ভরণপোষণের অধিকার

মিতুর বিয়ে হয়ে পেরিয়ে গেছে বছর তিনেক। বিয়ের পরপরই জানা গিয়েছিলো স্বামী মাদকাসক্ত। মাদকের গ্রাস থেকে স্বামীকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করেছে মিতু। লাভ হয় নি। এরইমধ্যে কোল জুড়ে এসেছে একটি সন্তান।

সন্তান জন্মানোর পর স্বামী মিতুকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। কোনো ভরণপোষণ এমনকি একমাত্র সন্তানের জন্যও কোন টাকা পাঠায় না। মিতু লেখাপড়া তেমন একটা করে নি যে চাকরী করবে। আবার বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। নিজের এবং সন্তানের ভরণপোষণের জন্য এখন কী উপায় খুঁজবে সে? আইনে তার ভরণপোষণের অধিকার নিশ্চিত করা রয়েছে। মুসলিম আইনে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, মা-বাবা, যারা আর্থিকভাবে অসমর্থ, তাদের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।

স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিয়ে বর্তমান থাকা অবস্থায় ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার লাভ করে। ছেলেসন্তান সাবালক না হওয়া পর্্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বিয়ে না হওয়া পয্যন্ত বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের দাবিদার। ছেলেসন্তান সাত বছর পয্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বিয়ে না হওয়া পয্যন্ত যদি মায়ের কাছে কিংবা মায়ের মা অর্থাৎ নানির কাছে থাকে, তবু বাবা তার ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।

এছাড়া পঙ্গু, অক্ষম, পাগল এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী সাবালক সন্তানও বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবে। তবে সন্তান যদি অন্যায়ভাবে বাবার সাথে থাকতে অস্বীকার করে কিংবা যে শিশু নিজস্ব সম্পত্তির আয় থেকে নিজের ভরণপোষণ করতে সক্ষম, তার ভরণপোষণ দিতে বাবাকে বাধ্য করা যাবে না। কিছু ক্ষেত্রে আলাদাভাবে বসবাস করলেও স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রাখেন। যেমন, স্ত্রীকে তাৎক্ষণিকভাবে দেনমোহর পরিশোধ না করলে, স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে, স্বামী যদি অভ্যাসগতভাবে খারাপ ব্যাবহার করেন, দীর্ঘকাল স্ত্রীর কাছ থেকে স্বামী দূরে থাকলে ও অনুমতি ছাড়া স্বামী দ্বিতীয়বিয়ে করলে।

ভরণপোষণের পরিমাণ স্বামী-স্ত্রীর মর্যাদা ও আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভর করে। অনেক সময় নিকাহনামায় লেখা থাকে ভরণপোষণ হিসেবে স্বামী কতোটাকা মাসিক দেবেন। সাধারণ অবস্থায় স্বামী তার নিজ গৃহেই স্ত্রীর খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান দিয়ে থাকে। আইনসঙ্গত বা যুক্তিযুক্ত কারণে যখন স্ত্রী আলাদা বসবাস করে, তখন স্বামী নগদ অর্থ দ্বারা ভরণপোষণ জোগাবে।

আইনসম্মত স্বামী যদি স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ না দেয়, তাহলে পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাওয়া যায়। ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী এ অধিকার রয়েছে। সন্তান ও বৃদ্ধ মা-বাবাও আদালতের মাধ্যমে ভরণপোষণ পাওয়ার জন্য মামলা করতে পারেন।

এছাড়া ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী খরপোশ দাবি করে স্বামীর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে আবেদন করতে পারেন। আবেদন পাওয়ার পর চেয়ারম্যান স্ত্রী ও স্বামী উভয়পক্ষের পছন্দমতো একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সালিস-পরিষদ গঠন করবেন। সালিস-পরিষদ স্ত্রীর দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করে ভরণপোষণের পরিমাণ নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত এবং সেই মোতাবেক একটি প্রত্যয়নপত্র প্রদান করবে।

স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকলে ভরণপোষণ

স্ত্রী যদি যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামীর কাছ থেকে আলাদা বসবাস করেন, তবে, স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন না। তবে, বিবাহিত থাকা অবস্থায় স্ত্রী আলাদাভাবে বসবাস করা স্বত্ত্বেও কয়েকটি ক্ষেত্রে ভরণপোষণ পেতে পারেন।

স্বামী যদি স্ত্রীর তাৎক্ষণিক দেনমোহরের দাবি অস্বীকার করেন; স্বামী বর্বর বার নিষ্ঠুর আচরণ করেন, স্ত্রী আলাদা বসবাস করেও ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। এছাড়া স্বামী আরেকটি বিয়ে করলে বার রক্ষিতা রাখলে স্ত্রী স্বামীর সাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন এবং তারপরও স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ দাবি করার অধিকার রাখেন।

বিয়েবিচ্ছেদের পর ভরণপোষণ

বিয়েবিচ্ছেদের পরও কিছুদিন স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। যেদিন থেকে বিচ্ছেদ কার্কর হয় সেদিন থেকে ৯০ দিন (এসময়কে ইদ্দত বলা হয়)পয্যন্ত স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। {হেফজুর রহমান বনাম শামসুন্নাহার বেগম ৪ এমএলআর (অউ ) (১৯৯৯ )}

কোনো স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে মামলা দায়ের করার আগের সময়ের জন্য অথবা বিয়েবিচ্ছেদের আগে যে সময় স্বামী ভরণপোষণ দেয় নি সে সময়ের জন্যও ভরণপোষণ চাইতে পারেন। সিরাজুল ইসলাম বনাম হেলেনা বেগম (৪৮ উখজ )মামলায় আদালত বলেন, স্ত্রীর বকেয়া ভরণপোষণের বিষয়ে আদালতের ডিক্রি জারি করার বিচারিক ক্ষমতা আছে।

হিন্দু আইনে ভরণপোষণ

হিন্দু আইনে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে:

একজন হিন্দুর কোন সম্পত্তি না থাকলেও সে তার নাবালক ছেলে, অবিবাহিত মেয়ে ও বাবা-মায়ের ভরণপোষণ করতে আইনত বাধ্য। দায়ভাগামতে, বাবা সাবালক ছেলেকে ভরণপোষণ করতে আইনত বাধ্য নন।

কর্তা যৌথ পরিবারের সকল পুরুষ, তাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের ভরণপোষণে আইনত বাধ্য। একজন মৃত ব্যক্তি যাদের ভরণপোষণে বাধ্য ছিলো, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধীকারীরাও মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি হতে তাদের ভরণপোষণ করতে আইনত বাধ্য।

বিয়ে না হওয়া পয্যন্ত বাবা তার কন্যা সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। বাবার অবর্তমানে কন্যার ভরণপোষণ বাবার সম্পত্তি হতে চলতে থাকবে। অক্ষমতা বা অযোগ্যতা হেতু কেউ পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলে তাকে ও তার পরিবারবর্গকে অক্ষম ব্যক্তির বাবা ও বাবার অবর্তমানে বাবার উত্তরাধীকারী যথাযোগ্য ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।

১৯৪৬ সালের বিবাহিত হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী, স্ত্রী অসতী না হলে বা অন্য ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে হিন্দু ধর্ম থেকে বহিস্কৃত না হলে সে তার জীবনকালে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।

১৯৪৬ সালের বিবাহিতা হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইন অনুযায়ী, নিম্নোক্ত কারণ সমূহের উদ্ভব হলে একজন বিবাহিত নারী স্বামীর কাছ থেকে পৃথক থেকেও ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী:

  • স্বামী যদি এমন কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে যা সে তার স্ত্রীর কাছ থেকে পায় নি
  • স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে এবং নিষ্ঠুরতা যদি এমন পয্যায়ের হয় যে স্বামীগৃহে তার জীবনাশঙ্কার ভয় রয়েছে
  • স্বামী যদি স্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই তাকে পরিত্যাগ করে
  • স্বামী যদি স্ত্রীর বর্তমানে পূনরায় বিয়ে করে
  • স্বামী যদি ধর্মান্তরিত হয়
  • স্বামী যদি ঘরেই কোন উপপত্নী রাখে অথবা অভ্যাসগতভাবে উপপত্নীর সাথে বসবাস করে
  • অন্যান্য যৌক্তিক কারণ

স্বামীর মৃত্যুকালীন পৃথক সম্পত্তি বা স্বামীর সহ-অংশীদারী সম্পত্তি থেকে একজন বিধবা স্ত্রী ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। স্বামীর মৃত্যুকালীন সময়ে পৃথক বসবাস করলেও তার এ অধিকার বজায় থাকে। অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত স্বামীগৃহ ত্যাগ না করলে সে বকেয়া ভরণপোষণও পাওয়ার অধিকারী।

খ্রিষ্টান আইনে ভরণপোষণ

১৮৬৯ সালের ডিভোর্স অ্যাক্টের ৩৭ নং ধারা অনুযায়ী, স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদের পর থেকে স্থায়ীভাবে ভরণপোষণ পেতে পারে। এছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মে সন্তান ভরণপোষণের কথাও বলা হয়েছে। পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্ত্রী-সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামী বা পিতার। বিয়ে বর্তমান থাকাকালীন অবস্থায় স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দেবেন। মা-বাবার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সন্তানের ভরণপোষণের প্রশ্নটি আদালতের এখতেয়ারাধীন। সন্তানের কল্যাণের কথা চিন্তা করে, আর্থিক সামর্থের বিবেচনায় আদালত রায় দেবেন, কী পরিমাণ ভরণপোষণ সন্তানদের দেবেন। এই আইন অনুযায়ী, জেলা আদালত বা হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করতে হয়।

উল্লেখ্য, অবহেলিত সন্তানরা ফৌজদারী দন্ডবিধির ৪৮৮ ধারার অধীনে ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে পিতাকে ভরণপোষণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার জন্য মামলা করতে পারে। এক্ষেত্রে সব ধর্মের সন্তানেরা তা পারবে।

লিখেছেনঃ

লোকমান বিন নূর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর