ব্যাঙের বিয়ে

ব্যাঙ্গা ব্যাঙ্গির বিয়া কুলা মাথায় দিয়া ও ব্যাঙ্গ পানি আন গিয়া /খালও নাই পানি, বিলও নাই পানি/ আসমান ভাইঙ্গা পড়ে ফোটা ফোটা পানি/ আম পাতা দিয়া দিলাম ছানি জাম পাতা দিয়া দিলাম ছানি/ তেও (তবু) পড়ে মেঘের (বৃষ্টির) পানি……. গানটি সুর করে গাইছেন কিশোরী ও মহিলারা। বাড়িটিতে উৎসবের আমেজ। গ্রামের নানা বয়সী লোকজনের ভিড়, বাড়ির এক পাশে চলছে রান্না-বান্না। ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজনও বাড়িটিতে কী হচ্ছে এক নজর দেখতে ভিড় জমাচ্ছে।

হাওর পারের জামলাবাজ গ্রামে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়। কী হচ্ছে_এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল গ্রামের নির্মল সরকারের বাড়িতে ব্যাঙের বিয়ে হচ্ছে। বাড়িতে রান্না হচ্ছে, গ্রামবাসী ও অতিথিদের জন্য। ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি হয় এ বিশ্বাস থেকেই এমন আয়োজন। সাজানো হয়েছে বিয়ের আসর। মাঝখানে দুটি গর্তে আলাদাভাবে রাখা হয়েছে একটি নারী ও একটি পুরুষ ব্যাঙ। সেখানে আম পাতা ও জাম পাতার পানি দিয়ে গোসল করিয়ে বিয়ে দেওয়া হলো ব্যাঙ দুটিকে। পুরুষ ব্যাঙের অভিভাবক ছিলেন রোকেয়া বেগম (৪২) এবং নারী ব্যাঙের অভিভাবক মালা রানী দাশ (৩৫)।

কবে থেকে এ ধরনের বিয়ের সংস্কৃতি চলে আসছে এ বিষয়ে কেউই সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি। তবে জানা যায় , বহুকাল ধরেই মাঘ ও ফাল্গুন মাসে বৃষ্টি না হলে হাওরপারের গ্রামগুলোতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়। কারণ এ সময় হাওরের বুকজুড়ে থাকে ধান আর ধান। হাওরপারের গ্রামবাসীর ধারণা ব্যাঙের বিয়ে হলে বৃষ্টি হবে এবং তাদের ধান উৎপাদন ভালো হবে। বিয়ে দেখতে আসা মধ্য তাহিরপুর গ্রামের আব্দুর রহিম (৯৮) জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই ব্যাঙের বিয়ে দেখে আসছেন এবং মেয়েদের সঙ্গে তাঁরাও তখন এতে অংশ নিতেন। এখন বৃষ্টি হলে হাওরে লাগানো ধানের উৎপাদন ভালো হবে। হাওরাঞ্চলে প্রচলিত অনেক সংস্কৃতি হারিয়ে গেলেও বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে অনুষ্ঠানটি এখনো টিকে আছে।

প্রচণ্ড তাপদাহে পুড়ছে গাইবান্ধার মাঠ-ঘাট। ভরা বর্ষাকালেও বৃষ্টির দেখা নেই। ফেটে চৌচির শস্য ক্ষেত। কৃষক বাবার বিষন্ন মুখ দেখে কিশোর-কিশোরীরা আয়োজন করে ব্যাঙের বিয়ের। তাদের বিশ্বাস ব্যাঙের বিয়ে দিলেই বৃষ্টি নামবে অঝোর ধারায়। ক্ষেত জুড়ে ফলবে শস্য। গাইবান্ধার মেঘডুমুর গ্রামে এই বিয়েকে ঘিরে শুরু হয় উৎসর আমেজ। লাল নীল কাগজে সাজানো চারদিক। গায়ে হলুদের আয়োজনে যেতে ব্যস্ত কিশোরীরা। হলুদ শাড়ি, সাজগোজ সবই চলছে। কলাগাছ পুঁতে তৈরি বিয়ের আসর। প্রদীপ থেকে শুরু করে পান, সুপারী, দূর্বা ঘাস, মিষ্টিসহ বিয়ের সব উপকরণই প্রস্তুত।

বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রামীণ সমাজের এক প্রাচীন রীতি। সেই রীতিতেই আগের দিন ধরে রাখা দু’টি ব্যাঙকে রং লাগিয়ে সাজানো হয়। ব্যাঙ ও বৃষ্টির ছড়া কেটে দেয়া হয় বিয়ে । সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকেলে পকুরে ছেড়ে দেয়া হয় নব দম্পতিকে। ব্যাঙ দম্পতি জলাশয়ে সাঁতার কাটে, আর তীরে বসে কিশোর কিশোরীরা ভাবে এবার বৃষ্টি হবে।  বিয়ের দিন, তার পরও ওদের মধ্যে দেখা যায়নি কোনো উত্তেজনা! কিন্তু গ্রামের সবাই উৎসুক হয়েই হাজির হয়েছিল বিয়েতে। রীতিমাফিক পূজা-অর্চনাও হয়েছে। ভারতের টাকহাটপুর গ্রামের বাসিন্দারা বিয়েতে বর-কনের সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য নয়, প্রার্থনা করেছেন বৃষ্টির জন্য! বিয়ের পাত্র-পাত্রী দুটি কোলা ব্যাঙ!

সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে একটি এলাকায় ২৫০ মানুষ মিলে দিয়েছে ব্যাঙের বিয়ে৷ কারণ তারা ধরণীতে চায় বৃষ্টির ছোঁয়া৷ বিয়ের ‘‘বর-কনে”কে আনা হয়েছে ঢাকা থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম থেকে৷ গ্রামবাসীরা এই বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলো৷কারণ অনেকদিন ধরে সে অঞ্চলে বৃষ্টি না হওয়ায় পানির স্বল্পতা দেখা দিয়েছিলো৷সে গ্রামের স্কুল শিক্ষক নূর মোহাম্মদ জানান ‘‘তিনি ঐ বিয়ের অনুষ্ঠানে একজন অতিথি ছিলেন৷ ছেলে-বুড়ো, নারী সব মিলে সেখানে ২৫০ মানুষ অংশগ্রহণ করে৷ তারা সেখানে নাচে-গানে মুখর হয়ে উৎসবে মেতে উঠেছিলো৷ অতিথিদের ভাত-ডাল, মাছ, গরুর মাংস এবং মিঠাই দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়৷ ‘‘বর-কনে” এক ধরনের বিশেষ বিয়ের পোশাক পরেছিল৷ গ্রামবাসী সবাই মিলে তাদের আশীর্বাদ জানিয়েছে৷ তারপর ‘‘বর-কনে”কে ছেড়ে দিয়েছে পাশের একটি পুকুরে”৷ তিনি আরো জানান, ‘‘সেদিন রাতে সে অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে৷ তাঁর বিশ্বাস এই বৃষ্টি সেই বিয়ের কারণেই হয়েছে”৷ ছড়া কবিতায় ব্যাঙের বিয়ের কথা শোনা থাকলেও বাস্তবে এমন বিয়ের কথা অবশ্য প্রথমবারের মতোই জানা গেল৷

মন্তব্য করুন