দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি

বিবাহ হলো একটা জটিল বাস্তবতা। তাই দাম্পত্য জীবন একেবারে সমস্যা ও সঙ্কটমুক্ত নয়। দাম্পত্য জীবনের বাস্তবতায় চোরের মতো ইচ্ছা-অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে কোন সমস্যা প্রবেশ করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, দাম্পত্য সমস্যা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।  বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রূপে এর আবির্ভাব ঘটে। দাম্পত্য সমস্যা মূলত সৃষ্টি হয় দু’জনের প্রয়োজনের চাহিদা থেকে।  অর্থাৎ একজনের প্রয়োজনের চাহিদার সঙ্গে অন্যজনের প্রয়োজনের চাহিদার মধ্যে সংঘর্ষ।
দাম্পত্য সমস্যার কারণ:

দাম্পত্য সমস্যার পেছনে ৩ রকমের কারণ রয়েছে।  তা হলো-
১) ব্যক্তি নিজে
২) বিবাহের মূল উপাদানে এবং
৩)বাইরের বা পারিপার্শ্বিক কারণ।

ব্যক্তি নিজে কারণ : বিবাহ একজন পুরুষ এবং একজন নারীর দাম্পত্য বন্ধন। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এক হলেও তারা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র জীবনবোধ নিয়ে সমৃদ্ধ। এখানে ব্যক্তি হিসেবে স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই দাম্পত্য সমস্যার কারণ হতে পারে।যেমন, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক কারণ। শারীরিক দীর্ঘকালীন রোগব্যাধি, অসুস্থতা, শারীরিক দুর্বলতা, শারীরিক অক্ষমতা, ছোঁয়াচে রোগ, মানসিক বিকারগ্রস্ততা, ট্রম্যাটিক, সাইকিক, নিয়োরটিক, সিজোফ্রেনিক, এলকোহলিক, মানসিক ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি।

আবার ব্যক্তিত্বও একটা কারণ হতে পারে। অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব যেমন- ঘরকুনো, চাপা স্বভাব, হীনম্মন্য, সন্দেহবাতিক, সঙ্কীর্ণচেতা, নিঃসঙ্গ ও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ। আবার অন্যদিকে বহির্মুখী ব্যক্তিত্ব যেমন- অতিরিক্ত হৈহুল্লোড় স্বভাব, সময়জ্ঞানের অভাব, বাইরে বাইরে সময় কাটানো, বন্ধুসার্কেল নিয়ে আড্ডা মারা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। দুর্বল ব্যক্তিত্ব যেমন- পরনির্ভরশীলতা, সিদ্ধান্তহীনতা, দায়িত্ব নেয়ার অক্ষমতা, অন্যের কথায় কান দেয়া, গোপনীয়তা রক্ষা না করার দুর্বলতা, মেরুদ-হীন হীনম্মন্য, আস্থার অভাব, খুঁতখুঁতে স্বভাব, নিজস্বতা রক্ষা করার দুর্বল মানসিকতা, সন্দেহপ্রবণ। ব্যক্তিত্বের দম্ভ। যেমন- আত্ম অহমিকা, ব্যক্তিমর্যাদা ক্ষুন্ন, দমনীয় ভাব, নমনীয়তার অভাব, কর্তৃত্বপরায়ণতা, অতিরিক্ত মেজাজ ও আবেগ প্রবণতার অভাব, গ্রহণশীলতার অভাব, প্রবল আত্মমর্যাদা বোধ, স্বার্থপরতা, পেশিশক্তি প্রয়োগের প্রবণতা, অস্বচ্ছলতা, গোয়ার্তুমিভাব, অনাস্থা, আপোসহীন মানসিকতা, জেদ, জবাবদিহিতা আদায়ের ভাব, দোষ খোঁজার মানসিকতা।

বিবাহের মূল উপাদান : দু’জন নর-নারীর পারস্পরিক সম্মতির বিনিময়ই বিবাহ। সম্মতির মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেটাই বিবাহের মূল উপাদান। আর দাম্পত্য জীবনে বিবাহ প্রতিশ্রুতি এই উপাদানের অনুপস্থিতি এবং এর অভাবই দাম্পত্য সমস্যার কারণ।  যেমন- ভালবাসার অভাব, বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার অভাব, যৌনাচার, বহুগামিতা, দৈহিক অক্ষমতা, পুরুষত্বহীনতা, পাশবিকতা, দৈহিক মিলনে অনীহা এবং এড়িয়ে চলা, সন্তানদানে অক্ষমতা, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভবঘুরে, ভুল সঙ্গী নির্বাচন।

পারিপার্শ্বিক কারণ : এখানে বাইরের কোন শক্তি বা তৃতীয় কোন শক্তি বা পক্ষ পারিপার্শ্বিক কোন এজেন্ট দাম্পত্য সমস্যার কারণ হয়ে আসে। এর মধ্যে পিতা, মাতা, ভাই বোন, শশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ, কোন মিথ্যা গুজব, অন্যের পক্ষপাতিত্ব মনোভাব, অন্যের অতিরিক্ত আবেগ, সোহাগ, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, মদ-নেশা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব চাকরি পেশা, অসৎ ব্যবসা, মোবাইল, ফেসবুক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, অসততা, অতীত টেনে আনা, বশ করা, চাকরির তাগিদে দূরে অবস্থান।

দাম্পত্য কলহ ও তার সমাধান:
ঝগড়া যে দাম্পত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই শ্বাশত সত্যটি প্রত্যেক স্বামী-স্ত্রীই মনে মনে জানেন এবং মানেন। হরেক রকম তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ঝগড়া যেমন লেগেই থাকে, ঠিক তেমনই ঝগড়া মেটানোর নানা উপায়ের খবরও রাখতে হয় দম্পতিদের। কারণ, দু’জন দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলে আর যাই হোক সংসার চলে না। মনেও একটা তেঁতোভাব রয়েই যায়।

* কথা কাটাকাটির সময় হঠাৎ উঠে চলে যাবেন না বা এক্কেবারে চুপ করে যাবেন না। যতটা সম্ভব যুক্তিসহকারে নিজের অভিযোগ বা বিরক্তি বোঝান। উঠে চলে গেলে বা কথা বন্ধ করলে মনে হবে যে আপনি পুরো ব্যাপারটা থেকে পালাতে চাইছেন। কোন সুষ্ঠু সমাধানে আসার জন্য কথার আদান-প্রদান হওয়া খুব জরুরী।

* ঝগড়ার সময় স্বামী বা স্ত্রী সব দোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে গেলে কিন্তু সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে। কেউই সহজে নিজের দোষ দেখতে পান না। রাগের মাথায় তো প্রশ্নই আসে না। আর সব ‘সমস্যা’ বা ‘ঘটনা’ নিয়ে আলোচনা করুন। সমস্যা বোঝার সময় বেশি আদর্শবাদী না হয়ে বাস্তববাদী হোন। ‘কী করা উচিত’ না ভেবে ‘কী করলে ভাল হয়’ সেটা বুঝতে পারলে সমাধান হবে।
* ঝগড়ার সময় আপনি হারলেন কি জিতলেন, সেটা পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। যা নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল সেটার কোন সঠিক রাস্তা পেলেন কি না সেটা ঠিক করাই মূল লক্ষ্য। এই জরুরী ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে শুধু ঝগড়ার জন্য ঝগড়া করাটা নিহায়তই ছেলেমানুষি। যদি কথা কাটাকাটির সময় মনে হয় যে দোষটা আপনরাই তাহলে ‘স্যরি’ বলতে বিন্দুমাত্র দেরি করবেন না। বিশ্বাস করুন, এটা হেরে যাওয়া নয়। আপনার সত্যবাদিতার জন্য আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনাকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করবেন।

কীভাবে মেটাবেন ঝগড়া:
আপনি নিজেদের মধ্যে ছোট্ট অশান্তিটাকে জিইয়ে রাখতে চাইছেন না তা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সবচেয়ে সুন্দর উপায় হচ্ছে স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি নিজের ভালবাসা দেখানো। ছোট্ট একটা শব্দ ‘স্যরি’ বলুন দেখবেন আর কোন কৈফিয়তের প্রয়োজনই হবে না। প্রবলেম কিভাবে যে মিইয়ে যাবে আপনি তা বুঝতেই পারবেন না। দ্বিতীয় কোন উপায়ে ঝগড়া মিটমাট করার চিন্তা থাকলে এক্ষেত্রে ‘উপহার’ দেয়ার কথাটা মাথায় রাখতে পারেন। ধরুন, আপনার স্বামীর একটা ট্যাব কেনার শখ হয়েছে কিন্তু প্রতিমাসে কোন না কোন খরচ এসে পড়ছে বলে আর কেনা হয়ে উঠছে না। ফলে উনি একটু মনোকষ্টে আছেন। ঝগড়ার পর শান্তি ফেরানোর জন্য না হয় একটু বেশিই খরচ হলো। তবে সব সময় যে দামী জিনিস দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তার পছন্দের খাবারটিও ভাল করে রেঁধে একসঙ্গে খেতে বসে যান। মনের মতো জিনিস পেলে ঝগড়া মিটতে সময়ই লাগবে না। তৃতীয় উপায়টি আরও একটু শক্ত। নিজের ব্যবহারের মধ্যে পরিবর্তন আনুন। আপনি যে অনুতপ্ত তা যদি প্রিয় মানুষটিকে বোঝাতে পারেন, তাহলে আলাদা করে ঝগড়া মেটানোর দরকার হয় না। আর যদি বেশি সঙ্কোচ বোধ করেন তাহলে মোবাইল বা ফেসবুকে মেসেজে ছোট্ট একটা মেসেজ সঙ্গে একটা স্মাইলি।  ব্যস, ঝগড়া খতম!

যা কখনই করবেন না
* ভায়োলেন্সের সাহায্য নেবেন না। বাড়ির জিনিসপত্র ভাঙা বা ছেঁড়া কিংবা স্বামী বা স্ত্রীকে শারীরিক আঘাত দেয়া।
* পরিবারের অন্য সদস্যের জড়িয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি।
* পুরনো রেফারেন্স টেনে এনে অশান্তি বাাড়িয়ে তোলা।
* গলা তুলে, আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা।
* বাচ্চাদের দাম্পত্য কলহে শরিক করে নেয়া।
* ঝগড়ার জের টেনে কথা বলা বন্ধ বা বিছানা আলাদা করে নেয়া।

নববধূর সাজসজ্জায় নয়, বাড়ির অন্দরমহলও রঙিন, উষ্ণ হয়ে উঠতে পারে সামান্য ফুলের ছোঁয়ায়। ফুল আসলে কোথায় সাজাবেন, কিভাবে সাজাবেন তার কোনো ব্যাকরণ হয় না, আপনার মনের খুশিমতো সাজান। অন্দরমহলে কয়েকটা জায়গা ফুল সাজানোর জন্য আদর্শ। মূল দরজা,সিলিং রুম, সেন্টার টেবিল, বেডরুমের সাইড টেবিল কিংবা ড্রেসিং টেবিল। তাই আপনার নতুন জীবন শুরু করুন সাজ, রঙ এবং ফুলের সৌরভে ভরপুর করে।  সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ