল সমাজে বিবাহবিচ্ছেদকে ভালো চোখে দেখা হয় না। যেমন, বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজে ডিভোর্সড নারীর পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা অত্যন্ত কঠিন। আর সেকেন্ড ম্যারেজ হলেও সমাজে ওই নারীর অবস্থান কয়েকধাপ নিচে নেমে যায়।

উন্নত বিশ্বে বিবাহবিচ্ছেদ বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে সহজভাবে দেখা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবাহবিচ্ছেদকে দেখা হয় বাঁকাচোখে। দেশের সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে নারীকে সমাজের কাছে হেনস্তা হতে হয় নানাভাবে।

মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল বলেন, বিবাহবিচ্ছেদের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার মতো শিথিল স্নায়ুর মানুষেরও অভাব নেই। তবে, এ ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাই বেশি। এর প্রধান কারণ, আমাদের সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির নিম্নমুখিতা।

প্রথম কাজ হবে এই সেপারেশন মেনে নেওয়া

ডিভোর্সের পর হতাশ হয়ে পড়াটা খুব স্বাভাবিক। কখনও কখনও হতাশার মাত্রা এতো বেড়ে যায় যে, অনেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। বিশেষত ইয়ং জেনারেশনের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। কিন্তু, বাস্তবতা মেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভেতরের ক্ষোভ পুষে রাখবেন না।

টেক এ ব্রেক

মনে রাখবেন, আপনি সুপারম্যান কিংবা সুপারওম্যান নন। নতুন করে রিচার্জড হতে, রিঅর্গানাইজড হওয়ার জন্য একটু বিশ্রাম নিন। প্রবাদ আছে, যেকোনো ক্ষত সারাতে সময়ই সবচেয়ে মোক্ষম দাওয়াই। তাই নতুন কোন সম্পর্কে জড়ানোর আগে সময় নিন। তাড়াহুড়া করবেন না।

শেয়ার করুন

নিজের আবেগ-অনুভূতি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে শেয়ার করুন। কথায় বলে, আনন্দ ভাগাভাগি করলে তা বেড়ে যায় এবং দুঃখ শেয়ার করলে তা হালকা হয়। একা চলার মতো হটকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। একাকিত্ব স্ট্রেস লেভেল বাড়ায়।

প্র্যাকটিক্যাল হোন

স্বাভাবিক সময়ের যে প্রতিক্রিয়া ও ব্রেকআপকালীন প্রতিক্রিয়ার মাঝে যে পার্থক্য আছে, সেটা বুঝার চেষ্টা করুন। নিজের মনোবেদনার কারণ বোঝার চেষ্টা করুন। অনুভূতির সাথে লড়বেন না।

বিশ্বাস রাখুন নিজের উপর

সব শেষ হয়ে যায় নি। পুরোনোকে ভুলে আবার নতুন করে শুরু করা সম্ভব। ডিভোর্সের পর অনেকেরই আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়। তারপরও ভরসা রাখুন। কারণ, সম্পর্কে ভাঙন খুবই স্বাভাবিক।

অন্যের কাছে খুলে বললে কষ্টের ভার কম লাগবে

বিশেষত ব্রেকআপের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি সত্য। আলোচনার মাধ্যমে অনেক সময়ই সুফল পাওয়া যায়। যন্ত্রণার কথাগুলো বলে ফেললে নিজের ওপর চেপে থাকা বোঝাটা অনেক হালকা হয়ে যায়।

ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সান্নিধ্যে থাকুন

ব্রেকআপ বা ডিভোর্সের পর ফ্রেন্ডস ও রিলেটিভদের সাপোর্ট টনিকের মতোই কাজ করে। অনেকেই এ সময়টা একা থাকতে চান। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এই ধরণের আইসোলেশনের কারণে পুরো বিষয়টা আরো খারাপের দিকে যায়।

যেসব বন্ধু ও ফ্যামিলি মেম্বারদের বিশ্বাস করা যায়

সাপোর্টের জন্য তাদের কাছে যান। যারা এর আগে ব্রেকআপ কিংবা ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে গেছে, তাদের পরামর্শ বেশি সহায়ক হতে পারে। ডিভোর্সের পরও যে মানুষের জীবন আছে, এই বিষয়টি আপনি তাদের কাছ থেকে ভালো জানতে পারবেন। সেইসব মানুষের সাথে সময় কাটান যারা আপনাকে বোঝেন, যারা আপনাকে সত্যিকার অর্থেই সাপোর্ট করেন। সাবধানতার সঙ্গে সঙ্গী বাছাই করুন। কারণ, অনেকেই আপনার দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিতে পারে।

বাইরের সাহায্য

তা হতে পারে কোন কাউন্সেলর। বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকেই এটা নিয়ে কাজ করেন। সারা যাকের, মোহিত কামাল, মেহতাব খানম প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। সাপোর্ট গ্রুপে জয়েন করতে পারেন, যেখানে আপনি আপনার মনের কথা খুলে বলতে পারেন।

নতুন বন্ধু

ব্রেকআপ বা ডিভোর্সের সাথে সাথে আপনার পুরোনো গন্ডিটাও হারিয়ে ফেলেছেন বলে মনে করেন, হতাশ হবেন না। ফ্রেন্ডশীপ করুন নতুন কারো সাথে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করুন। স্পেশাল ইন্টারেষ্ট ক্লাবে জয়েন করতে পারেন। কমিউনিটি সার্ভিসে যোগ দিতে পারেন। ভলান্টিয়ার হিসেবে বিভিন্ন অলাভজনক কমিউনিটিতে কাজ করতে পারেন।

নিজের যত্ন নেওয়া সবচেয়ে জরুরী

মানুষের জীবনে ডিভোর্স নিঃসন্দেহে একটি হাইলি স্ট্রেসফুল ঘটনা। যেহেতু এটা গোটা জীবনেই পরিবর্তন এনে দেয়, সেহেতু সেই সময় নিজের যত্ন নেয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরণের মেজর ব্রেকআপের পর আপনি মানসিক এবং শারীরিক দুভাবেই ভঙ্গুর থাকতে পারেন। নিজের সাথে এমন আচরণ করুন, যেনো আপনি একটি সাময়িক অসুস্থতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। প্রচুর বিশ্রাম নিন। স্ট্রেসফুল কাজ কমিয়ে দিন। যতটা সম্ভব কম কাজ করুন।

সেলফ কেয়ার টিপস, নিজের নিয়মিত পরিচর্যা

গান শুনুন, যোগব্যায়াম করুন। মেডিটেশন ক্লাসে যান। নতুন ভাষা শিখতে পারেন। প্রিয় কোন বই পড়ুন। ধোঁয়াউঠা নতুন কফিতে শুরু করুন নতুন দিন। মুক্ত বাতাসে নিজের বাগানে একটু হেঁটে আসুন। কিংবা চলে যান বোটানিক্যাল গার্ডেনে। কিছুটা সময় কাটান প্রকৃতির মাঝে। সত্যিকারভাবে আপনি কী চান, তা লক্ষ্য করুন। নিজেকে শুনুন। অন্যরা কী চায়, সেদিকে মনোযোগ দেবেন না। কোনটা আপনার নিজের জন্য ভালো, তা লক্ষ্য করুন।

একটি রুটিন করুন এবং তা মেনে চলুন

ডিভোর্স কিংবা রিলেশনশিপে ব্রেকআপ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। চাপ, অনিশ্চয়তা, বিশৃঙ্খলা তৈরী করে। রেগুলার রুটিন আপনাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করবে।

সময় নিন অপেক্ষা করুন

ঝোঁকের মাথায় নতুন চাকরীতে জয়েন করা কিংবা সব ছেড়েছুড়ে নতুন কোনো শহরে যাওয়ার মতো মেজর ডিসিশন নেবেন না। সময় গেলে আবেগ কমবে। নিরাবেগ অবস্থায় আপনি অপেক্ষাকৃত ভালো ডিসিশন নিতে পারবেন।

অ্যালকোহল, ড্রাগস বা এমন কিছুকে প্রশ্রয় দেবেন না

এগুলো জীবনে দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এমনকি আপনাকে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিতে পারে।

নতুন নতুন বিষয়ে উৎসাহ খুঁজুন

আশাবাদী হোন। একটি সম্পর্কের শেষ, অনেক নতুন কিছু শুরু করার প্রেরণা যোগায়। সেটা কাজে লাগান। আনন্দ খুঁজুন, আনন্দ করুন। জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করুন।

পুষ্টিকর খাবার খান, ব্যায়াম করুন, বিশ্রাম নিন

ডিভোর্স একজন মানুষের জীবনে মেজর সেটব্যাকগুলোর একটি। বাইরের ফোর্সগুলো হয়তো আপনাকে কিছুটা হেল্প করতে পারে। শেষ পর্যন্ত এটা নিজেকেই ফেস করতে হয়। যত সহজে একে মেনে নিতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবেন। কবিগুরুর বাণী এখানেও প্রাসঙ্গিক, ভালোমন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে।

লিখেছেনঃ

বিদিত চৌধুরী
গনমাধ্যম কর্মী

সংখ্যাতত্ত্বে বিচ্ছেদ

ডিভোর্স শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিবাহচ্ছেদ অথবা বিবাহবিচ্ছেদ। বিবাহিত নর-নারীর জীবিত অবস্থায় আইনগত বিবাহ-সম্পর্কের পরিসমাপ্তিই ডিভোর্স। শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামবাংলার নারীদের মুখ ও তাঁদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক কষ্ট। আমাদের সমাজে নারীর জন্য অভিশপ্ত জীবন বয়ে আনে ডিভোর্স। চিরায়ত নারীর কাছে স্বামীর ঘরই যেন সকল নিরাপত্তার এবং শান্তির আশ্রয়। পক্ষান্তরে পুরুষেরা ডিভোর্সের মাধ্যমে পুনর্বিবাহের সুপ্ত বাসনা কায়েমের সুযোগ খুঁজে পায়। এটা যেন সামাজিক রীতি। শহর অঞ্চলে ডিভোর্সের পরিব্যাপ্তির রূপ ভিন্ন। ডিভোর্স যেন স্বাধীনতা বা অধিকারের ঢাল। মেয়েরাই ছেলেদের তুলনায় বেশি ডিভোর্সের আবেদন বেশি করে। পরকিয়া (বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক )বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে তিক্ততা ডিভোর্সের অন্যতম কারণ,  যা নারীর অধিকার রক্ষার হাতিয়ার। পাশ্চাত্যে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ডিভোর্সের হার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ৫০ শতাংশ বিবাহ ডিভোর্স পর্যন্ত গড়ায়। ৬৭ শতাংশ দ্বিতীয় বিবাহ ভেঙে যায়। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহচ্ছেদের হার কমে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে বিবাহচ্ছেদের আর্থিক অক্ষমতা।

ডিভোর্সের একটি সংক্ষিপ্ত পরিসংখ্যান

আমাদের দেশে ডিভোর্সের হার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল অনুসারে, মার্চ ১৯৯৫ থেকে মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত সারাদেশে ডিভোর্সের আবেদন পড়েছে ১৭৩০, যার মধ্যে ঢাকায় ১৩১৭, চট্টগ্রামে ১৩৭, বরিশালে ১০১, খুলনায় ৭২, সিলেটে ৪৮ এবং রাজশাহীতে ১ টা।

২০১৮ সালের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোতে উঠে আসে বিগত বছরগুলোর বিচ্ছেদের হারঃ

ঢাকা ঊত্তর সিটিতে ডিভোর্সের আবেদন পড়ে – ২০১২ সালে ২,৮৮৮ টি,  ২০১৩ সালে ৩,২৩৮ টি, ২০১৪ সালে ৪,৪৪৫ টি, ২০১৫ সালে ৪,০৭৭ টি, ২০১৭ সালে ৫,০৪৬ টি

ঢাকা দক্ষিন সিটিতে ডিভোর্সের আবেদন পড়ে – ২০১২ সালে ৪৫১৮ টি, ২০১৩ সালে ৪,৪৭০ টি, ২০১৪ সালে ৪,৬০০ টি, ২০১৫ সালে ৪,৮৯৭ টি, ২০১৭ সালে ৫,২৪৫ টি

ডিভোর্স কেন হয়

ডিভোর্সের কারণ বহুবিধ। এটা গ্রাম ও শহরে বা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত প্রভৃতি বিভিন্ন ডিসকোর্সে প্রভাবিত। গ্রাম অঞ্চলে ডিভোর্সের প্রধান কারণ যৌতুক। এছাড়া স্বামী কৃর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতন, সন্তান না হওয়া, ছেলে সন্তান না হওয়া, যৌনজীবনে অক্ষমতা, বহুবিবাহ, স্ত্রী বা স্বামীর মানসিক রোগ অন্যতম কারণ। অন্যদিকে শহর অঞ্চলে পরকিয়া, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে নির্যাতন, সন্তান না হওয়া, স্বামী স্ত্রীর দ্বন্ধ, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, যৌনজীবনে অক্ষমতা, মাদকাসক্তি. দ্বন্ধ নিরসনে দক্ষতার অভাব ডিভোর্সের প্রধান কারণ।

যুক্তরাজ্যের বিবাহসম্পর্কিত এক রিপোর্টে গ্রান্ট থরন্টম ডিভোর্সের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে নিম্নরূপ পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন:

  • বিয়েবহির্ভূত শারীরিক সম্পর্ক ও স্বামী-স্ত্রীর বিশ্বাসভঙ্গ ২৭ শতাংশ
  • পারিবারিক নির্যাতন ১৭ শতাংশ
  • মধ্যবয়সের ক্রাইসিস ১৩ শতাংশ
  • মাদকাসক্তি (অ্যালকোহল আসক্তি ও গ্যাম্বলিং ) ৬ শতাংশ
  • কর্মক্ষেত্রে অ্যালকোহল আসক্তি ৬ শতাংশ পরকিয়ার কারণে পুরুষ ৭৫ শতাংশ এবং নারী ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী।

বাংলাদেশ মুসলিম আইন রেজিস্ট্রারের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইকবাল হুসাইনের মতে, ডিভোর্সের অন্যতম কারণ পারিবারিক নির্যাতন যা নারী-পুরুষ উভয়ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ডিভোর্সের মানসিক প্রভাব

ডিভোর্স শুধু স্বামী বা স্ত্রীর আইনগত বিচ্ছেদ নয়। এর মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক বিচ্ছেদ, মানসিক বিচ্ছেদ এবং সর্বোপরি সন্তানের সাথে তাদের সামগ্রিক সম্পর্কের টানাপড়েন। ডিভোর্স যে দেয় এবং যাকে দেয়া হয়- দুজনের উপরই ভিন্ন মানসিক প্রভাব পড়ে। যে ডিভোর্স দেয় সে ভীতিবোধ, নির্ভার, দূরত্ববোধ, অসহিষ্ণুতা, বিরক্তিবোধ, সন্দেহ ও অনুশোচনায় ভোগে। আর যাকে ডিভোর্স দেয়া হয় সে হতবিহ্বল, প্রতারিত, আত্মনিয়ন্ত্রণহীন, নির্যাতিত, আত্মমর্যাদা হ্রাস, নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। তারপর ক্রোধের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজতে থাকে। ডিভোর্স হঠাৎ করে হয় না। ডিভোর্স একরাতে বা একটি দুর্ঘটনার ফল না। ডিভোর্সে শারীরিক বিচ্ছেদের পাশাপাশি মানসিক বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। মানসিক বিচ্ছেদ বিভিন্ন ধাপে হয়ে থাকে যা কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। আবেগী বিচ্ছেদের ধাপগুলো নিম্নরূপ:

ভ্রান্তিকর চিন্তা (যা মৌখিক প্রকাশের ১-২ বছর আগে শুরু হয় )

  • ভ্রান্ত অসন্তুষ্টি, অবিশ্বাস, তর্ক, বিরক্তি
  • বাস্তব সমস্যা অস্বীকার
  • দূরত্ব বৃদ্ধি ও পারস্পরিক আস্থাহীনতা
  • বিচ্ছেদের স্ট্রাটেজি ঠিক করা
  • এ সময়ের অনুভূতি: ভয়, অস্বীকৃতি, দুশ্চিন্তা, অনুশোচনা, ভালোবাসা, রাগ, বিষন্ণতা, শোক।

অসন্তুষ্টি প্রকাশ (আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ৮-১২ মাস পূর্বে )

  • অসন্তুষ্টি প্রকাশ বা উভমুখী আচরণ
  • বিবাহ কাউন্সেলিং
  • এ সময়ের অনুভূতি: দায়হীন, টেনশন, রাগ, অনুশোচনা, তিক্ততা, সন্দেহ, শোক।

বিবাহচ্ছেদের সিদ্ধান্ত (আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের ৬-১২ মাস আগে )

  • আবেগের দূরত্ব তৈরী
  • কেউ কেউ ভ্রান্তিকর চিন্তার মধ্যে থাকে
  • উভয়ে নিজেকে নির্যাতিত মনে করে
  • এ সময়ের অনুভূতি: রাগ, বিরক্তি, বিষন্ণতা, পরিবার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা, অন্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা।

সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করা (আইনি পদ্ধতি শুরু )

  • শারীরিক বিচ্ছেদ
  • মানসিক বিচ্ছেদ
  • নিজেকে পুনঃপ্রস্তুত করা
  • সবার সাথে ডিভোর্স নিয়ে কথা বলা
  • আইনি পদ্ধতি গ্রহণ
  • বন্ধু-পরিবারের পক্ষাবলম্বন
  • ছেলেমেয়েদের দায়িত্ববোধ
  • এ সময়ের অনুভূতি: আঘাতবোধ, আতঙ্কগ্রস্ততা, ভয়, লজ্জা, অনুশোচনাবোধ, ও দোয়ারোপ।

গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো (আইনি পদ্ধতি গ্রহণকালীন বা পরে )

  • শারীরিক ও মানসিক অ্যাডজাষ্টমেন্ট
  • বিবাহ সুখ বা পরিপূর্ণতা আনে না বলে মনে করা
  • নিজের মধ্যে শক্তি ও নিয়ন্ত্রণবোধ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, নিজেকে নতুন করে পরিচয় দেওয়া, নিজেকে মেধাবী ও সম্পদের অধিকারী মনে করা
  • আত্মনিয়ন্ত্রণবো: মন আগের চেয়ে ভালো থাকা ও জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ গ্রহণের আনন্দ অনুভব করা

নতুন করে শুরু ( আইনি প্রক্রিয়া শেষ করা থেকে পরবর্তী ৪ বছরের মধ্যে )

  • অভিযোগ ও রাগ বাদ দিয়ে মাফ দেওয়া ও সম্মান প্রদর্শন, নতুন করে জীবন সূচনা করা
  • অনুধাবন: অন্তর্দৃষ্টি, গ্রহণযোগ্যতা, সামগ্রিক সম্পৃক্ততা, তুলনামূলক সন্তুষ্টি ও আইনি বিবাদ শেষ করা। ডিভোর্সর প্রভাব স্বামী, স্ত্রী, সন্তান ও তাদের পরিবারে পড়ে থাকে। ডিভোর্স হলে একজন নারীর পরিবার তার প্রতি অনেকসময় সহযোগিতামূলক আচরণ করে না। নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক স্টিগমা তাকে তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। অর্থনৈতিকভাবে সে দরিদ্রতায় নিমজ্জিত হয়। শারীরিকভাবে সে অসুস্থ হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিধবা নারী বা পুরুষের অল্প বয়সে মৃত্যুর হার অন্যদের চেয়ে বেশি। ডিভোর্সের মানসিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মানসিকভাবে একজন বিধবা নারী বা পুরুষ অন্যদের চেয়ে বেশি অসুখী থাকে। দুশ্চিন্তা, বিষন্ণতা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিকভাবে তাকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়।

ডিভোর্স যখন আশীর্বাদ

কখনও কখনও ডিভোর্স জীবনে ভালো প্রভাব ফেলে। কোনো কোনো নারী ডিভোর্সকে প্রশান্তিকর মনে করে। এতে তার বিবাহিত জীবন অতিমাত্রায় তিক্ততায় ভরে যায় না এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণ হয় না। কাথনিল ও কন্নেল করকরাণের মতে, ডিভোর্স একজন নারীর জীবনে মা ও স্ত্রীর ভূমিকা ছাড়াও নতুন ক্যারিয়ার, সামাজিক যোগাযোগ এবং নিজের ও পেশাগত ভূমিকা পালনে সুযোগ করে দেয় যার তার মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করে।

বিবাহ বা বিবাহচ্ছেদ দুটিই সামজিক প্রথা। এটা সভ্যতার বিকাশে আদিম অসভ্য মানুষকে সভ্য মানুষ হিসেবে একবিংশ শতাব্দিতে পৌঁছে দিয়েছে। বিবাহ মানুষকে নিয়ম-শৃঙ্খলা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্য উপায়ে বংশানুক্রমিক করে তোলে। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও পারিবারিক কাঠামো গঠনের মাধ্যমে সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। বিবাহ তাই সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক ও গুরুত্বপূর্ণ রীতি। কিন্তু কখনও কখনও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। তাই বিবাহবিচ্ছেদ সর্বদা নেতিবাচক না হয়ে ইতিবাচকও হতে পারে।

লিখেছেনঃ

ডা. মো. রশিদুল হক
এমবিবিএস (ডিএমসি ), বিসিএস (স্বাস্থ্য),এফসিপিএস(সাইকিয়াট্রি )
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও রেজিষ্ট্রার, মানসিক রোগ বিভাগ
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

ভাঙার আগে-পরে

আমি ওকে কেবল আবার একটা ফোন দিতে চাই। যদিও আমি জানি এটা ঠিক হবে না। ও কেবলই আমার সঙ্গে চিৎকার ও দুর্ব্যবহার করবে আমি জানি। এটা ভেবেই আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি বাইরে কাজ-কর্ম করতে পারছি না। একেবারেই মনোযোগ দিতে পারছি না। আমি চিৎকার করে সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আমি ভালো নেই। কিন্তু আমি জানি, তারা আমাকে কাপুরুষ ভাববে। আমি স্বপ্নাকে ছাড়আর কিছুই ভাবতে পারছি না। আমি দিনে দিনে নিঃশেষ হতে যাচ্ছি।

এটি সম্প্রতি বিয়ে ভেঙে যাওয়া এক পুরুষের নীরব আর্তচিৎকার। তিনি ভেবেছিলেন সম্পর্কটি পুনরুদ্ধার করা যায় কিনা। স্ত্রী ও সন্তান থেকে দূরে থাকার ভয়ে তিনি ভীত। হতাশা আর অপরাধবোধ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। কাজকর্মে নিজেকে আগেরমতো সক্রিয় রাখতে পারছেন না।কোনো অন্তরঙ্গ সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার পর এমন প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। পুরুষ বা নারী যেকারো জন্যই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া এক তীব্র মানসিক ও সামাজিক বিপর্যয় হিসেবে কাজ করে। বৈবাহিক সম্পর্ক আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

বৈবাহিক সম্পর্কে ‍সুখী হওয়া না হওয়া নানা বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। আবার বিবাহিত জীবনের নানা পর্বের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোও বেশ কঠিন বিষয়। অবাস্তব প্রত্যাশা, দায়িত্বহীনতা, স্বামী বা স্ত্রীর কাজের মাত্রা-ধরণ, শ্বশুড়-শাশুড়ি ও পরিবারের অন্য সব সদস্যের সাথে মানিয়ে চলা, আর্থিক সমস্যা, যোগাযোগ দক্ষতার অভাব, অবিশ্বস্ততা বৈবাহিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে ভূমিকা রাখে।

সম্পর্কে বিচ্ছেদ ধরার ক্ষেত্রে একক কোনো কারণ নেই। এটি শুরু হয় নানা প্রকিয়ার ভেতর দিয়ে। কখনও কখনও একজন সঙ্গী আলাদা থাকার হুমকি দিয়ে অন্য সঙ্গীর আবেগীয় প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নেয়। এই সংসারে আমি আর পারছি না। আমি চলে যাবো। এ জাতীয় কথাবার্তা মূলত যিনি সম্পর্ক ছেড়ে দিতে চান তার থেকেই বেশি শোনা যায়। বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত আরও একধাপ এগিয়ে যায় যখন কোনো একজন সঙ্গী বলতে শুরু করেন, আমি কালই উকিল নোটিশ পাঠিয়ে দেবো। আমি তোমার কাবিনের টাকা জোগাড় করে ফেলেছি। তুমি চলে যেতে পারো, ইত্যাদি। যদিও মনোবিজ্ঞানীরা ভালোবাসা এবং ঘৃণাকে একই অনুষঙ্গ হিসেবে দেখে থাকেন। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে আমি মরতে চাই যেমন বেঁচে থাকার আকুতি বহন করে, একইভাবে আমি ডিভোর্স চাই এটিও কখনও কখনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার আবেদন।

সম্পর্ক বিচ্ছেদ সবসময় বেদনাদায়ক না-ও হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে বিচ্ছেদের মাধ্যমে ব্যক্তি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। দুটি সত্য ঘটনা তুলে ধরা যাক।

ঘটনা -১

ষাট বছরের রীতা (ছদ্মনাম )সারা জীবন স্বামীর অত্যাচার, যন্ত্রণা সহ্য করে একটু ধাতস্থ হতে চেষ্টা করছিলেন। ভাইদের সহযোগিতায় ছেলেমেয়ে দুজনকে বিদেশে পাঠিয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন। তারা বর্তমানে বিদেশেই প্রতিষ্ঠিত। ছেলেমেয়ের সাথে রীতাও দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। স্বামী রীতার অনুমতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। অর্থনৈতিক বিচারে স্বামী নিজেও সমাজের উচুপর্যায়ের লোক। গা সওয়া রীতা ছেলেমেয়েকে সময় দিতে গিয়ে স্বামীর বিষয়ে ভুলতেই বসেছিলেন বলা যায়। দেশে আসার কিছুদিনর মাথায় রীতা জানতে পারেন, তার নামে প্রায় কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে। শুধু এখানেই শেষ হয় নি।স্বামীর অধিকার নিয়ে তিনি রীতার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়িতে থাকার জন্য জোর দাবি তুলছেন। রীতা না করতে পারেন নি। ছেলেমেয়ের সামাজিক মর্যাদার দিকে তাকিয়ে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি।

ঘটনা -২

বত্রিশ বছরের আরশির (ছদ্মনাম ) বিয়ের বয়স পাঁচ ছুঁই ছুঁই। দীর্ঘ পরিচয় থেকে পরিণয়। শেষমেশ দুই পরিবারের সম্মতিতে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে ছিল মনে রাখার মতো। আস্থা ও ভালোবাসায় পূর্ণ আরশির স্বামী আর্য্য তার কাছে অনেকটা দেবতার মতো। আরশি চাকরি করতেন বিমানের ফ্লাই অফিসার হিসেবে। ফ্লাইটের সাথে জীবনের সূচী মেলাতে গিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন আরশি। আর্য্যর সহযোগীতায় আবারো কাজে মন দেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই আরশির মনে হতে থাকে, সংসারে সময় না দিতে পেরে জীবনে অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছেন। সংসারটা বড়ো ভালোবাসার জায়গা তার কাছে। এক জীবনে স্বামী-সংসার নিয়ে সুখের থাকার বিকল্প আর কী-ই-বা হতে পারে! এবার চাকরিই ছেড়ে দিলেন আরশি। ইতিমধ্যে মা হয়েছেন তিনি। স্বর্গসুখ যেনো হাতের মুঠোয়। ছোট্ট শিশুর দেখভাল করার জন্য নিয়ে আসেন নিজের খালাতো বোনকে। আর্য্যও খুব খুশি হয়েছেন আরশির কষ্ট কমবে বলে। স্বামীর ঘুমের সমস্যা এড়াতে আরশি প্রায়ই মেয়েকে নিয়ে অন্যঘরে ঘুমোতেন। সময়ের পরিক্রমায় হঠাৎ আর্য্যকে আবিষ্কার করেন তারই বোনের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায়। এই অবর্ণনীয় মানসিক আঘাত তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারেন নি। জীবনের দ্বিতীয় কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজে নিজেই সই করেন ডিভোর্সের দলিলপত্রে।

ডিভোর্স পরবর্তী মানসিক অবস্থা বুঝাবার জন্য দুটি উদাহরণ যথেষ্ট মনে করা যায়। যিনি ডিভোর্স দিতে উদ্যোগ নেন, তার জন্য সাময়িক চাপ লাঘবের অনুভূতি কাজ করতে পারে। তবে বেশিরভাগ দম্পতির ক্ষেত্রে ডিভোর্স তীব্র মানসিক ক্ষত তৈরী করে। সম্পর্কে বিচ্ছেদের আঘাত এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে।

আমরা আরশির দিকে তাকাই। সম্মানজনক পেশা ছেড়ে দেওয়া, চুরমার হয়ে যাওয়া স্বপ্নময় সংসার, এ যেন এক অসহনীয় রূপকথা। ক্ষিপ্রতার সাথে আরশি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছুতেই আরশি মেলাতে পারেন না তার জীবনের ঘটনাগুলো। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই ভাবেন, এমন কিছু যদি ঘটতো, যাতে সব কিছু পাল্টে যেতো! সময় ঘড়িটাকে পিছিয়ে দেওয়া যেতো!

মাঝে মাঝে এ-ও ভাবেন, আচ্ছা, কম্পিউটারের মতো আয্যর ওই অংশটুকু ডিলিট করে দেয়া গেলেইতো চলতো! এ জাতীয় হাজারো প্রশ্ন এসে ভীড় জমায় মনে!

বিচ্ছেদের ফলে নারীর আত্মপরিচিতির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। বেশিরভাগ মানুষ কারও স্বামী বা স্ত্রী হিসেবে সমাজে নিজের আত্মপরিচয় ধারণ করে অভ্যস্ত। বিচ্ছেদ হওয়াতে এই আকস্মিক পরিবর্তণের সাথে খাপ খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসই মানুষ হিসেবে সমাজে তার স্বীকৃতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হয়।কেউ কেউ নিজেকে গুটিয়ে নেন অন্য সকল যোগাযোগ থেকে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দূরত্ব বাড়তেই থাকে। সত্যিকারের বন্ধুর সহযোগিতা নিঃসন্দেহে উপকারী হবে।

অনেকের মধ্যে বিচ্ছেদের দীর্ঘ সময় পরও পূর্ববর্তী সঙ্গীর উপর তীব্র রাগ ও ক্ষোভ থেকে যায়। এটি ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি তৈরী করতে পারে। অনেকে এই ‍তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেতে দ্রুত আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা ক্ষতিকর হতে পারে পরবর্তী সম্পর্কের জন্য। তাই একটি বিচ্ছেদের পর যথেষ্ট সময় নিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যেতে পারে। যাতে নতুন সম্পর্ক আরো বেশি পরিপূর্ণ হয়।

লিখেছেনঃ

মোসাম্মাৎ নাজমা খাতুন
অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আবার বিয়ে করার আগে

সঙ্গী হারালে জীবন স্থবির হয়ে পড়ে। বিচ্ছেদ বা মৃত্যুর ঘটনায় কেউ জীবনসঙ্গীকে হারাতে পারেন। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। আর জীবনের প্রয়োজনেই অনেকে বিয়ে করার কথা ভাবেন। কিন্তু চাইলেই কি সব সহজভাবে মেলে?  মা-বাবা-সন্তানের কথা ভেবে তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হয়। সন্তান, নাকি নিজের জীবন, কোনটাকে প্রাধান্য দেবেন? সমাজও অনেক সময় মনে করে, সঙ্গীবিহীন অবস্থায় জীবনযাপন কষ্টকর। তবে মনে রাখতে হবে, স্ত্রী থাকা অবস্থায় বা তাঁকে না জানিয়ে বিয়ে করলে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ।

অনেক সময় স্ত্রীর মৃত্যু বা বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানকে না জানিয়ে হুট করে সংসারে নতুন সঙ্গীকে নিয়ে আসেন অনেকে। এটি সন্তানের মনোজগতে প্রভাব ফেলে। আকস্মিক এই আঘাত সে মেনে নিতে পারে না। পারিবারিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। এসব পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব যদি ভাবনার শুরু থেকেই সন্তানের কাছে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়। সন্তানের সিদ্ধান্তকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। মানবিক সম্পর্কের এই জায়গাগুলো বেশ জটিল। মনোজগতে নানা ধরনের আলোড়ন চলতে থাকে। তাই বড়দের বেশি ধৈর্য ধরতে হবে।

অনেক সময় শিশুটি নিজের মা-বাবার জায়গায় নতুন ব্যক্তিটিকে পছন্দ করতে পারে না। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে এগিয়ে আসতে হবে। কোনোভাবেই সন্তান যেন মানসিক চাপ বোধ না করে। সন্তানকে বোঝাতে হবে, এই বিষয়ে সে-ই মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে বন্ধুত্বের শুরুতে তাকে সব বুঝিয়ে বলুন।

সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। আপনার সন্তানের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়া ভালো হলে বা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। বিয়ের পর মা-বাবার উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। আগের মতো পারিবারিক আবহ বজায় রাখতে হবে। নতুন বাড়িতে উঠলে সেটিতে সে যেন পুরোনো পরিবেশ খুঁজে পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। হুট করেই তার আগের সব অভ্যাস পরিবর্তনের কথা বলা যাবে না। কেননা, শিশুটির হয়তো মা-বাবার সঙ্গে ঘুমানো অভ্যাস। তাকে যদি আলাদা ঘরে থাকতে বলা হয়, তখন সে ভাববে নতুন মানুষটির কারণে তার সব হারাতে হচ্ছে। সন্তানের সীমাবদ্ধতা, পছন্দ-অপছন্দ সব আগেই নতুন সঙ্গীকে জানিয়ে দিতে হবে। যদি দুপক্ষেরই সন্তান থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। কোনো ঝামেলা হলে এর মধ্যে মা-বাবার প্রবেশ না করাই ভালো। খুব ভালো হয় বিয়ের আগের একে-অপরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে। এমনকি বিয়ের দিনও কৌশলী হতে হবে। যাতে সন্তান মনে করে সে-ই সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে এবং সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

নতুন সঙ্গীকে সন্তানের কাছে আস্থাভাজন হতে হবে। মা-বাবার বিয়ের পর সন্তান যেন নিজেকে বাইরের কেউ মনে না করে। শিশুর মনস্তত্ত্ব মা-বাবাই সবচেয়ে ভালো বোঝেন। তবু এ সময় বাড়তি যত্ন নিতে হবে। আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে তাঁদের। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরও শুরুতে মা-বাবাকে ভুল বোঝা উচিত নয়। মনে কোনো প্রশ্ন না রেখে সরাসরি কথা বললে সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হবে না।

সুত্রঃ প্রথম আলো
লিখেছেনঃ তৌহিদা শিরোপা | জুন ০৬, ২০১৬